StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

গুপ্ত যুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সম্পর্কে আলোচনা কর

গুপ্ত যুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সম্পর্কে আলোচনা কর

গুপ্ত যুগের স্থাপত্য


ভূমিকা:

গুপ্তযুগে ভারতীয় শিল্পী সমাজ ভাস্কর্যে ও চিত্রশিল্পের মত স্থাপত্যেও বিশেষভাবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এই স্থাপত্যকলা শুধুমাত্র এযুগের মন্দির শিল্পের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেয়েছিল তা নয়, শিল্পকর্ম হিসেবেও এগুলির মূল্য অপরিসীম। গুপ্তযুগেই আমরা সর্বপ্রথম ভারতীয় ধ্যান-ধারণার উপযোগী স্বনির্ভর স্থাপত্যকলার প্রকাশ লক্ষ্য করি।

মন্দির স্থাপত্য-গুপ্ত যুগ

গুপ্ত-পূর্ববর্তী যুগের স্থাপত্যকলা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্বতের গুহাগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এযুগের মন্দির নির্মাণের পদ্ধতির সঙ্গে ধর্মীয় জীবন-দর্শনের একটা গভীর যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়। কারণ মন্দিরগুলির প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল উপাসনা গৃহের মধ্যে শাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী দেবমূর্তির প্রতিষ্ঠা। গুপ্ত আমলের প্রাচুর্য্যের দিনে মানুষের মনের প্রসারতাও ছিল অনেক বেশি, কাজেই মন্দিরগুলির পূর্ণতা বিকাশের সবকটি দিকই সেযুগে প্রকাশ পায়। এজন্য শিল্পকলায় হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মের ভিত্তিতে যেমন কোনো প্রকারভেদ করা যায় না, তেমনি মন্দিরগুলির মধ্যেও পার্থক্য করা খুব কঠিন।

গুপ্ত মন্দির স্থাপত্যগুলির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য সর্বপ্রথম ইঁট ও পাথরের মত স্থায়ী উপাদানের ব্যবহারের প্রচলন। সমসাময়িক লেখমালায় গুপ্তযুগের নির্মিত বহু মন্দিরের সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যায়। গুপ্ত-মন্দিরগুলির ভগ্নাংশের বেশ কিছু পাওয়া গেছে। এগুলি স্থাপত্যশৈলী ও পরিকল্পনার দিকে লক্ষ্য রেখে গুপ্ত আমলে নির্মিত মন্দিরগুলিকে কয়েকটি নির্দিষ্ট শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।

প্রথম শ্রেণির মন্দির

গুপ্তযুগের প্রথম বা প্রাচীনতম মন্দিরগুলির স্থাপত্যশৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য বর্গাকৃতি মন্দির, ছাদ শিখরবিহীন এবং মন্দিরের সামনে একটি খোলা বারান্দা। একে ভিত্তি করে নানাবিধ পরিবর্তন ঘটেছিল। এই ধরনের মন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দিরটি ছিল সাঁচীতে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে নির্মিত ‘সপ্তদশ সংখ্যক মন্দির। মন্দিরটির আকার ছোট চতুষ্কোণ এবং এর মাথায় কোনো ‘শিখর’ বা চূড়া নেই। ভিতরে চতুষ্কোণ ‘গর্ভগৃহ’ অথবা দেব-বিগ্রহের স্থান—সামনে চারটি স্তম্ভযুক্ত ছোটো মণ্ডপ। স্তম্ভগুলি ছাদকে ধরে রাখে এবং স্তম্ভগুলির মাথায় বসা সিংহমূর্তি এবং মন্ডপের সামনে তিন দিক ঘিরে দু’ধাপের সিঁড়ি।

দেওয়ালগুলির অলংকারহীনতাই হল এর প্রাচীনত্বের একটি নিদর্শন। অতি সাধারণ এই মন্দিরটি বহু গুপ্ত মন্দিরের মূল আদর্শ। সেকালের এই শ্রেণির মন্দিরের মধ্যে জব্বলপুরের তিগয়ার বিষ্ণুমন্দির এবং গোয়ালিয়রের নিকটবর্তী মহাবরাহ মন্দির এবং এরানের বিষ্ণুমন্দির খুবই প্রসিদ্ধ। পন্ডিতদের অনুমান সাঁচীর মন্দিরটি খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে এবং তিগয়ার মন্দিরটি খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমার্ধে নির্মিত হয়েছিল। পার্সি ব্রাউন বলেছেন— ‘They reflect the sudden glory which comes with a fresh inscription’ 

দ্বিতীয় শ্রেণির মন্দির

গুপ্তযুগের দ্বিতীয় শ্রেণির মন্দিরগুলির স্থাপত্যশৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য বর্গাকৃতি মন্দির, ছাদ শিখরবিহীন, ‘গর্ভগৃহ’-র চারিদিকে ঢাকা ‘প্রদক্ষিণ পথ’ ও সামনে ‘মণ্ডপ’, যা কখনো দ্বিতলযুক্ত। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের গোড়াতেই সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে একেবারে মন্ডপে আসা যায়। প্রদক্ষিণ  পথের বাইরের দিকে দেওয়ালের মাঝখানে প্রবেশের পথ ছাড়া অন্য তিন দিকে ভেতরে আলো প্রবেশ করার জন্য ‘গবাক্ষ’ বা জানালার প্রচলন ছিল। এই শ্রেণির মন্দিরগুলির অন্তর্ভুক্ত জব্বলপুরের কাছে ভূমরার কাছে নাচনার পার্বতী মন্দির, আইহোলির শিবমন্দির (লাদখান মন্দির)। উত্তর-বাংলার দিনাজপুরের বৈগ্রামের মন্দিরটি ছাড়াও চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপার খনা-মিহিরের ঢিবিতে আবিষ্কৃত অপেক্ষাকৃত পরবর্তী যুগের মন্দিরেও এই ধরনের ছোটো মন্দির রয়েছে। ভূমরার শিব মন্দিরের প্রবেশদ্বারের দু’ধারে দুটি ছোটো, ছোটো মন্দির আছে।

গুপ্তযুগের মন্দির স্থাপত্যের এও একটি রীতি। ভূমরার মত মন্দিরের সঙ্গে লাগানো ছোটো মন্দির নালন্দাতেও পাওয়া গেছে। ভূমরার মন্দিরের সাঙ্গ ভিতরগাঁও-এর মন্দিরের মিল পাওয়া যায়। ভূমরার মন্দিরে গর্ভগৃহ ও মন্ডপের মধ্যে সরাসরি সংযোজন স্থাপনের ফলে বেঞ্জামিন রোল্যান্ডের মতে – “The form of Hindu and Buddhist temple of Gupta period was completely evolved.’। নাচনার পার্বতী মন্দির এবং আইহোলির দূর্গা মন্দিরের গর্ভগৃহের উপর একটি দ্বিতীয় কক্ষ আছে। বড় বড় পাথরের টালিকে একের উপরে এক আংশিকভাবে সাজিয়ে এই সব মন্দিরের ছাদগুলি তৈরি করা হয়। গুপ্তযুগের এই শ্রেণির মন্দিরগুলি পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হয় বলে মনে করা হয়।

তৃতীয় শ্রেণির মন্দির

গুপ্তযুগের তৃতীয় শ্রেণির মন্দিরগুলিতে নীচু শিখরের বা চূড়ার আবির্ভাব একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে উল্লিখিত হয়। কেউ কেউ মনে করেন, মন্দিরের ভিতরের গর্ভগৃহ বা দেবস্থানটিকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার জন্য এই শিখর স্থাপত্যের উদ্ভব। কেউ কেউ আবার বলেন, বিষ্ণুর মাথার ‘কীরিট’ বা ‘মুকুট’-র অনুকরণেই মন্দির-শিখরগুলি নির্মিত হয়। তবে সাধারণভাবে মনে হয়, উপাসক কর্তৃক আপন আরাধ্য দেবতার অধিষ্ঠানটিকে মহিমামন্ডিত করার জন্যই শিখরে সংযোজন করা হয়েছিল। প্রথমদিককার শিখর মন্দিরগুলির মধ্যে দেওগড়ের পাথরের তৈরি দশাবতার মন্দির ও কানপুরের ভিতরগাঁওয়ের ইটের মন্দির উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও নাচনার মহাদেব মন্দির, পাথরিতে একটি মন্দির এবং বোধগয়ার ‘মহাবোধি মন্দির টি এই শ্রেণিভুক্ত।

দেওগড়ের মন্দির

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে দেওগড়ের মন্দিরটি নির্মিত হয়। মন্দিরটি একটি প্রকান্ড ‘বেদী’-র উপর নির্মিত এবং এর ধারগুলিতে রামায়নের কাহিনী সুন্দরভাবে খোদাই করা। এর চারিদিকে মন্দিরে ওঠার জন্য সিঁড়ি দেখতে পাওয়া যায়। এখানে একটি প্রাচীন ধরনের ‘শিখর’ লক্ষ্য করা যায়। এর উচ্চতা সম্ভবত ছিল ৫০ ফুট। মন্দিরটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য চারিদিকে চারটি আচ্ছাদিত ‘মণ্ডপ’। মন্দিরটি গুপ্তযুগের অন্যান্য মন্দিরের মত পরস্পর নিকটবর্তী দুটি স্তম্ভে ভার রেখে দন্ডায়মান ছিল। এর চারদিকের দেওয়াল অতুলনীয় গুপ্তভাস্কর্যে সজ্জিত। প্রাচীরের উপরের দিকে কীর্তিমুখ, লতা-পাতার কেয়ারী ও মন্দিরের দেওয়ালে লাগানো কয়েকটি সুসজ্জিত স্তম্ভ। এই মন্দিরের ভাস্কর্যগুলির মধ্যে অনন্তশায়ী বিষ্ণু ও গজউদ্ধারের পৌরাণিক কাহিনী শোভা ও সৌন্দর্য্যে অতুলনীয়।

ভিতরগাঁওয়ের মন্দির

ভিতরগাঁওয়ের মন্দিরটি ইঁটের নির্মিত সর্বপ্রাচীন মন্দির। এই মন্দিরটি চতুষ্কোণ এবং তিনদিকের মধ্যভাগ মূল মন্দির থেকে সামান্য এগিয়ে আছে। বাইরের দেওয়ালগুলি পোড়ামাটির চতুষ্কোণ টালির উপর অপূর্ব ভাস্কর্যশোভিত। মন্দিরটি ধাপে ধাপে উঠে গেছে। এতে সারি সারি চৈত্য-গবাক্ষের মত কুলুঙ্গির অলঙ্করণ রয়েছে। এই কুলুঙ্গিগুলি আবার নানাধরনের মূর্তি দিয়ে সাজানো। মন্দিরের ভিতরে একটি চতুষ্কোণ গর্ভগৃহ ও মন্ডপ এবং এর ছাদটি অর্ধ-গোলাকার। ভিতরগাঁও মন্দিরের পোড়ামাটির ভাস্কর্যগুলি নির্মাণকৌশলে ও সৌন্দর্য্যে অনুপম।

বুদ্ধগয়ার মন্দির

বুদ্ধগয়ার মন্দিরটির যে পরিপূর্ণ রূপ আমরা বর্তমানে দেখি তা সম্ভবত খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বিকশিত হয়েছিল। মন্দিরের উঁচু বেদী, চতুষ্কোণ নক্সা, অতি সুন্দর গঠনকার্য, মধ্যবর্তী শিখরের অপূর্ব শোভা, শিখরের গায়ে চৈত্য-গবাক্ষের অলঙ্করণ এবং স্তম্ভের সারি প্রভৃতির কারণে এটিকে গুপ্তযুগের মন্দিরের নিকটতম শিল্পকীর্তি বলে চিহ্নিত করা হয়। উঁচু ভিতের উপর শিখরযুক্ত এই মন্দিরটির মোট উচ্চতা ৭০ ফুট।

চতুর্থ শ্রেণির মন্দির গুপ্তযুগে চতুর্থ শ্রেণির মন্দিরগুলি আয়তাকার ও পিছনদিকটি অর্ধ-বৃত্তাকার এবং শিখর চুড়াকৃতি যুক্ত। বুদ্ধ চৈত্যগৃহের স্থাপত্যশৈলী এতে গ্রহণ করা হয়েছে। এই ধরনের মন্দিরের অনন্য স্থাপত্যকীর্তি শোলাপুর শহরের কাছে তের নামক স্থানের ত্রিবিক্রম মন্দির এবং তঅন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার চেজরালায় কপোতেশ্বর মন্দির। এগুলিকে ভারতীয় গুহা-স্থাপত্যের সুপরিচিত চৈত্যগৃহের ইঁটের তৈরি অনুকরণ বলা যায়। চৈত্যগৃহের মতই মন্দির দুটির পিছনের দিক গোল হয়ে ঘুরে এসেছে। ছাদটিও চৈত্যগৃহের মত অর্ধ-গোলাকার। মন্দির দু’টি চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে নির্মিত। প্রাচীন তক্ষশীলায় ও সাঁচীতে এইরূপ মন্দিরের অনেক ভাঙা ভিত দেখতে পাওয়া যায়।

আইহোলির দুর্গামন্দির 

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত আইহোলির দুর্গামন্দিরটি গুপ্তযুগের চতুর্থ শ্রেণির মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। মন্দিরটির ভিত্তি সংস্থান চৈত্যগৃহের মত। এর গর্ভগৃহের পিছন দিকটি অর্ধ-গোলাকার। গর্ভগৃহের সামনে একটি মন্ডপ, মন্ডপের ছাদটি দু’সারি থামের উপর ভর করে আছে। এই মন্ডপ থেকে বেরিয়ে রয়েছে আরেকটি ছোটো মন্ডপ। সিঁড়ি দিয়ে মন্দির থেকে মাটিতে নামার পথ। মন্দিরের সামনের দিকের ছাদটি সমতল। শুধু গর্ভগৃহের উপরে একটি শিখর ক্রমশ ছোটো হয়ে উপরে উঠে গেছে। শিখরে চৈত্য-গবাক্ষের সারি। মাঝে মাঝে ধারের দিকে পদ্মফুলের পাঁপড়ির কাজ করা ‘আমলক শিলা’। শিখরটির উপরের অংশ ভেঙে গেলেও গুপ্ত-পরবর্তী স্থাপত্যকলার উপর এর গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

স্তূপের ন্যায় মন্দির

গুপ্তযুগে বৌদ্ধস্তূপের পরিকল্পনায় নির্মিত গোলাকার বা বৃত্তাকৃতি মন্দির কম, কিন্তু অপ্রচলিত ছিল না। রাজগীরে (বিহার) ‘মনিয়ার মঠ’ নামে পরিচিত একটি বিখ্যাত ইঁটের গোলাকার মন্দির আছে। এর চারদিকে কিছু কিছু অংশ মূল মন্দিরের গা থেকে বের হয়ে এসেছে। এই মন্দিরের গোলাকার ভিত সংস্থানের সঙ্গে স্তূপ স্থাপত্যের একটি সম্পর্ক পন্ডিতরা চিহ্নিত করেছেন।

স্তূপ স্থাপত্য-গুপ্তযুগ

মন্দিরের মত বহু স্তূপও গুপ্তযুগে নির্মিত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে সারনাথের ‘ধামেকা স্তূপ’ সাধারণের কাছে খুবই পরিচিত। স্তূপটি পূর্বে ১৫০ ফুট উঁচু ছিল, ব্যাস ছিল ১০০ ফুটের কিছু কম। এটি তিনটি স্তরে বা ধাপে উপরে উঠে গেছে। এর মাঝখান বা দ্বিতীয় স্তরটি সম্পূর্ণ পাথর দিয়ে ‘ধামেক’ স্তূপটির গঠন প্রাচীন স্তূপের মত অর্ধ-গোলাকার নয়। সবার উপরের অংশ ও নীচের ভিত ইঁট দিয়ে নির্মিত। এর পাথরের তৈরি মধ্যভাগটির আটটি স্থান একটু একটু করে ক্রমশ উপরের দিকে ছুঁচালো হয়ে উঠে গিয়েছে এবং এর দেওয়ালগুলি মূল স্তূপের গা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এগুলির মধ্যে আটটি কুলুঙ্গি, সম্ভবত এগুলি দেবমূর্তি দিয়ে শোভিত ছিল। একটি সুন্দর লতা-পাতার কেয়ারী ও সরলরেখায় জ্যামিতিক অলঙ্করণ স্তূপটিকে ঘিরে ছিল। এই অলঙ্করণ মাঝে মাঝে সামান্য টিকে আছে, যা পূর্ব গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে।

ধামেক স্তূপ ছাড়াও গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রথম দিকে সুদূর সিন্ধুদেশে মীরপুরখাদের স্তূপটি নির্মিত হয়। এর বিশেষত্ব হল, একটি চৌকো ধরনের ভিতের উপর এটি রচিত হয়। পশ্চিম দিকের মাঝখানে প্রবেশদ্বার সমেত তিনটি দেবগৃহ এখানে পাওয়া যায়। এইদিক থেকে মীরখাসপুরের স্তূপটিকে স্তূপ ও মন্দিরের মিশ্রণ বলে ধরা যায়। এখানকার পোড়ামাটির বুদ্ধমূর্তিটি উল্লেখ্য। গুজরাটের দেখিমোরি নামক স্থানেও একটি কারুকার্য সমন্বিত স্তূপ সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে।

গুহা-স্থাপত্য (গুহা-মন্দির)

গুপ্তযুগে প্রাচীন ভারতীয় রীতি অনুযায়ী পাহাড়ের গা কেটে মন্দির (চৈতা) ও মঠ (বিহার) নির্মাণের রীতি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এযুগের এরকম মন্দির (চৈত্য) মধ্যভারতের উদয়গিরি, দক্ষিণ-পশ্চিমে অজন্তা গুপ্ত ও বাকাটক বংশীয় রাজাদের কীর্তির নিদর্শন।

ভাস্কর্যের দিক থেকে উদয়গিরি ও ভীলসার স্থান অনেক উর্ধে। কিন্তু পাহাড়ের গা কেটে গুহা-স্থাপত্যের বিচারে এগুলি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কারণ এখানে স্থাপত্য কর্মে পাহাড়কে মোটামুটিভাবে কাজে লাগানো হয়েছে মাত্র। সম্পূর্ণ গুহা-স্থাপত্য অথবা নিজভিত্তির উপর দাঁড়ানো স্বতন্ত্র স্থাপত্য—এগুলির কোনোটিই নয়।

গুপ্তযুগের নির্মিত পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগের এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর চৈত্য ও বিহারগুলির সৌন্দর্য্য মনোমুগ্ধকর। স্থাপত্য পরিকল্পনা, ভাস্কর্য-চেতনা ও অলঙ্করণ রচনায় এগুলি সর্বকালের বিচারে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।


গুপ্ত-স্থাপত্য শিল্প— মূল্যায়ন : 

“গুপ্তযুগের অবসানের পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত নতুন নতুন স্থাপত্য রীতির উদ্ভব ঘটে। কিন্তু এইসব স্থাপত্য রীতিগুলির কোনোটিই গুপ্তশিল্পের প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। প্রসঙ্গত গুপ্তযুগের স্থাপত্যেই নাগর ও দ্রাবিড়শৈলীর সূচনা হয়েছিল। নাগরশৈলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর মন্দিরের ভিত পরিকল্পনা ক্রুশ আকার বিশিষ্ট এবং রেখ ধরনের শিখর। এইরূপ মন্দিরের উদাহরণ হিসেবে দেওগড়ের দশাবতার মন্দির এবং ভিতরগাঁওয়ের ইঁটের মন্দিরের উল্লেখ করা যায়। দ্রাবিড়শৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য হল মন্দিরের ছাদ ক্রম-হ্রাসমান পিড়ি বা থাকের উপুর্যপুরি বিন্যাসের উপর নির্মিত। এক্ষেত্রে মন্দিরের গর্ভগৃহের উপরের তলায় ক্রমশ সংকীর্ণ মন্দিরের আভাস পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে নাচনার পাবর্তী মন্দির ও আইহোলির দূর্গামন্দিরের উল্লেখ করা যায়। ভারতীয় শিল্প-বিশেষজ্ঞ সরসীকুমার সরস্বতীর মতে, গুপ্ত ও সমকালীন যুগে যে নাগর ও দ্রাবিড়শৈলীর বিকাশ ঘটেছিল তা পরবর্তীকালে মধ্যযুগের স্থাপত্যশিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখানেই ভারতের ইতিহাসে গুপ্ত-স্থাপত্যের প্রধান তাৎপর্য নিহিত আছে।

গুপ্ত যুগের ভাস্কর্য শিল্প

ভূমিকা:

গুপ্ত শিল্পের আলোচনা প্রসঙ্গে দেশব্যাপী এর অখণ্ডতা লক্ষ্য করা যায়। এই শিল্পনিদর্শনগুলি উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে একই ধরনের। ‘সিংহক’ (সিংহের মত কোমর), ‘গোমুক’ আকার (গরুরমুখের মত) দেহকান্ড, ‘পদ্মপলাশ’ (পদ্ম ফুলের পাঁপড়ির মত’ চোখ, চিরনবীন পুরুষ মূর্তি ও অতি সুন্দর ‘ডমরু-মধ্য’ (ডমরুর মধ্যভাগের মত) নারীমূর্তি, এইযুগের বৈশিষ্ট্য। শিল্পশাস্ত্রের আদর্শ ও মূর্তির গঠন-নৈপুণ্যের সফল মিলন ঘটায় এই শিল্পধারা কালজয়ী হতে পেরেছে। এই শিল্পধারা একদিনে বা কয়েক বছরের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এর ক্রমবিকাশ ঘটেছে ধীরে ধীরে। ক্রমোন্নতির ধারাটিকে অনুসরণ করলে দেখা যায় যে, মথুরা ও সারনাথ ছিল এই শিল্পের প্রধান দুটি কেন্দ্র। এছাড়াও উদয়গিরি, ভিলসা, এরান, দেওগড় ও দশপুরকে কেন্দ্র করে কতগুলি অপ্রধান শিল্পকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।

মথুরা বুদ্ধমূর্তি—গুপ্তযুগ

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকেই মথুরার মূর্তি নির্মাণে একটি বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মথুরায় সিক্রির ছোপযুক্ত লাল বেলেপাথরে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব মূর্তি নির্মিত হয়।

সারনাথ বুদ্ধমূর্তি—গুপ্তযুগ

যমুনা তীরবর্তী মথুরার পাশাপাশি গঙ্গা-তীরবর্তী সারনাথ গুপ্ত শিল্পকলার আরেকটি অন্যতম কেন্দ্র ছিল। মথুরার ভাস্কর্য তার আদিম যুগের ভাবধারা অনুযায়ী কিছুটা স্থূলতা ও গাম্ভীর্যে পরিণত হলেও সারনাথের গুপ্ত ভাস্কর্যে একটি কমনীয় মাধুর্যমন্ডিত রূপ ফুটে ওঠে। চুনারের বেলেপাথরে তৈরি সারনাথের বুদ্ধমূর্তিতে বৈদেশিক প্রভাব একেবারেই অনুপস্থিত। সারনাথে কেবল যে বুদ্ধমূর্তি তৈরি হত তা নয়, বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনাও উৎকীর্ণ করা হয়। আদর্শ শিল্পের দিক থেকে বিচার করলে এগুলি সর্বাঙ্গ সুন্দর ও নিখুঁত বলা চলে।

সারনাথেই সর্বপ্রথম বুদ্ধ ‘ধর্মচক্রপ্রবর্তন’ বা ধর্মপ্রচার করেন। এই ঘটনাটির ব্যাখ্যা প্রদানকারী সারনাথের মূর্তিগুলির মধ্যে ‘ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রা’-য় যোগাসনে বসা বুদ্ধমূর্তিটি জগৎ বিখ্যাত। বুদ্ধের মুখশ্রী এখানে ডিম্বাকার, চোখ দু’টি আরও স্তিমিত, চোখের পাতা পুর্ণাঙ্গ ও পেলব। প্রতিটি অঙ্গের সৌন্দর্য যেন সাবলীলভাবে একে অন্যতে লীন হয়ে একটি প্রাণময় সজীবতার প্রকাশ ঘটায়। বুদ্ধের হাতের মুদ্রায় কঠিন তপস্যার পর তাঁর ধর্মপ্রচারের কথা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বুদ্ধের মাথার চারদিকে এখানেও প্রভামন্ডল আছে। তবে এর কেন্দ্রে গোল ক্ষেত্রটি থাকায় মূর্তিখানিরশান্ত সমাহিত ভাব বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। প্রভামন্ডলের উপরের অংশে অতি পরিচ্ছন্ন ফুল-লতার অলঙ্করণের দু’পাশে দু’টি গন্ধর্ব মূর্তি। সিংহাসনের নীচে মাঝে ধর্মচক্র রেখে শিষ্যরা উপাসনারত। বুদ্ধের মহিমা ও বিরাটত্ব বোঝানোর জন্য এখানে শিষ্যদের ছোটো করে রচনা করা হয়েছে।

নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায়, এটি হল — a supra sensous extramundane soaring elegance.’1গোল ক্ষেত্রটি থাকায় মূর্তিখানির সারনাথ বুদ্ধমূর্তি সারনাথের প্রতিটি মূর্তিই সুন্দর ও লাবণ্যে পূর্ণ। ‘অভয় মুদ্রায় শোভিত সামান্য কৃশ বুদ্ধমূর্তিগুলির পায়ের দিকে এমন একটি ভাব আছে যা থেকে মনে হয়, তিনি যেন ভক্তকে আশ্বাস দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন। রেনি গ্লাউসেটের ভাষায়—’an art so inspired by intellectualism as to be direct expression of soul through the purely ideal beauty of form.’1

গুপ্তযুগের ধাতু ভাস্কর্য—পাটালিপুত্র ও অন্যান্য

গুপ্তযুগে প্রাচ্য ভারতের বুদ্ধমূর্তিতে একদিকে ফুটে ওঠে সারনাথের আধ্যাত্মিক সূক্ষ্মানুভূতি, অন্যদিকে যুক্ত হয় আবেগের উষ্ণতা ও ইন্দ্রিয়ের আবেদন। এইরূপ মূর্তির কয়েকটি উদাহরণ হল—ভাগলপুরের কাছে সুলতানপুরে প্রাপ্ত (খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে নির্মিত) বর্তমান বার্মিংহাম যাদুঘরে রক্ষিত তাম্রনির্মিত বিশালাকার বুদ্ধমূর্তি এবং নালন্দায় প্রাপ্ত ও নালন্দার মিউজিয়ামে রক্ষিত বিশালাকার ধাতুনির্মিত বুদ্ধমূর্তি। এই মূর্তি দুটিতে কাপড়ের ভাঁজে মথুরার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ভাগলপুরের মূর্তিটির ভাব শান্ত ও সমাহিত। বুদ্ধের দেহের সাথে তাঁর ‘সংঘাতি’ (বৌদ্ধ সাধুদের বস্ত্র) লেগে আছে এবং সংঘাতি’র ভিতর তাঁর সম্পূর্ণ শরীর দেখা যাচ্ছে।

শিল্পী সংঘাতি’র নীচের দিকে সামান্য বাঁকানো রেখার দ্বারা ভাঁজ দেখিয়ে এর কোমলতা ফুটিয়ে তুলেছেন। বুদ্ধ পা’দুটি পাদপীঠের উপর লঘুভাবে ন্যস্ত করে মধুর ভঙ্গিতে দন্ডায়মান। গান্ধার ও সারনাথের দন্ডায়মান বুদ্ধমুর্তির সঙ্গে এর দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায় পার্থক্য ফুটে ওঠে। সুদূর গুজরাটে গুপ্ত-সমকালীন আরও অনেক ব্রোঞ্জের তৈরি মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলি বরোদা শহরের পশ্চিমে আকোটা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর জৈন মহাপুরুষ (জীবন্ত স্বামী)-র মূর্তিটির গঠনশৈলী ও মুখাকৃতি সম্পূর্ণরূপে গুপ্তযুগের শিল্পধারার অনুগামী এবং গুপ্ত প্রস্তর মূর্তির সাথে এর সাদৃশ্য বর্তমান। মুখমন্ডলের পুরন্ত গড়ন, প্রসারিত চোখ, পুরু ঠোঁট, কাঁধের উপর কোকড়ানো কেশগুচ্ছ, গলায় ত্রিবলী রেখা, মাথার চূড়া—সবই গুপ্তযুগের প্রস্তর মূর্তির মত।

চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগে গুর্জর দেশ গুপ্ত শাসনাধীন থাকায় আকোটার এই ধাতু মূর্তিটির সাথে পশ্চিম দেশীয় ভাস্কর্য রীতির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সিন্ধু দেশের মীরপুরখাস অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত এবং বর্তমানে করাচি সংগ্রহশালায় রক্ষিত ব্রহ্মার মূর্তিটি তাঁর কমনীয় মুখের ডৌল ও পরিচ্ছদ পরিধানের রীতিতে গুপ্ত ভারতের পূর্বাংশে নির্মিত শিল্পশৈলীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’-র সংগ্রহশালায় ‘মঞ্জুশ্রী’ নামে জ্ঞান ও বিদ্যার এক বৌদ্ধ দেবতার অতিসুন্দর ব্রোঞ্জের উপর সোনার জলে ঢাকা অপূর্ব একটি মূর্তি রয়েছে। শিল্পরীতিতে কিছুটা পরবর্তী হলেও এর সৌন্দর্য সুলতানগঞ্জের বৃদ্ধের অনুরূপ।

মালব ও ভীলসা রাজপুতানার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত মালব দেশ ও বর্তমান ভীলসা (পূর্বে বিদিশা নগরী), বেসনগর গুপ্তযুগের শিল্পনিদর্শনের জন্য বিখ্যাত। গোয়ালিয়র যাদুঘরে এই অঞ্চল দুটির বহু শিল্প নিদর্শন রক্ষিত আছে। এগুলির মধ্যে গন্ধর্ব দম্পতির মূর্তিটি খুবই প্রাসঙ্গিক। এর রূপায়নে শিল্পী অভূতপূর্ব রসবোধের পরিচয় দিয়েছেন। মানুষের দেহের ভঙ্গিমাকে নিজের শিল্প প্রতিভায় জীবন্ত করে তুলে শিল্পী পাথরের মূর্তিতে বাধাহীন আকাশবিহারের ভাবটি মূর্ত করে তুলেছেন। এখানে গন্ধর্ব দম্পতির পায়ের সংস্থান ও গন্ধর্ব বধূর বাতাসে ফুলে ওঠা গায়ের বস্ত্রখন্ডের ভাঁজগুলিতে একটি অতি সহজ ও স্বচ্ছন্দ গতিবেগ ফুটে উঠেছে। এই অঞ্চলের শিল্পকলার মধ্যে বেসনগর থেকে প্রাপ্ত মকরবাহিনী গঙ্গা মূর্তিটিও উল্লেখ্য। এখনে গঙ্গা দেবী কমনীয় ভঙ্গীতে মকরের উপর দন্ডায়মান। মূর্তিটির উপরের দিকে ফল, পাতায় শোভিত গাছের চিত্র এবং নীচের অংশে মকরের পুচ্ছ ও আলঙ্কারিক জলরাশি গভীরভাবে খোদাই করে শিল্পী এমন একটি সুষমতার আভাস দিয়েছেন, যা অতুলনীয়। মূর্তিটির অঙ্গের সৌষ্ঠব অলঙ্করণের প্রাচুর্যে চাপা পড়ে যায় নি। বেসনগর থেকেই একটি নরসিংহ মূর্তি পাওয়া গেছে, যা পন্ডিতমহলে গুপ্তযুগের শিল্পকীর্তি হিসেবে খুব খ্যাতি লাভ করেছে। রাজস্থানের যোধপুরের কাছে মান্দোরে কৃষ্ণলীলার বিভিন্ন দৃশ্য—যেমন গিরি-গোবর্ধন ধারন ভাস্কর্যে রূপ দান করা হয়েছে।

ভীলসার উদয়গিরির আদি-বরাহ মূর্তিটি পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে। এখানে বরাহরূপী বিষ্ণু অনন্ত জলধি থেকে  পৃথিবীকে উদ্ধার করছেন। পাহাড়ের গায়ে এক বিরাট অংশ খোদাই করে বরাহরূপী বিষ্ণুর এই বীরত্বব্যঞ্জক মুর্তিটি রচিত। বিষ্ণুর ডান পা টি নীচু ও বাঁ পা টি একটু উঁচুতে রয়েছে। তিনি ডান হাতটি কোমরে ও বা হাতটি হাঁটুর উপরে রেখে দৃপ্ত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়ানোর এই বাঁকা ভঙ্গীটিতে বরাহদেবের শরীরের অন্তর্নিহিত শক্তির ভাবটি ফুটে ওঠে। মূর্তিটির শরীর সংস্থানের দৃঢ়তা, চওড়া বক্ষ ও স্কন্ধহীন বরাহের মুখের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। বাঁ পায়ের কাছে প্রণত দু’টি নাগমূর্তি এবং শ্রেণিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ঋষিদের ছোট ছোট মূর্তি নির্মাণ করে সম্ভবত বিষ্ণুর মহিমা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে শিল্পী ভয়ঙ্করের সাথে মাধুর্য্য ও লারণ্যকে মিশিয়ে যে অভিনব মূর্তি নির্মাণ করেছেন তা এটিকে কালজয়ী করেছে। উদয়গিরির কাছে পাথরি নামক স্থানে কৃষ্ণ-জন্মের দৃশ্যটি বিশালাকার ভাস্কর্যে রূপায়িত।

পূর্বভারত–গুপ্ত ভাস্কর্য

গুপ্ত শিল্পধারার প্রভাব পূর্বদেশেও প্রবাহিত হয়। পূর্বভারতের শস্য-শ্যামলা প্রকৃতি, সহজ জীবনযাত্রা ও প্রাচুর্য গুপ্ত ভাস্কর্যগুলিকে অনেক নমনীয়তা প্রদান করে। রাজগীরের নিকটবর্তী ‘মনিয়ার মঠ’ নামে গোল মন্দিরের গায়ে চুনামাটি জমানো অপ্সরা মূর্তিগুলি সেকালের শিল্পীদের শিল্পবোধের পরিচয় বহন করে। রাজশাহীর বিহারাইল গ্রাম থেকে প্রাপ্ত দন্ডায়মান বুদ্ধমূর্তিটি চুনারের বেলেপাথরে নির্মিত। পঞ্চম শতাব্দীতে নির্মিত এই মূর্তিটির চোখ দু’টি সারনাথের বুদ্ধমূর্তির মত এবং দাঁড়ানোর ভঙ্গীও সারনাথের মূর্তির মত অল্প বাঁকা।

বাংলাদেশের সুন্দরবনে কাশীপুর গ্রাম থেকে প্রাপ্ত ও বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালায় রক্ষিত কষ্টিপাথরের সূর্য মূর্তিটিতে দু’হাতে দু’টি পদ্মফুল নিয়ে সূর্যদেব এক চাকার রথে দন্ডায়মান। তাঁর সামনে সারথী অরুণীর দেহের নীচের অংশ রথের অলঙ্করণে ও বেগবান সাতটি ঘোড়ার গতির রূপায়ণে ঢাকা পড়েছে। সূর্যের নিমীলিত সমাহিত চোখ, সুন্দর মুখমন্ডল; শিল্পশাস্ত্রের নিয়ম মেনে অপূর্ব দেহ সৌষ্ঠব, রত্নখচিত মুকুটের অলঙ্করণ—এইসবই গুপ্ত শিল্পপ্রতিভার উৎকৃষ্ট নিদর্শন বহন করে।

কাশীপুর ছাড়াও বগুরা জেলার দেওড়া গ্রাম থেকে আরেকটি সূর্য মূর্তি পাওয়া গেছে। এখানে সূর্যের মাথার চারদিকে একটি গোলাকার প্রভামন্ডল; সুর্যের দু’হাতে তিনটি করে পদ্মফুল, কোমরে সরল কৃপান, দু’পাশে পিঙ্গল ও দন্ডী (সূর্যের প্রহরী), ঊষা ও প্রত্যুষা দুটি নারীমূর্তি দু’দিকে দণ্ডায়মান। সূর্যের পায়ের ‘বুট জুতা’ অল্পই দেখা যায়। সূর্যমূর্তির নীচের দিকে দুইপাশে তিনটি তিনটি করে ছ’টি ঘোড়া সামনের দিকে পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সপ্তম ঘোড়াটি মাঝখান থেকে সূর্যরথের চাকাটিকে আংশিক ঢেকে রাখে। পৌণ্ড্রবর্ধন বা মহাস্থানগড়ের হিন্দু ও বৌদ্ধমুর্তিগুলিও প্রায় সমগোত্রের। সারনাথের মূর্তি নির্মাণশৈলীর সাথে এগুলির শিল্পগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।আসামের তেজপুরের দহ-পার্বতীয়া মন্দিরের ভাস্কর্যগুলিও গুপ্তশৈলীর বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ।

মন্দির ভাস্কর্য—গুপ্ত যুগ 

গুপ্তযুগের ভাস্কর্য শিল্পের আলোচনা করতে গেলে এযুগের মন্দির ভাস্কর্যগুলির আলোচনাও প্রাসঙ্গিক। গুপ্তযুগের মন্দির ভাস্কর্যগুলি সাধারণত মন্দিরের দেওয়ালগুলিকে সজ্জিত করার জন্যই রচিত হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মন্দির ভাস্কর্যগুলি গভীরভাবে প্রোথিত এবং চারিদিকে ‘বন্ধনী’ (Border) দ্বারা আবদ্ধ। মনে হয়, যেন একটি সুন্দর কারুকার্যখোচিত ফ্রেমে ছবিগুলি বাঁধানো রয়েছে। এর মধ্যে ঝাঁসি জেলায় দশাবতারের মন্দিরে অনন্তনাগের উপর শায়িত বিষ্ণু মূর্তিটি অতুলনীয়।

অনন্তনাগের সাতটি ফণা, বিষ্ণুর কমনীয় শয়নভঙ্গী, লক্ষ্মীর পদসেবা—সবই যেন একটি সুরে বা ছন্দে বাধা। উপরের দিকে প্রস্ফুটিত পদ্মে চতুর্মুখ ব্রহ্মা, বৃষে উমা-মহেশ্বর, ঐরাবতে ইন্দ্র ও ময়ূর বাহনে দেবসেনাপতি কার্তিক। এঁরা সকলেই পূর্ব বর্ণিত গন্ধর্ব দম্পতির মত আকাশে ভাসমান। রেখা ও ভঙ্গীতে স্থির থেকে এই আকাশবিহারের ভাবটি ফুটিয়ে তোলা গুপ্তযুগের শিল্পশৈলীতেই সম্ভব হয়েছিল।

বিষ্ণুর শয়নমূর্তির নীচে দেবসেনা ও কয়েকটি নারীমূর্তির রূপায়ণ অতি পরিচ্ছন্ন ও ভাবব্যঞ্জক। দেওগড়ের মন্দিরে উপবিষ্ট বিষ্ণুমূর্তি, গরুড়-বাহন বিষ্ণুমূর্তি ও মাথার উপর সাপের ফণাযুক্ত চতুর্ভূজ বিষ্ণুমূর্তি রয়েছে। কানপুরের ভিতরগাঁও মন্দিরে শৈবধর্মের বিষয়বস্তু অবলম্বন করে টেরাকোটার অলঙ্করণের মাধ্যমে ভাস্কর্য খোদিত আছে। এছাড়াও মধ্যভারতের ভূমরার শিবমন্দিরে খোদিত ভাস্কর্যগুলিও দেওগড়ের মন্দিরের মত উল্লেখযোগ্য। দশাবতার মন্দিরের বিভিন্ন প্যানেলে যেসব ভাস্কর্য দেখা যায়, তার মধ্যে রয়েছে দেবকীর কাছ থেকে বাসুদেবের নবজাত কৃষ্ণকে গ্রহণ, রাম-লক্ষ্ম ণ-সীতার বন-গমন, সূর্পনখাকে দমনে উদ্যত তরবারি হাতে লক্ষ্মণ প্রভৃতি। প্রসঙ্গত, গুপ্তযুগে রাম ও কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার রূপে পূজিত হতেন।

পর্বত-গুহা ভাস্কর্য—গুপ্ত যুগ

গুপ্তযুগে পর্বত-গুহায় খোদিত ভাস্কর্যগুলির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ইলোরার পর্বত-গুহার মন্দির স্তম্ভের উপর উৎকীর্ণ শিবকে স্বামী রূপে পাওয়ার জন্য পার্বতীর তপস্যা (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী)। এলিফ্যান্টা ভাস্কর্যগুলিতেও (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী) মহাদেব, তান্ডবরত শিব ও শিব-পার্বতীর বিবাহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আইহোলিতে পর্বত-গুহা খোদাই করে দূর্গা মন্দিরের গায়ে শিব-বৈশ্রবণের মূর্তি উৎকীর্ণ করা হয়েছে।

দেবদেবীর মূর্তি—গুপ্ত ভাস্কর্য

গুপ্ত-মূর্তি ভাস্কর্যে বুদ্ধ সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য পেয়েছেন এছাড়াও শিব, বিষ্ণু, দুর্গা, কার্তিকেয়, সূর্য প্রভৃতি হিন্দু দেবতার মূর্তিও লক্ষ্য করা যায়। সারনাথ ও মথুরার বুদ্ধমুর্তিগুলির উল্লেখ আগেই করা হয়েছে।  এলাহাবাদের কাছে কোসামে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দের একটি শিবমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। আজমীরের কাছে কামানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, সূর্যদেবতার মুখ যুক্ত লিঙ্গমূর্তি এবং ‘শিব-পার্বতীর বিবাহ’-বিষয়ক ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। বারাণসী বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত কার্তিকেয়-র মূর্তি ও সারনাথ মিউজিয়ামে রক্ষিত লোকেশ্বর শিবের মস্তকে সারনাথ শিল্প ট্র্যাডিশনের প্রকাশ মূর্ত হলেও এর গঠন ভঙ্গিমায় গুরুভার এবং আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের অভাব স্পষ্ট। ভূমরার মন্দিরে একটি সূর্যদেবতার মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটির পোষাক-পরিচ্ছদ কুষাণ রাজা কনিষ্কের মত। এর সঙ্গে অবশ্য সপ্তাশ্ব-রথ নেই। আজমীরের কাছে সাতটি ঘোড়ার মূর্তি আবার পৃথকভাবে পাওয়া যায়। এলাহাবাদ মিউজিয়ামে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর একটি মূর্তি রয়েছে, যার চারদিকে বরাহ, বিষ্ণু, বামন এবং হরি-হর খোদিত আছে। পাটনার যাদুঘরে হরি-হরের মূর্তিটির দক্ষিণ দিকে হর, যার হাতে ত্রিশূল ও অক্ষমালা ধরা এবং মূর্তিটির বামদিকে হরি, যার হাতে আয়ূধ শঙ্খ ও চক্র ধরা। গুপ্তযুগে নির্মিত শিব ও পার্বতীর সমন্বিত রূপ অর্ধনারীশ্বর মূর্তিও পাওয়া গেছে।

পোড়ামাটির ভাস্কর্যগুপ্তযুগ

গুপ্ত মৃৎশিল্প বা পোড়ামাটির ভাস্কর্যের গঠন পদ্ধতিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাথরের ভাস্কর্যের মত। অনেক সময় পাথরের ভাস্কর্য নির্মাণ করার পূর্বে শিল্পী কাদামাটি দিয়ে মূর্তিটির প্রাথমিক রূপদান করতেন। প্রয়োজনে মাটির মূর্তিগুলি পুড়িয়ে পাথরের ভাস্কর্যের মতই শিল্প সৃষ্টি করা হত। উত্তরপ্রদেশের কানপুরের ভিতরগাঁওয়ের মন্দির, সিন্ধুপ্রদেশের ব্রাহ্মণানাবাদ ও মীরপুরখাস অঞ্চলের বৌদ্ধস্তূপ এবং মন্দিরগুলিতেমাটির ভাস্কর্য লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও রাজপুতানার, বিকানির ও হনুমানগড় এবং বাংলার বানগড় প্রভৃতি স্থানের পোড়ামাটির শিল্পকার্য, গভীর বা অগভীরভাবে রচিত বিচিত্র অলঙ্করণ, নানা জীবজন্তুর চিত্র পোড়ামাটিরশিল্প-সাফল্যের সুন্দর নিদর্শন বহন করে। গুপ্তযুগের পোড়ামাটির শিল্পকার্যকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ, পাথরের ভাস্কর্যের মত বড় বড়টালির আকারে সুনির্দিষ্ট বন্ধনীর মধ্যে পৌরাণিক কাহিনী অথবা দেবদেবীর মূর্তি মন্দিরের দেওয়ালগুলিকে সাজানোর জন্য ব্যবহৃত হত। সিন্ধুর মীরপুরখাস স্তূপের বুদ্ধমুর্তি এবং ভিতরগাঁও মন্দিরে এইরূপ ভাস্কর্যের নিদর্শন রয়েছে। গুপ্তযুগের পোড়ামাটির নিদর্শনগুলি গতানুগতিকভাবে নির্মিত হয়নি। ভারতে নদীজল সিঞ্চিত পেলব মাটি সহজলভ্য হওয়ায় মাটির নির্মিত শিল্পবস্তুগুলি সরলতা ও স্বাভাবিকতার কারণেই উচ্চ-নীচ সকল মানুষের মধ্যেই প্রসার লাভ করে।

দ্বিতীয় ভাগের ভাস্কর্যগুলির মধ্যে শিল্পী তার আপন সত্ত্বাকে সহজ ও বন্ধনহীন ভাবে প্রকাশ করেন। উত্তরপ্রদেশের অহিচ্ছত্র, কৌশাম্বী, রাজঘাট, বিহার, বাংলাদেশের তমলুকের নিকটবর্তী পান্না প্রভৃতি এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে গুপ্তযুগের পোড়ামাটির শিল্পসম্ভারের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়। এগুলিতে কোথাও কেশ প্রসাধনে সজ্জিত অপূর্ব নারীমূর্তি, আবার কোথাও পান্নাগ্রাম – অপ্সরা মূর্তি পবিত্র সুন্দর মুখের ভাস্কর্য নির্মিত হয়। কোথাওবা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কাব্যরূপ মৃৎশিল্পের পেলবতাকে আশ্রয় করে ফুটে ওঠে। তমলুকের কাছে পান্না গ্রাম থেকে

আবিষ্কৃত হাস্যময় অপ্সরা মূর্তিটি প্রাণের আবেগে ও মাধুর্য্যে অতুলনীয়। মহাস্থানগড়ের দম্পতি পদ্মের পাঁপড়ি শোভিত চক্রের মধ্যে থেকে সহজ ও স্বাভাবিকতায় উজ্জ্বল। গুপ্তযুগের প্রভাবিত পোড়ামাটির শিল্পকার্য পশ্চিম পাঞ্জাব, আফগানিস্থানের নিকটবর্তী অঞ্চল ও কাশ্মীরেও পাওয়া গেছে।

কোনো কোনো পন্ডিতের মতে, গুপ্ত পোড়ামাটির শিল্পবস্তুগুলির গায়ে গেরি মাটি, হলুদ ও লাল রঙের প্রলেপ লাগিয়ে মসৃণ ও আকর্ষণীয় করে তোলা হত। এককথায়, গুপ্তযুগের পোড়ামাটির শিল্পকে‘লোকশিল্প’ বলে অবজ্ঞা করে তাকে প্রস্তর-ভাস্কর্যের নিম্নে রাখা যায় না। শিল্প বিচারের নিরিখে গুপ্তযুগের মৃৎশিল্প ভারতের ইতিহাসে একটি গৌরবজনক স্থান অধিকার করে আছে।

গুপ্ত ভাস্কর্য–মূল্যায়ন :

গুপ্তযুগের ভাস্কর্যে শিল্প ভাবনার সাথে চিত্র ও মননের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল। মানুষের পার্থিব ও মানবিক সত্ত্বাকে এই শিল্পের অঙ্গীভূত করা হয়েছিল। কুষাণ-শৈলীর দেহসর্বস্বতা, পেশীবহুলতা ও যান্ত্রিকতা অনেকটাই লুপ্ত হয়েছিল। মথুরা ও অমরাবতীতেও ইতিপূর্বে প্রাণী ও উদ্ভিদ ছাড়াও মানুষের মূর্তি প্রাধান্য পেয়েছিল। গুপ্তযুগে মথুরা ও অমরাবতী শৈলীর মনুষ্যমূর্তিগুলিকে অতিক্রম করে বাইরের আকৃতির সঙ্গে অন্তরাত্মার মিলন ঘটানো হয়। এর ফলে মূর্তিগুলির মুখমন্ডল এক অপূর্ব আধ্যাত্মিকতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং দেবভাব প্রকাশ পায়। গুপ্তযুগের ভাস্কর্যশিল্পের প্রধান কেন্দ্র মথুরা ও সারনাথ হলেও (বুদ্ধমূর্তি) পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ ভারতে এই শিল্পের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীরা প্রবলভাবেই উপস্থিত ছিলেন। আবার পশ্চিমভারতের ভাস্কর্যে যখন মূর্তিগুলি বেশ গুরুভার ও কাঠিন্যযুক্ত তখন পূর্বভারতের ভাস্কর্য মূর্তিসমূহে পেলবতা, কৃশতা ও অঙ্গসৌষ্ঠবের মাধুর্য্য লক্ষ্য করা যায়। পশ্চিম ভারতে সারনাথ শিল্পের প্রভাব অনুপস্থিত হলেও মথুরা ঐতিহ্যের প্রভাব অনেক বেশি। পূর্বভারতে আবার সারনাথ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার লক্ষ্য করা যায়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *