চীনের ঐতিহ্যবাহী সমাজ ব্যবস্থার উপর একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ। চীনের ঐতিহ্যবাহী সমাজ ব্যবস্থার উপর একটি টীকা।
চীনের ঐতিহ্যবাহী সমাজ ব্যবস্থার ছিল পরিবারকেন্দ্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্ক চীনা সমাজকে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র রূপ (The state in miniature) আখ্যা দিয়েছেন। চীনা সমাজের মূল একক এই একান্নবর্তী পরিবারগুলির সঙ্গে ভারতীয় একান্নবর্তী পরিবারগুলির মিল রয়েছে। তবে চীনা পরিবারগুলির উপর কনফুসীয় আচার বিধির প্রভাব ছিল অপরিসীম। এর ফলে চীনের সামাজিক শৃঙ্খলা এবং রক্ষণশীলতা বজায় রাখা সহজ হয়েছিল।
চীনের পরিবারগুলি খুব বড়, প্রচলিত এই ধারণার সঙ্গে বাস্তরের খুব মিল নেই। চীনা পরিবারে গড়ে পাঁচজন সদস্য থাকত। কয়েক প্রজন্ম নিয়ে বিরাট বাড়িতে বসবাস করত এমন পরিবার শুধু সম্পন্ন পরিবারগুলির মধ্যেই সীমিত ছিল। সাধারণ পরিবারের ক্ষেত্রে এই বিলাসিতার অবকাশ ছিল না। পরিবারের প্রধান রূপে পিতার কর্তৃত্ব ছিল অবিসংবাদিত। তিনি পরিবারের সব সমস্যার সমাধান করতেন; সন্তানের বিয়ে দিতেন, অসন্তানোচিত ব্যবহার বা অবাধ্যতা শাসন করতেন। প্রয়োজন হলে সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার অধিকার তাঁর ছিল। তবে পিতাকেও কনফুসীয় নৈতিক বিধান মেনে চলতে হত এবং পিতার কর্তব্য পালন করতে হত যাতে সন্তান বা কনিষ্ঠরা তাঁকে মান্য করে। আদর্শ পিতা হবেন কর্তৃত্বপরায়ণ অথচ স্নেহপ্রবণ।
কনফুসীয় বিধান অনুযায়ী বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী পারিবারিক মর্যাদা ও অবস্থান চিহ্নিত হত। অর্থাৎ কনিষ্ঠদের চেয়ে বয়স্করা বেশি মর্যাদার অধিকারী এবং মেয়েদের চেয়ে পুরুষরা বেশি মর্যাদার অধিকারী।
চীনা পরিবারের সদস্যদের রক্ষাকল্পে ব্যবস্থাদি এবং দায়িত্বভার নেওয়া হত যা পাশ্চাত্য দেশগুলি হতভাগ্য ও পঙ্গুদের সাহায্যকল্পে নিত। চীনা পরিবারগুলি সবসময় বৃদ্ধদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হত এবং তাদের উত্তরসূরীদের উদ্দেশ্যে আর্থিক সাহায্য প্রদান করত। পরিবারের সকল সদস্যদের জন্য সার্বিক দায়িত্ববোধ চীনা পরিবার প্রথার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
চীনারা মনে করতেন একজন সফল ব্যক্তির সবসময় দুর্ভাগ্য-পীড়িত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিত। এর ফলেই চীনা সমাজ ও রাজনীতিতে স্বজনপোষণ নীতির সূত্রপাত হয়। আধুনিক চীনে এমন ঘটনা বিরল নয় যেখানে একটি বড় ব্যাঙ্ক বা বণিক সংস্থার সাধারণ কর্মচারী থেকে শুরু করে কুলি পর্যন্ত সকলেই মালিকের আত্মীয় এবং একই শহরবাসী।
ইমানুয়েলসু যথার্থই বলেছেন যে, চীনা পরিবার হল মানবিক সম্পর্কের পরীক্ষাগার (the Chinese family was a laboratory of human relationship)। পরিবারের এই শিক্ষাই পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ করে স্তরবিন্যস্ত সরকারি দপ্তর পরিচালনায় কাজে আসত। কেননা তারা নিজেদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকত।
পাশ্চাত্য সমাজের মতো চীনা স্ত্রী-পুরুষেরা খোলাখুলি ভাবে মিশত না—স্ত্রী-পুরুষের – বিচরণের ক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। স্বামী সাধারণভাবে পরিবারের প্রধান। চীনা সমাজে বিবাহ সর্বস্তরে প্রচলিত ছিল এবং বাল্যবিবাহ প্রথাও প্রচলিত ছিল। তবে স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে বা অবিবাহিত থাকতে পারত না; বিয়ে সাধারণত মধ্যস্থতার মাধ্যমে সম্পাদিত হত, সেখানে প্রণয়ের বিশেষ স্থান ছিল না। চীনাদের যুক্তি হল : “you fell in love because you were married rather than vice versa”।
বিবাহে বাকদান বা অঙ্গীকারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। চীনা সমাজে অবস্থাসম্পন্ন পুরুষের একজন আইনসম্মত পত্নী এবং উপরন্তু একজন বা দু’জন উপপত্নী থাকত। উপপত্নীর সন্তানও পরিবারের সদস্যরূপে গণ্য হত। বিধবা বিবাহ কাম্য ছিল না। যেহেতু পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পুরুষ, সেহেতু যে স্ত্রীলোক পুত্রসন্তান জন্ম দিত, সেই বিবাহকে সফল বলে ধরে নেওয়া হত। যেহেতু কন্যার জন্মকে দুঃখের কারণ ভাবা হত সেহেতু শিশুকন্যার হত্যার ঘটনাও বিরল ছিল না।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাপটে চীনা নারীদের অবস্থা করুণ ছিল। কনফুসীয় বিধি ও পুরুষ প্রাধান্যের বেড়াজালে চীনা নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। তাদের সম্পত্তির অধিকার ছিল না। বিধবাদের বিবাহ অনুমোদিত ছিল না। মূলত বংশ রক্ষার তাগিদে পিতার ইচ্ছায় মেয়েদের বিয়ে করতে হত –ভালোবাসার জন্য নয়। নানাকারণে বিশেষত পুত্র সন্তান জন্মদানের অক্ষমতার জন্য সে স্বামী-পরিতক্তা হত। গৃহস্থালীর কাজেই তাকে সময় দিতে হত বেশি।
কৃষক রমণীদের প্রায় সকলেই অশিক্ষিত ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পদবন্ধনের (foot binding) মতো সামাজিক কুসংস্কার। অঙ্গ বিকৃত করার এই কুপ্রথা সম্ভবত দশম শতকে শুরু হয়েছিল যা “lily feet” নামে পরিচিত হয়। শত সহস্র চীনা মেয়ের পদবন্ধনজাত যন্ত্রণার মাধ্যমে অঙ্গের যে বিশেষ রূপ দেওয়া হত তাতে নান্দনিক এবং যৌনমূল্য থাকলেও মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের বহির্মুখীতা তথা অগ্রগতি রোধ করা। যদিও রাজনৈতিক দিক থেকে চীনা মেয়েদের সেরকম . সুযোগ দেওয়া হত না, তবুও চীনের ইতিহাসে, কিছু কিছু মহিলারা উল্লেখযোগ্য ক্রিয়াকর্মের জন্য বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন।
গৃহে চীনা মেয়েদের স্থান লিখিত বিধির চেয়ে কর্ম দক্ষতার উপর অনেকখানি নির্ভর করত। চীনা সমাজে পরিবারের মতো গোষ্ঠী বা বংশের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। একই বংশজাত পরিবারগুলি গোষ্ঠী সংগঠনের দ্বারা পরিচালিত হত। এই কৌলিক ঐতিহ্য দক্ষিণ চীনে প্রবল ছিল, মধ্য চীনে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী এবং উত্তর চীনে দুর্বল ছিল।
কুল বা গোষ্ঠী সংগঠনের কাঠামোর মধ্যে তারতম্য থাকলেও সাধারণত পরিবারের বয়স্ক বিশিষ্ট সদস্যই গোষ্ঠী নেতা (tsu-chang) হতেন। গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের সাহায্য নিয়ে তিনি গোষ্ঠীর পরিচালনা করতেন। কুলজি সংকলন ও সংরক্ষণ থেকে গোষ্ঠী বিবাদের মীমাংসা ও গোষ্ঠী সম্পত্তি সংরক্ষণ সবই গোষ্ঠীর কাজের আওতার মধ্যে পড়ত। এই গোষ্ঠী (clan)-গুলি নিয়েই গ্রামের আর্থ-সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠত। গোষ্ঠী বা কৌলিক আচরণবিধি কনফুসীয় আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হত। কনফুসীয় নীতিশিক্ষামূলক (didactic) আদর্শ উপযুক্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে পাঠ করা হত। এগুলি হ’ল মাতাপিতার সেবা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা, গোষ্ঠী সদস্যদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা, পুত্র ও পৌত্রদের শিক্ষা ও সম্মান প্রদান, নিজের দেশের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং আইনবিরুদ্ধ কাজ না করা।
গোষ্ঠী বিধির আওতায় পাপমূলক বা অপরাধমূলক কাজের বিরুদ্ধে সচেতন নির্দেশ ছিল। তাই অলসতা, অমিতব্যয়িতা, হিংসা এবং জুয়াখেলা অপরাধ বলে গণ্য হত। অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদানের অধিকারও গোষ্ঠীগুলির ছিল যদিও কঠোর দৈহিক শাস্তি ও মৃত্যুদণ্ড গোষ্ঠীগুলির আওতার বাইরে ছিল। সাধারণত রাষ্ট্র তাদের বিচারে হস্তক্ষেপ করত না। তত্ত্বগতভাবে চীনা সম্রাট সর্বক্ষমতার অধিকারী হলেও চীনের অশিক্ষিত ও সামাজিক ব্যবস্থার উপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
চীনা সমাজে জাতিভেদ প্রথা না থাকলেও আর্থিক অবস্থা ও জীবনযাত্রার মানদণ্ডে চীনাদের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ ছিল। একদিকে ছিল গ্রামের বিপুল কৃষক সম্প্রদায় যারা বৃক্ষ সমৃদ্ধ গ্রাম ও খামার বাড়ি নিয়ে একান্ত অনড়ভাবে জমির ওপর নির্ভরশীল এবং অন্যদিকে ছিল প্রাচীর বেষ্টিত ও বৃহৎ অট্টালিকা সমৃদ্ধ শহর ও নগর যেখানে বাস করত জমিদার, পণ্ডিত, বণিক এবং রাজকর্মচারী। এরাই হল সম্পত্তি ও পদমর্যাদার অধিকারী পরিবার। তাই চীনের মূল সামাজিক ভাগ হল গ্রাম ও শহরের অধিবাসীদের মধ্যে। দেশের ৮০% লোক গ্রামে বাস করত আর বাকি ২০% ছিল শহরের অধিবাসী। শহরবাসী সুবিধাভোগী শ্রেণী ছিল একটি মিশ্র গোষ্ঠী। এরা হল কনফুসীয় শাস্ত্রে পণ্ডিত বিদ্বান সমাজ (scholar literati), জেন্ট্রিশ্রেণী, রাজকর্মচারীবৃন্দ, ছদ্ম জমিদার, কারিগর শ্রেণী, বণিক শ্রেণী, সামরিক শ্রেণী প্রভৃতি। চীনা সামাজিক কাঠামোর প্রথমশ্রেণী হল পণ্ডিত বা বিদ্বান সমাজ।
প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিত শ্রেণী শ্রেষ্ঠ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হলেও এবং সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব থাকলেও তা পাশ্চাত্য দেশের মতো প্রগতিশীল ও ব্যাপক জ্ঞান বিস্তারে সহায়ক ছিল না। এর ফলে কোনও বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ভিনাকের মতে এই ধরনের পরম্পরাগত শিক্ষা বস্তুত জ্ঞানদীপ্তি (enlightenment)-র অন্যতম প্রধান অন্তরায় ছিল। তার ভাষায়, “In fact, education to constitute one of the greatest barriers to enlightenment in the Empire”। তার মতে এর কারণ ছিল বিদ্যাচর্চার অঙ্গ হিসাবে প্রাচীন মতাদর্শের পুনর্বিন্যাস এবং শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ছিল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি যা সম্পূর্ণ ধ্রুপদী সাহিত্যচর্চার মধ্যে সীমিত ছিল।
চীনের ঐতিহ্যবাহী সমাজকে অতি সহজভাবে শাসক ও শাসিতে বিভক্ত দ্বিমেরুকৃত সমাজ আখ্যা দেওয়া যায় না, কারণ এখানে পণ্ডিত, কৃষক, কারিগর এবং বণিক এই চার শ্রেণীর মিশ্র প্রধান স্তর বিদ্যমান। এই স্তরের উপরে ছিল সরকারি আমলা শ্রেণী এবং তলায় ব্রাত্য বা পতিত (degraded) জনগণ যারা সম্রাট য়ুয়ান চেং (Yuan-Cheng)-র (১৭২৩-৩৫) দ্বারা আইনগত মুক্তির আগে পর্যন্ত সাধারণ জনগণের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল।
স্তর বিন্যস্ত হলেও চীনা সামাজিক কাঠামো ছিল উন্মুক্ত, বিভিন্ন স্তরের মধ্যে কোনও লৌহকঠিন প্রাচীর ছিল না। বরং বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে গতিশীলতা লক্ষ্য করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে (একমাত্র কনফিউসিয়াসের বংশধর ছাড়া) লর্ড, ডিউক প্রভৃতি সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হত না। একযুগের বংশধরেরা প্রভাব প্রতিপত্তি ভোগ করলে পরবর্তী বংশধরেরা সামাজিক প্রতিপত্তি ভোগ করবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা ছিল না।
মূল্যায়ন:
চীনের ঐতিহ্যবাহী সমাজ ব্যবস্থার প্রভাবশালী ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিবার যেমন অযোগ্য বংশধরের হাতে পতন হয়েছিল, তেমনি সাধারণ পরিবারজাত মেধাবী ছাত্রও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চসরকারি পদে যোগ দিয়ে সামাজিক মর্যাদা ভোগ করতে পারত। সামাজিক মর্যাদা অনেকটাই শিক্ষা ও যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল ছিল। গরীব ধনী উভয়ের জন্যই তা উন্মুক্ত ছিল। সম্পদ, সামাজিক পদমর্যাদা এবং ক্ষমতা সাধারণত বিদ্বানদের আয়ত্তাধীন ছিল। উচ্চ মেধা ও সাহিত্যে দক্ষতা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার এবং সামাজিক স্বীকৃতির অন্যতম মাপকাঠি ছিল।