ক্যান্টন বাণিজ্য সম্পর্কে টীকা লেখ
চীনা সাম্রাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত ক্যান্টন বন্দর তাং যুগ থেকেই (খ্রিস্টাব্দ ৬১৮ ৯০৭) বিদেশী বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রের দ্বারা চীন উন্মুক্ত হবার পূর্বের ৮৫ বছর ধরে ক্যান্টন ছিল একমাত্র বন্দর যা বিদেশী বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত ছিল। চীনের এই পর্বের বৈদেশিক সম্পর্ক মূলতঃ ক্যান্টন বাণিজ্য কেন্দ্রিক। এই পর্বের শুরুতে ক্যান্টন বাণিজ্যে পর্তুগীজদের একাধিপত্য ছিল। তারা ক্যান্টনের দক্ষিণে ম্যাকাও-এ থেকে বাণিজ্য করত। এখানে অন্য রাষ্ট্রের বণিক ও জাহাজ ঢুকতে দেওয়া হত না। উদ্যমী ইংরেজ বণিকরা তাই এখানে বাধা পেয়ে ফরমোজা, অ্যাময় ও নিংপো বন্দরে বাণিজ্য করতে বাধ্য হয়।
১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন ওয়েজ্জেলের উদ্যোগে প্রথম ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ ক্যান্টনে ঢোকে। কিন্তু নিয়মিত বাণিজ্যিক আদান প্রদান শুরু হয়েছিল আরও পরে। বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে ক্যান্টন বন্দরের আলাদা গুরুত্ব ছিল, কারণ একদিকে এই বন্দর যেমন পুরনো বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল তেমনি অন্যদিকে এই বন্দর ছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার খুব কাছে। এর ফলে ক্যান্টন বাণিজ্যকেন্দ্র রূপে আলাদা মাত্রা পায়।
পুরনো এবং ঐতিহ্যপূর্ণ হলেও ক্যান্টন বন্দর ছিল দুর্নীতিপূর্ণ। ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম বাণিজ্য জাহাজ স্থানীয় শুল্ক অধিকর্তা (হপ্পো)-র অন্যায় শোষণের শিকার হয়। উচ্চ শুল্ক ছাড়াও, পর্তুগীজদের বিরোধিতা এবং ব্রিটিশ পশমজাত সামগ্রীর স্বল্প চাহিদা ইংরেজদের ক্যান্টন ছেড়ে নিংপোর সন্নিকটে টিং-হাই (Tinghai)-এ বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপনে বাধ্য করে।
নিংপোতেও চীনা আধিকারিকদের হস্তক্ষেপ, অযৌক্তিক শুল্ক এবং পশম বস্ত্রের মৃদু চাহিদা ইংরেজ বণিকদের ক্যান্টনের প্রতি পুনরায় আগ্রহী করে তোলে। ফলে ১৬৯৯ সালে ইংরেজরা ক্যান্টনে একটি ফ্যাক্টরি স্থাপন করে এবং ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে সেখানে নিয়মিত চা ও সিল্কের ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু বণিকদের উপর খেয়াল খুশীমত শুল্ক চাপানোর ফলে এবং ক্যান্টনে চা ও রেশমের উচ্চমূল্যর জন্য ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিংপোতে FGব্যবসা স্থানান্তরিত করতে প্রয়াসী হয়। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ বিদেশী জাহাজগুলিকে উত্তর দক্ষিণ সব বন্দরে সমানভাবে ব্যবসায় সুযোগ সুবিধা প্রদানের বিরোধী ছিল। কারণ তাতে সব জাহাজের উপর যেমন সজাগ দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব নয় তেমনি বৈদেশিক বাণিজ্যও চীনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশী বাণিকদের তাই উত্তরাভিমুখে যাওয়া থেকে বিরত রাখা হয়।
সরকারিভাবে নিংপো, অ্যাময় ও সাংহাইতে বাণিজ্য নিষিদ্ধ না হলেও ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর ক্যান্টনই ছিল একমাত্র বন্দর যা বিদেশী বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত ছিল। আইনগত ভাবে না হলেও কার্যত উত্তরে বাণিজ্য নিষিদ্ধ ছিল। এসব সত্ত্বেও ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে জেমস্ ফ্লিন্ট (James Flint) নামক চীনা ভাষায় শিক্ষিত এক ইংরেজ বণিক আবগারী প্রথা অমান্য করে নিংপোতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হন। তিনি তিয়েত্তসিনে গিয়ে ক্যান্টন কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। তার ঔদ্ধত্যের জন্য তিনি ম্যাকাওতে তিন বছরের কারাদন্ডের সাজা পান। এই ঘটনার পর ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে আদালতের এক নিদের্শনামায় ক্যান্টন বন্দরকেই একমাত্র বিদেশী বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এইভাবে ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার (Canton System) উদ্ভব ঘটে। এক বন্দর কেন্দ্রিক ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে নানাকিং-এর সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়া পর্যন্ত বহাল ছিল।
গঠনগত দিক থেকে ক্যান্টন বাণিজ্য ছিল ব্রিটিশ বাণিজ্য কেন্দ্রিক। ক্যান্টন বাণিজ্যে ব্রিটিশ একাধিপত্যের কারণ ছিল সেই দেশের শিল্পবিপ্লব জাত পণ্যসামগ্রীর এবং ভারতীয় পণ্যসামগ্রীর প্রাধান্য। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী পরিচালিত ব্রিটিশ বাণিজ্য ছিল ব্যক্তিগত মালিকানা ভিত্তিক বাণিজ্য বা Private trade । যেহেতু ক্যান্টন বাণিজ্য ছিল বিদেশী ও চীনা নাগরিকদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য, সুতরাং এর জন্য চীনের সঙ্গে কোন আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল না। তাই চীনা রাজকর্মচারীদের বিদেশী বণিকদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ অনুমোদিত ছিল না। ক্যান্টন বাণিজ্যের জন্য বিদেশী বণিকদের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার প্রাপ্ত চীনা বণিকগোষ্ঠীর মাধ্যমে গভর্নর জেনারেল, গভর্নর অথবা ক্যান্টনের শুল্ক অধিকর্তা Hoppo-র কাছে আবেদন করতে হত। ক্যান্টনে বিদেশী বণিকেরা সরাসরি ও স্বাধীনভাবে বাণিজ্য করতে পারত না।
কো হং (Co Hong) নামক চীনা বাণিজ্যিক সংস্থার মাধ্যমে তাদের বাণিজ্য করতে হত। ক্যান্টনে বৈদেশিক বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার তাদের হাতেই ছিল। কো-হং-এর সদস্যরা হং বণিক নামে পরিচিত ছিল। বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর একচেটিয়া অধিকার প্রাপ্ত হং বণিকরা ১৩টি কোম্পানী বা ফার্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই হং বণিকরা আদালতে বিপুল অর্থ প্রদানের বিনিময়ে বিদেশী বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার পায়। তারা তাদের কাজের জন্য লিয়াংগুয়াং-এর গভর্নর জেনারেল এবং ক্যান্টনের শুল্ক অধিকর্তা (Custom Superintendent)-র কাছে দায়িত্বশীল থাকত।
হং বণিকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছিল— যারা ইউরোপীয় ও মার্কিন বাণিজ্যে বিশেষজ্ঞ ছিল তারা Wai-yang নামে পরিচিত ছিল। যারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে বিশেষজ্ঞ ছিল তারা Peng-Kang hang নামে এবং যারা ফুকিয়েন চাওচউ-এ বাণিজ্য করত তারা Chao-Fuhang নামে পরিচিত ছিল। ক্যান্টন শহর-প্রাচীরের বাইরে পার্ল নদীর তীরে ১৩টি বিদেশী বাণিজ্য সংস্থা বা ফ্যাক্টরির সঙ্গে যুক্ত ছিল এই হং বণিকরা। চীনারা এই বাণিজ্য ঘাঁটিগুলিকে বর্বরদের গৃহ বা I Kuan আখ্যা দিত।