গুহাচিত্র কেন আঁকা হতো
অথবা,
প্রাচীন মানুষ কেন গুহাচিত্র আঁকত
অথবা,
প্রাচীন মানুষ কেন গুহাচিত্র অঙ্কন করত।
প্রাচীন মানুষ কেন অন্ধকার গুহাগুলির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে চিত্র রচনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল—সেসম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো মতামত প্রদান করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করেন, মানুষের সহজাত অঙ্কনস্পৃহা ও সৌন্দর্য প্রীতি থেকেই আদিমানব চিত্রাঙ্কনে প্রলুব্ধ হয়েছিল। এর বিপরীতে বলা হয়, অঙ্কন করার অনুপযুক্ত গুহার অন্ধকার পাথরের দেওয়ালে শুধু রূপবুদ্ধির অনুপ্রেরণায় চিত্র রচনা একটি অযৌক্তিক মতবাদ। চর্বির মশাল জ্বেলে মানুষের দৃষ্টি ও নাগালের বাইরে অত্যন্ত কষ্ট বরণ করে বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদেই আদি-মানুষ চিত্র অঙ্কন করেছিল।
যদি সৌন্দর্যের উপাসনাই মুখ্য হত, তাহলে দিনের আলোয় উপযুক্ত স্থান তারা সৃষ্টির জন্য বেছে নিত) চিত্রাঙ্কনের উপকরণরূপে তারা ব্যবহার করেছিল কয়লা, ‘রক্তবর্ণ, হলুদ, সবুজ বর্ণের পাথর, খড়ি ও নানা ধরণের স্থানীয় মৃত্তিকা ও রঙীন পাথর। এইসব রঙের সঙ্গে জন্তুর চর্বি মিশিয়ে দাঁতন কাঠির মত ভোঁতা ছোবড়াযুক্ত কোনো তুলির সাহায্যে গুহার দেওয়ালে পাথরের উপর ঘষে ঘষে তারা রঙ প্রয়োগ করেছিল। এই পদ্ধতির সাহায্যে রঙ প্রয়োগ করায় চর্বিযুক্ত রঙ অসমতল পাথরের গায়ে প্রবেশ করায় দুই-তিন হাজার বছর এবং তার পরেও এগুলি বিনষ্ট হয়নি।
কোনো কোনো পন্ডিত মনে করেন, (আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য গুহামানব শুদ্ধ মনোভাব নিয়ে বশীকরণ বিদ্যার অনুশীলন করত। এরই অঙ্গ হিসেবে তারা চিত্র অঙ্কন করত। পূর্বে গুহাগুলি ছিল হিংস্র পশুদের আবাসস্থল। আদি মানবরা সেই হিংস্র পশুদের বিতাড়িত করে গুহাগুলি তাদের বাসস্থানের জন্য দখল করতে সচেষ্ট হয়। তাদের খাদ্য সংগ্রহের সংগ্রাম এবং বাসস্থান সংগ্রহের সংগ্রাম পাশাপাশি চালাতে হয়েছিল। খাদ্য ও বাসস্থানই ছিল তাদের সেসময়ের প্রধান সংকট। তখন উদ্ভিদ জগতের চেয়ে জীবজগতের সঙ্গেই মানুষের সম্পর্ক ছিল নিকটতর।
লগুড় ও পাথরের খন্ড দিয়ে জীব হত্যা করে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করতে হত, আত্মরক্ষা করতে হত। জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে যুদ্ধে উভয়েরই হতাহতের সংখ্যা কম ছিল না। কারুশিল্প-বিজ্ঞানের অজ্ঞতার জন্য গুহামানব বাধ্য হয়েছিল দৈবের উপর আস্থা রাখতে। দৈবশক্তিকে বশীভূত করে প্রাণীদের বধ বা বশীভূত করার জন্য আদি মানব নানাধরনের অনুষ্ঠানে রত হয়েছিল। প্রাণীচিত্রগুলি সম্ভবত এই অনুষ্ঠানকার্যে বিশেষ স্থান গ্রহণ করেছিল।
প্রসঙ্গত হিন্দু-তন্ত্রশাস্ত্রে চিত্র বা মূর্তির উপর নানাপ্রকার অভিচার-প্রক্রিয়া এখনও বর্তমান। দৈব অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে আদি-মানুষ সম্ভবত আত্মবিশ্বাস অর্জন করে এবং পশুশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। স্পেনের আলতামিরা গুহাতে দুটি বাইসন চিত্র দেখা যায়। একটি জীবত্ত ও দৃপ্ত, অপরটি নির্জীব ও পদানত। পণ্ডিতরা এই দ্বিতীয় বাইসনটিকে মন্ত্রবলে যাদু বা বশীকরণ করা হয়েছে বলে মনে করেন। প্রসঙ্গত প্রাক্-ঐতিহাসিক যুগের আদিমানবরা গৃহনির্মাণের কৌশল রপ্ত করতে শেখেনি। তাই বাধ্য হয়েই তারা গুহাভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং সেখানেই প্রয়োজনীয় ধর্মানুষ্ঠান ও দৈবশক্তির অনুগ্রহ লাভের জন্য আরাধনায় লিপ্ত হয়। এই উদ্দেশ্যে গুহার অভ্যন্তরেই তারা গুহাচিত্র অঙ্কন করে।