StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

ওয়াশিংটন সম্মেলনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর

ওয়াশিংটন সম্মেলনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর 

• প্রেক্ষাপট/পটভূমি

প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪-৯৫) থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস মূলত রাষ্ট্র হিসেবে জাপানের জয়, সাফল্য ও একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। এই পর্বে জাপান চীন ও রাশিয়ার মত বৃহৎ শক্তিকে যেমন পরাজিত করেছিল তেমনি গ্রেট ব্রিটেনের মত ইউরোপের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে মৈত্রী চুক্তি (১৯০২) স্বাক্ষরিত করেছিল। এর ফলে জাপানের যেমন আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনি তার সাম্রাজ্যবাদী লালসাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

জাপানের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও শিল্পের বিকাশের ফলে কয়লা ও লোহার মত খনিজ দ্রব্যের পাশাপাশি কাঁচামালের প্রয়োজন দেখা দেয়। এছাড়া কলকারখানাজাত শিল্পসামগ্রী বিক্রয়ের জন্য বাজারেরও প্রয়োজন ছিল। এই সময় জাপানের ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটলে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার খাদ্য ও বাসস্থানের প্রয়োজন দেখা দেয়। উপরোক্ত কারণ ছাড়াও জাপানের সরকার ও সম্প্রসারণবাদী জিঙ্গোগোষ্ঠী জাপানকে উপনিবেশ বিস্তারে তথা সাম্রাজ্যবাদে মদত যোগায়। সম্প্রসারণ তথা বিস্তার নীতির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জাপান চীনের কাছ থেকে ফরমোজা, কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়া, রাশিয়ার কাছ থেকে দক্ষিণ সাখালিন ও জার্মানির কাছ থেকে শান্টুং লাভ করে।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। এই যুদ্ধের সময়-ই জাপান প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জাপান চীনের কাছে ২১ দফা দাবি পেশ করে বেশ কিছু অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে জার্মানির পরাজয় ঘটলে শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে জাপানের উত্থান সহজ হয়।

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের প্যারিস শান্তি সম্মেলনে জাপানের দাবিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল চীনের দাবিকে অগ্রাহ্য করে। পূর্ব এশিয়ায় জার্মানির উপনিবেশগুলিতে বিশেষ করে শান্টুং অঞ্চলে জাপানের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে জাপানের দ্রুত অগ্রগতি সাধিত হয়। জাপানের এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাধা দেবার কেউ ছিল না, কারণ ব্রিটেনের সঙ্গে জাপান মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল এবং যুদ্ধোত্তর ব্রিটেন তখন অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত ছিল। অন্যদিকে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব সম্পন্ন হলে রাশিয়া পূর্বের সম্প্রসারণবাদী নীতি থেকে সরে আসে।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জাপান পূর্ব এশিয়ায় এক অপ্রতিহত শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের জার্মান উপনিবেশগুলির উপর জাপানের বাধ্যতামূলক অধিকার জন্মায় এবং জাপান দ্রুত নৌশক্তি বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়। ১৯১৭ থেকে ১৯২১ এর মধ্যে নৌশক্তি বৃদ্ধির জন্য তিনগুণ ব্যয় ধার্য করা হয়। এর ফলে জাপান বিশ্বের তৃতীয় নৌশক্তিধর দেশে পরিণত হয়। নৌশক্তিতে বলীয়ান জাপান এই সময় উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত সব সাগরগুলি নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। সাখালিনের উত্তরে ওখোটস্ক (Okhotsk) সাগর, ভ্লাডিভত্তকের দক্ষিণে জাপান সাগর এবং কোরিয়ার দক্ষিণে পীত সাগর বা Yellow Sea সবই জাপানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এছাড়া মাঞ্চুরিয়ার উত্তরে আমুর নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকার ফলে জাপানের বাণিজ্যিক অগ্রগতি প্রশস্ত হয়। ফরমোজা, কোরিয়া, মাঞ্চুরিয়া, শান্টুং-এ জাপানী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে পিকিং-এর উপরে জাপান প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।

বস্তুত ১৮৯৫ থেকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাপান যে সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করে তার স্বাভাবিক ফল হিসেবে চীনের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বই শুধু বিপন্ন হয়নি পাশ্চাত্য শক্তিবর্গও জাপানের উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপে আতঙ্কিত বোধ করে। তাই পূর্ব এশিয়ায় জাপানী কর্তৃত্ব খর্ব করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধ পরিকর হয়।

জাপানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রুশ-জাপান যুদ্ধ শুরু না হওয়া পর্যন্ত ভালই ছিল। জাপানের সৌভাগ্য যে সে এমন একটি দেশ দ্বারা উন্মুক্ত হয়েছিল যার পাশ্চাত্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মত ভূখণ্ড আগ্রাসনের বা প্রভাবের ক্ষেত্র (Spheres of Influence) গড়ে তোলার বাসনা ছিল না। পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা ও অতিরাষ্ট্রিক অধিকার ভোগ করলেও সকলের সমান বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধার পক্ষপাতী ছিল আমেরিকা। এই উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনে ‘‘মুক্তদ্বার নীতি’ ঘোষণা করেছিল। জাপানের ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ব্রিটেন উভয় দেশই পূর্ব এশিয়ায় জাপানের উত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিল মূলত রাশিয়ার অগ্রগতিকে প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার মত বৃহৎ শক্তিকে পরাজিত করার পর জাপান সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব পাল্টায়। আসলে রুশ-জাপান যুদ্ধোত্তর পর্বে জাপানে যেভাবে জঙ্গী মনোভাব তথা সাম্রাজ্যবাদ বৃদ্ধি পায় তাতে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের আতঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল।

জাপানে নৌ ও সামরিক শক্তির বৃদ্ধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে নৌবহর স্থানান্তরিত করলে এবং হাওয়াই ও ফিলিপাইনস দ্বীপপুঞ্জের নিরাপত্তার স্বার্থে নৌবহর বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করলে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এর আগে মাঞ্চুরিয়ায় রেল সম্প্রসারণ নিয়ে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কিন রেল বিশেষজ্ঞ হ্যারিম্যান (Harriman ও মার্কিন বিদেশ সচিব পি. সি. নক্স মাঞ্চুরিয়ায় রেল জাতীয়করণের প্রস্তাব দিলে জাপান ও রাশিয়া এর তীব্র বিরোধিতা করে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে জাপানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল অভিবাসন সমস্যা (Immigration problem) নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলবর্তী শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকের অভাবে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে বিংশ শতকের প্রথমদিক থেকেই জাপানী শ্রমিকেরা কর্মের সংস্থানে ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে পাড়ি জমায়। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান উভয় দেশেরই স্বার্থসিদ্ধ হয়েছিল। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সস্তায় দক্ষ শ্রমিক যেমন পেয়েছিল তেমনি জাপানের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার একাংশ বিদেশে পাড়ি দিলে দেশের খাদ্য ও বাসস্থান সমস্যা কিছুটা লাঘব হয়। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের অধিবাসীরা এই অভিবাসন বন্ধ করার জন্য মার্কিন সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। কারণ জাপানী শ্রমিকদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি স্থানীয় আমেরিকানদের মনে এই উদ্বেগের সৃষ্টি করে যে অদূর ভবিষ্যতে পীতাঙ্গ জাপানীরা সংখ্যায় তাদের ছাপিয়ে যাবে এবং তারা সংখ্যালঘু হয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা হারাবে। তারা মনে করত নিম্নমানের জাপানী সংস্কৃতির সংস্পর্শে তাদের জাতীয় ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাপানীদের অভিবাসন বন্ধ করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের চিকাগো শ্রমিক সম্মেলনে জাপানী শ্রমিকদের অভিবাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মত ব্যক্ত করা হয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে Gentleman’s Agreement স্বাক্ষর করে জাপান সরকার জাপানী শ্রমিকদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেবার ছাড়পত্র দেবে না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও ক্যালিফোর্নিয়ার স্থানীয় অধিবাসীরা আইন করে জাপানী শ্রমিকদের আমেরিকায় আসা বন্ধ করার দাবি জানাতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট (Immigration Act) বিধিবদ্ধ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক চরম তিক্ততার পর্যায়ে এসে পড়ে। পূর্বএশিয়ায় জাপানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তাই তার প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল। মাঞ্চুরিয়ায় ও চীনে আমেরিকার স্বার্থ পুনরুদ্ধারের প্রয়াস থেকেই মার্কিন জাপান বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। এইভাবে আধুনিক পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস-ই ওয়াশিংটন সম্মেলনের প্রেক্ষাপট রচনা করে বলে ঐতিহাসিক ভিনাক মনে করেন।

জাপানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটলে গ্রেট ব্রিটেন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। পূর্ব এশিয়ায় জাপানের একাধিপত্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শিথিল সম্পর্ক কোনটাই ব্রিটেনের কাছে কাম্য ছিল না। তাই ইঙ্গ-জাপান মৈত্রী চুক্তি ক্রমশ ব্রিটেনের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া অভিবাসন সমস্যায় বিব্রত কানাডাও ইঙ্গ-জাপান মৈত্রীচুক্তি বাতিল করার জন্য চাপ দিতে থাকে। এই সময় রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য সাম্যবাদের উত্থানকে বাস্তব করে তুললে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান পারস্পরিক তিক্ততা ভুলে গিয়ে লানসিং-ইশাই চুক্তি (১৯১৭) স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এই সন্ধির শর্তানুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে চীনের উপর জাপানের বিশেষ অধিকার থাকবে, এই মর্মে স্বীকৃতি জানায়। উভয় দেশের জনগণ এই চুক্তিকে ভাল মনে গ্রহণ করতে পারেনি, কারণ তাদের মনে হয়েছিল উভয় দেশ একে অপরের কাছে নতিস্বীকার করেছিল। এই অবস্থায় পূর্ব এশিয়ায় জাপানের নৌশক্তি খর্ব করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হারডিং (Harding) ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১২ই নভেম্বর, রাজধানী ওয়াশিংটনে এক সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলন চলে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। এই সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, হল্যান্ড, পর্তুগাল, জাপান ও চীন যোগদান করেছিল। বলশেভিক বিপ্লবজাত সাম্যবাদী সোভিয়েত রাশিয়া তখনও সকল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি জন্যই হয়ত তাকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানান হয়নি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top