চিনে শত দিবসের সংস্কার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল কেন? । শত দিবসের সংস্কার আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ গুলি আলোচনা করো।
সম্রাট ও কাং সংস্কারের মাধ্যমে চিনকে আধুনিক ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাদেশিক শাসকরা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বেশিরভাগ কর্মচারী সম্রাটের আদেশ কার্যকর করেননি, শুধু হুনানের গভর্নর ছিলেন ব্যতিক্রম। সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসাররা জানতেন যে প্রাসাদে প্রকৃত ক্ষমতা রয়েছে রানি জু-সি-র হাতে। তিনি এত উগ্র প্রগতিশীল সংস্কার পছন্দ করছেন না। কনফুসীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিকে অবজ্ঞা করে জাপানের অনুকরণে সংস্কার রানির কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য ছিল না। তিনি মনে করেন সংস্কারকরা সফল হলে তিনি ক্ষমতা হারাবেন। তিনি রক্ষণশীল সংস্কার গ্রহণে রাজি ছিলেন, কিন্তু কাং-এর সংস্কার ছিল বৈপ্লবিক। তিনি ততক্ষণ নীরব ছিলেন যতক্ষণ কনফুসীয় রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল না। যে মুহূর্তে তিনি অনুভব করেন সম্রাট ও সংস্কারকরা সীমা অতিক্রম করেছেন তিনি হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন।
প্রাসাদের খোজা লি লিয়েন ইং ও মাঞ্চু সেনাপতি জুং লুর সহায়তা নিয়ে তিনি সম্রাটকে বন্দি করে ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন। সম্রাটের মৃত্যু পর্যন্ত রানি ছিলেন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান। তাঁর মৃত্যুর একদিন আগে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে সম্রাট কোয়াংসুর মৃত্যু হয়। কাং ও তার অনুচর লিয়াং চি চাও জাপানে পালিয়ে যান। সংস্কার আন্দোলনের ছজন নেতার প্রাণদণ্ড হয়, এরা ‘ছয় শহিদ’ নামে পরিচিত। সংস্কারকদের দ৯ করে রানি সংস্কারের সব আদেশ বাতিল করেন। সরকারিপদ যা তুলে দেওয়া তা ফিরে আসে। সরকারি পুরোনো পরীক্ষা ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। সরকারি মুদ্রণযন্ত্র, সভা-সমিতি, সংবাদপত্রগুলি সব বন্ধ হয়ে যায়। তবে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করা হয়নি। মধ্যপন্থী সংস্কারকরা আবার উচ্চপদগুলি লাভ করেন।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের শতদিবসের সংস্কার ব্যর্থ হয়ে যায়। সংস্কারকদের অনভিজ্ঞতার সংস্কারের পদ্ধতি, সম্রাজ্ঞীর ক্ষমতালোলুপতা এবং রক্ষণশীলদের বিরোধিতা এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল। (The Chief significance of 1898 was that the radicals’ attempt at a revolution from above, in the patter of the revolution effected in Japan by the Meiji Restoration, had failed)।
সম্রাজ্ঞী অতি সহজে প্রায় বিনাবাধায় সংস্কারকদের দমন করেন। এথেকে প্রমাণিত হয় চিন বৈপ্লবিক সংস্কারের জন্য প্রস্তুত ছিল না। শতদিবসের সংস্কারের ব্যর্থতার প্রধান কারণ হল এর প্রবক্তারা ছিলেন অল্পবয়সী ও অনভিজ্ঞ। কাং ছিলেন মাত্র চল্লিশ বছর বয়স্ক, আর তাঁর সহযোগী লিয়াং চি চাও ছিলেন মাত্র পঁচিশ বছরের যুবক, প্রশাসনিক কোনো দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। এঁরা কখনও বিদেশে যাননি, বিদেশি শাসন ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর পরিচয় তাঁদের ছিল না। মিশনারিদের লেখা পড়ে এবং হংকং ও সাংহাইয়ের শাসন দেখে তারা পশ্চিমি জীবন ও সংস্কৃতিকে চিনেছিলেন। ঠিক এই কারণে নরমপন্থী সংস্কারক চ্যাং চি টুং তাদের পশ্চিমি জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলেন।
বিপ্লবী সংস্কারের প্রধান প্রবক্তা কাং ছিলেন একজন দার্শনিক, মানুষ, বাস্তব রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। বাস্তব রাজনীতির উৎস কী, বা তার ক্ষমতার উৎস কী হবে সে সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল আদর্শবাদী না। তিনি সম্রাটকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে ধরে নিয়ে সংস্কার প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। তিনি কখনও বোঝার চেষ্টা করেননি চিং রাজতন্ত্রের ক্ষমতার আসল উৎস হল রাজমাতা জু-সি। সংস্কার প্রবর্তনের জন্য তিনি অধীর হয়ে পড়েছিলেন, সংস্কারের প্রভাব অন্যদের ওপর কী হবে তা তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করেননি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন সম্রাটের সমর্থন তিনি লাভ করেছেন, আর সব বাধা সহজে অতিক্রম করা যাবে। তিনি কখনও উপলব্ধি করেননি যে ধরনের চরমপন্থী সংস্কার তিনি প্রবর্তন করতে চলেছেন তাতে সমগ্র কনফুসীয় সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিপর হয়ে পড়বে (The radical reform was in effect a war on the whole Confucian state and society)। প্রবল বিরোধিতার কথা তিনি বিবেচনার মধ্যে আনেননি। পুরোনো অষ্টপদী রচনামূলক পরীক্ষা পদ্ধতির (eight-legged essay) পরিবর্তন করে তিনি পরীক্ষার্থীদের আঘাত করেন, তাঁর প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে বহু কর্মচারী চাকরি হারালেন। তিনি সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের সরকারি পদে নিয়োগের প্রস্তাব দিলে পুরোনোপন্থীরা আতঙ্কিতবোধ করেছিল। সৈন্যবাহিনীর সংস্কারের ফলে মাঞ্চু ও চিনারা কর্মচ্যুত হয়, প্রশাসনে দুর্নীতি বন্ধ হলে অনেকের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি মন্দির ও দেবালয়ে স্কুল স্থাপন করলে সন্ন্যাসী ও পুরোহিততন্ত্র ক্ষুব্ধ হয়েছিল। এই সংস্কার আন্দোলনের আরও একটি দিক ছিল। সম্রাট ছাড়া সংস্কারকরা সকলে ছিল চিনা, সুতরাং মাঞ্চুরা এই সংস্কারগুলিকে তাদের স্বার্থ-বিরোধী বলে গণ্য করেছিল।
বিধবা রানি জু-সি ছিলেন রাজপ্রাসাদে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারিণী। তিনি বহু বছর ধরে রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অনভিজ্ঞ সংস্কারকরা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি। নামমাত্র তিনি অবসর নিয়েছিলেন, আসলে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক সব সিদ্ধান্ত তাঁর ইচ্ছানুযায়ী হত। সেনাপতি জুং লু সম্রাজ্ঞীর স্বার্থরক্ষা করে চলতেন, প্রাসাদের খোজা প্রহরীরা সম্রাটের ওপর নজর রাখত। সম্রাট ও সংস্কারকরা সামরিক সমর্থনের জন্য য়ুয়ান শিকাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু য়ুয়ান তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তিনি সম্রাজ্ঞীর পক্ষে যোগ দিয়ে সংস্কারের পতন ঘটান। সৈন্যবাহিনীর সমর্থন না থাকায় সংস্কারকরা ব্যর্থ হন। রক্ষণশীলরা সংস্কারপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিল (Kang Yu-Wei’s face is Confucian, but his heart is barbarian)। নরমপন্থী বুদ্ধিজীবীরা কাং-এর কনফুসীয় দর্শন ব্যাখ্যাকে বিপজ্জনক বলে গণ্য করেছিল।
কাং বাস্তববাদী রাষ্ট্রনেতা ছিলেন না, ছিলেন স্বপ্নদর্শী আদর্শবাদী মানুষ। তিনি ব্যাপক সংস্কার প্রবর্তন করে চিং রাজবংশ ও চিনকে বাঁচানোর প্রয়াস চালিয়েছিলেন। কিন্তু কাং-এর সমস্যা হল তিনি যুগের চেয়ে বেশি এগিয়ে গিয়েছিলেন (It was clearly too advanced for his time)। একথাও ঠিক কাং সফল হলেও ধ্বংসোন্মুখ রাজতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারতেন না। রাজতন্ত্রের অভ্যন্তরে অবক্ষয় বহুদিন ধরে চলেছিল। শতদিবসের সংস্কার কয়েকটি স্পষ্ট ইঙ্গিত রেখে গিয়েছিল। প্রগতিশীল সংস্কার ওপর থেকে চাপানো হলে তা সব সময় সফল হয় না।
রক্ষণশীল রাজদরবার সংস্কার বিমুখ হয়ে উঠেছিল, তারা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়। রাজতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য রক্ষণশীলরা বিদেশি-বিরোধী বক্সার বিদ্রোহীদের মদত দিয়েছিল। এর পরিণতি হল আটটি দেশ যৌথভাবে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী পিকিং অধিকার করে নিয়েছিল। সংস্কার ব্যর্থ হলে রাজদরবার চিনাদের এজন্য দায়ী করে শাস্তি দিতে থাকে, চিনা ও মাঞ্চুদের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়, ব্যবধান বেড়ে যায় (Reforms benefit the Chinese, hurt the Manchus)। মাঞ্চু শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এই ধারণা গড়ে উঠেছিল সংস্কারের ফলে লাভবান হয়েছে চিনারা, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঞ্চুরা। শতদিবসের সংস্কার আন্দোলন ব্যর্থ হলে চিনাদের একাংশ ধরে নিয়েছিল বিপ্লবের মাধ্যমে মাঞ্চু রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে শুধু চিনকে রক্ষা করা যেতে পারে। ড. সানইয়াৎ-সেন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মাঞ্চু রাজতন্ত্রের উচ্ছেদের পরিকল্পনা করেন, দেশবাসী তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল।