StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ গুলি আলোচনা করো

 

চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ গুলি আলোচনা করো । চুয়াড় বিদ্রোহের পটভূমি ব্যাখ্যা কর। 

চুয়াড় বিদ্রোহ আঠারো শতকের শেষে বাংলার সীমান্ত অঞ্চলে এক উপজাতি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। এই বিদ্রোহ চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত। অরণ্যচারী আদিবাসী মানুষদের তথাকথিত সভ্য মানুষরা চুয়াড় বলত, শব্দটির অর্থ অসভ্য, বর্বর, বন্য। চুয়াড়রা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ, বাংলার সীমান্ত অঞ্চলে জঙ্গলমহলে এরা দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করত। আদিম পদ্ধতিতে এরা কৃষিকাজ করে শস্য সংগ্রহ করত, ঘন অরণ্যে পাখি, জীবজন্তু শিকার করে আহার্য সংগ্রহ করত, আবার অরণ্যের মধু, কাঠ ও ফলমূল সংগ্রহ করে এরা অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করত। এরা কখনও সরকারকে রাজস্ব দিত না।

মেদিনীপুর জেলার উত্তর, বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম এবং মানভূম জেলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে ঘন অরণ্য পরিবেষ্টিত, পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে এই জঙ্গলমহল গড়ে উঠেছিল। এই চুয়াড়রা স্থানীয় জমিদারদের অধীনে পাইক হিসেবে কাজ করত, এজন্য পারিশ্রমিক হিসেবে নিষ্কর জমি ‘পাইকান’ ভোগ করত। এরা প্রথাগত অস্ত্রশস্ত্র তিরধনুক, টাঙ্গি, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে যুদ্ধ করত। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি বাংলা, বিহার, ওড়িশার দেওয়ানি পেয়েছিল। গোড়া থেকে কোম্পানির লক্ষ্য ছিল এখান থেকে সর্বাধিক রাজস্ব আদায় করে তার কোষাগার পূর্ণ করা।

চুয়াড় বিদ্রোহের মধ্যে দুটি স্তর বা পর্ব লক্ষ করা যায়। প্রথম পর্ব চলেছিল ১৭৬৬ থেকে ১৭৭৬ পর্যন্ত, এই পর্বে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন এই অঞ্চলের জমিদাররা। কোম্পানি এদের ওপর এত উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করেছিল যে তাদের পক্ষে তা এই অনগ্রসর, অনুন্নত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। কোম্পানি অবাধ্য জমিদারদের বাধ্য করার সংকল্প গ্রহণ করলে ‘একশত ক্রোশব্যাপী সমগ্র জঙ্গলমহলে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল’। এই অঞ্চলের জমিদাররা ছিল অস্থায়ী কর সংগ্রাহকমাত্র, তাদের জমির স্বত্ব দিয়ে ভূস্বামী বলে ঘোষণা করা হয়নি। তারা ছিল প্রকৃতপক্ষে সরকারি রাজস্বের ইজারাদার। এরা কোম্পানির আধিপত্য তখনও স্বীকার করেনি, মোগল আমলে তারা এই অঞ্চলে স্বাধীনভাবেই চলত। ইংরেজ বণিকদের জমিদাররা প্রভু হিসেবে মেনে নেয়নি, পাইক সৈন্য নিয়ে এরা কোম্পানির সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কোম্পানি সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে একে একে রামগড়, লালগড়, জামবনী, শিলদা প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল, জমিদাররা কোম্পানির বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ঘাটশিলার জমিদার তার পাইকদের নিয়ে এই বিদ্রোহে যোগ দিলে প্রথম পর্বের বিদ্রোহ আরও কিছুকাল ধরে চলেছিল।

ঘাটশিলার জমিদার ছিলেন বেশ শক্তিশালী, তাঁর দুর্গ ও সৈন্য ছিল, বেশিরভাগ প্রথাগত অস্ত্র এরা ব্যবহার করত, আগ্নেয়াস্ত্র খুব কম ছিল। এজন্য ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে এরা পরাস্ত হত। ঘাটশিলার বৃদ্ধ জমিদার ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে প্রবল বিক্রমে লড়াই করে পরাস্ত হন, তিনি পরাস্ত হয়ে জমিদারি হারিয়েছিলেন, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ঐ জমিদারি লাভ করেন। জঙ্গলমহলে শান্তি স্থাপন করে কোম্পানি ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে মোকরারি বন্দোবস্ত করেছিল। বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে কৃষক ও জমিদার ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছিল যদিও এদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল শোষক ও শোষিতের।

চুয়াড় বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্ব চলেছিল ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত। অরণ্যচারী চুয়াড়রা প্রায় স্বাধীনভাবে বাস করত, তাদের জীবনের ওপর ইংরেজ শাসনের অভিঘাত হল এই বিদ্রোহের আসল কারণ। ইংরেজরা জঙ্গলমহলে জমির নতুন বন্দোবস্ত করলে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। কোম্পানি জমিদারদের সঙ্গে ভূমি রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিল, রাজস্বের হার ছিল বেশ উঁচু। জমিদাররা এই অঞ্চলের আদিবাসীদের ওপর উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করেছিল। ইজারাদারদের জমিদারের তরফে রাজস্বের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। ইংরেজ শাসক, জমিদার, ইজারাদার, ইংরেজদের নতুন আইনকানুন হল সংঘাতের আর এক কারণ।

নতুন ব্যবস্থার ফলে চুয়াড়রা জমি হারিয়েছিল ; জমিদার, ইজারাদার পুরোনো প্রজা উচ্ছেদ করে উচ্চ রাজস্ব হারে নতুন প্রজা বসিয়েছিল। চুয়াড়রা জমিজমা, গৃহ, অরণ্য সব হারিয়ে ভয়ংকর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল। এই চুয়াড়দের মধ্যে একাংশ জমিদারের পাইক হিসেবে কাজ করত। এজন্য এরা নিষ্কর পাইকান জমি ভোগ করত। নতুন ভূমি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হলে এই পাইকরা তাদের নিষ্কর জমি হারিয়েছিল, তাদের মধ্যেও বিক্ষোভ জমতে থাকে। মেদিনীপুরের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট রেভিনিউ বোর্ডের কাছে লিখিত একখানি পত্রে স্বীকার করেছিলেন যে চুয়াড়দের জমি থেকে উচ্ছেদ এবং রাজস্বের উচ্চহার হল চুয়াড় বিদ্রোহের প্রধান কারণ। 

পাইকরা তাদের নিষ্কর জমি ভোগ করার অধিকার হারিয়েছিল। সরকার যেসব জমি বন্দোবস্ত করেছিল সেখানে নতুন প্রজা এসে চাষবাস শুরু করলে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। নতুন প্রজাদের ওপর চুয়াড়রা আক্রমণ চালিয়েছিল। তবে অনেক জমিদার এই বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। দুর্জন সিং, রানি শিরোমণি গোপনে বা প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্না ছিলেন এই অভিযোগে রানিকে গ্রেপ্তার করা হয়। চুয়াড় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন গোবর্ধন দিকপতি, মোহনলাল ও লাল সিং। বিদ্রোহীরা দলবদ্ধভাবে নেতাদের নেতৃত্বে লুটপাঠ ও হত্যালীলা চালিয়েছিল। এই জঙ্গলমহলের সর্বত্র ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। বহু অঞ্চল তারা আক্রমণ করে ধ্বংস করে দিয়েছিল। রায়পুর, বাসুদেবপুর, তমলুক, তুর্কাচর, জলেশ্বর, বলরামপুর, দুবাজল, রামগড়, শালবনি ও মেদিনীপুর পরগনায় বিদ্রোহীরা তাণ্ডব চালিয়েছিল।

সরকার প্রায় দু’বছর ধরে (১৭৯৮-১৮০০) সৈন্যবাহিনীর অভিযান চালিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল। বিদ্রোহ দমনের জন্য ভেদনীতির আশ্রয় নিয়েছিল। চুয়াড়রা ছিল সরল, নির্ভীক ও বিশ্বস্ত। এদের একাংশকে সরকারি কাজে নিযুক্ত করে বিদ্রোহকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। পাইকদের নিষ্কর জমি ফেরত দেওয়া হয়, পাইকদের পুলিশের কাজে নিযুক্ত করা হয়। জঙ্গমহলে পৃথক পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়, আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর কঠোরভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। 

জমিদাররা গ্রামাঞ্চলে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পান যদিও কর্নওয়ালিশ ব্যবস্থায় এই দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। নতুন ব্যবস্থায় বলা হয়েছিল পাইকদের দেয় রাজস্ব খুব কম হারে ধার্য করতে হবে। পাইকদের জমি কোনো অজুহাতে খাস করা যাবে না। জঙ্গলমহলে জমিদারের রাজস্ব বাকি পড়লেও জমিদারি নিলামে উঠিয়ে বিক্রি করা যাবে না। জমিদাররা চুয়াড় ও পাইকদের অঞ্চলের শান্তি রক্ষার কাজে নিযুক্ত করবেন। এসব ব্যবস্থার ফলে চুয়াড় বিদ্রোহ আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং ইতস্তত কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটলেও ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমগ্র অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। চুয়াড় বিদ্রোহকে জমিদার ও কৃষকের যৌথ বিদ্রোহ বললে অতিশয়োক্তি হয় না। অনেক সাধারণ কৃষকও এই বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল। কোম্পানির শাসনের গোড়ারদিকে জঙ্গলমহলের চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল এক ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা। ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসন নীতির বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ হয়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *