জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের সম্পর্ক আলোচনা কর।
জাতীয় আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলন তুলনামূলক আলোচনা কর ।
১৯২০-৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গান্ধিজির নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তিনবার জাতীয়তাবাদী সর্বভারতীয় আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। ১৯২০-২২ খ্রিস্টাব্ পর্যন্ত পরিচালিত হয় খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন। গান্ধিজির আবেদনে সাড়া দিয়ে শিক্ষক, আইনজীবী, শ্রমিক ও কৃষক অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। বাংলা, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও তামিলনাড়ুর কৃষকরা এই সময় খাজনা বন্ধের আন্দোলন করেছিল। কেরালার মোপলা কৃষকরা জেনমি ও মহাজনদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছিল। তারা খিলাফৎ আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়, খিলাফৎকে তারা ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে দেখেছিল।
১৯৩০-৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গান্ধিজি আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করেন। এই সময় ভারতীয় অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দার জন্য দুর্গতির মধ্যে পড়েছিল। ভারতে কৃষিজ পণ্যের দাম অত্যন্ত নেমে যায়, কৃষকের কর ও ঋণের বোঝা ভারী হয়ে উঠেছিল। এই পরিস্থিতিতে কৃষকরা করের পরিমাণ হ্রাস, সামন্তপ্রথার অবসান, জমিতে কৃষকের অধিকারের স্বীকৃতি এবং ঋণ মকুবের দাবি করতে থাকে। কংগ্রেস নেতারা এসময় কৃষকদের অনেক দাবিদাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কংগ্রেসের ফৈজপুর ও করাচি অধিবেশনে ভূমিকর ও ভূমিরাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করতে বলা হয়েছিল। সেইসঙ্গে কংগ্রেস প্রস্তাব নিয়ে বলেছিল সামন্তকর সব তুলে দিতে হবে। কৃষকের ভূমির অধিকারের স্বীকৃতি, ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ এবং সাধারণ কৃষকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার দাবি তোলা হয়েছিল। এসব দাবি কংগ্রেস সরকারের কাছে রেখেছিল।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ নির্বাচনের পর আটটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। এই মন্ত্রীসভাগুলি দু বছরের কিছু বেশি সময় বিভিন্ন প্রদেশে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিল। সর্বভারতীয় কিযান সভা এবং প্রাদেশিক কিষান সভাগুলি কংগ্রেসি মন্ত্রীসভার কাছে কৃষক কল্যাণমূলক সংস্কার আইন আশা করেছিল। বিহারে এসময় প্রবল কৃষক আন্দোলন চলেছিল, সেখানকার কৃষকরা জমিদারের খাসজমি (বকাস্ত) থেকে কৃষক উচ্ছেদ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিল। বিহার সরকার কৃষকদের দাবি মেনে নিয়ে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে বকাস্ত আইন পাশ করে কৃষক উচ্ছেদ বন্ধ করেছিল। তা ছাড়া কৃষকদের দাবি অনুযায়ী সব জমির ওপর ২৫ শতাংশ ভূমিকর হ্রাস করা হয়।
কৃষকদের জমি হস্তান্তরের অধিকার মেনে নিয়ে জমিদারের প্রাপ্য সেলামি কমিয়ে দেওয়া হয়। তিরিশের দশকের শেষদিক থেকে কৃষকরা জমিদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদ এবং রায়তওয়ারি অঞ্চলে ভূমিরাজস্ব স্থায়ীভাবে ধার্য করার দাবি জানাতে থাকে। কিন্তু কংগ্রেস সরকার কৃষকদের এসব দাবি মেনে নিতে পারেনি। বামপন্থী ঐতিহাসিকরা মনে করেন কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকার ও জমিদারদের স্বার্থরক্ষার প্রয়াস চালিয়েছিল। কংগ্রেস সরকারের রক্ষণশীল নীতির জন্য কিষাণ সভার সম্পাদক সহজানন্দ সরস্বতী বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ করেন।
গান্ধিজি দুটি কারণে কৃষকদের পক্ষ নিয়ে ব্যাপক বৈপ্লবিক সংস্কারের কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর ধারণা হয়েছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন হলে এই শ্রেণি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যোগ দিয়ে জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করে ফেলবে। দ্বিতীয়ত, তিনি শক্তিশালী ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দুর্বল, নিরস্ত্র কৃষকের সংঘাত এড়াতে চেয়েছিলেন, এরকম পরিস্থিতিতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তিনি মনে করেন।
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলন ছিল পরস্পরের পরিপূরক। খিলাফৎ, অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কৃষকরা দলে দলে জাতীয় আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। কৃষকদের ব্যাপক যোগদানের জন্য এই আন্দোলনগুলি বিশাল গণ-আন্দোলনের রূপ নিতে পেরেছিল। একথা ঠিক জাতীয় কংগ্রেস পরিকল্পিতভাবে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেনি। তাসত্বেও কৃষকরা জাতীয় নেতাদের আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছিল। কৃষকদের অর্থনৈতিক দাবির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং দেশের স্বাধীনতার দাবি যুক্ত হয়েছিল।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কৃষকরা বিশাল সংখ্যায় যোগ দিয়ে কংগ্রেস নেতাদের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। জাতীয় নেতারা কৃষকদের দাবিগুলিকে জাতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। জাতীয় কংগ্রেস ও কৃষক আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সাবলটার্ন ঐতিহাসিকরা মনে করেন এদেশের নিম্নবর্গের মানুষ কৃষক, শ্রমিক ও আদিবাসীরা সত্যিকারের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন করেছিল। তিরিশের দশকের মধ্যভাগে কংগ্রেসের মধ্যে সমাজতন্ত্রী দল গঠিত হলে কৃষকদের আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। সাম্যবাদীরা ওয়ার্কার্স ও পেজান্টস পার্টি গঠন করে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছিল। তবে জাতীয়তাবাদী কৃষক নেতাদের অনেকে সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীদের প্রভাবিত কৃষক আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াতে থাকেন।
চল্লিশের দশকের মধ্যভাগ থেকে ভারতের কৃষক আন্দোলন ক্রমশ উগ্র, জঙ্গিবাদী রূপ নিতে থাকে। ভারতের পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম প্রান্তে সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন দেখা দেয়। ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার কৃষকরা তেভাগা আন্দোলন শুরু করেছিল। ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বর্গাদারদের উৎপন্ন ফসলের স্থু অংশ দিতে বলা হয়। এই দাবি নিয়ে বাংলার জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, চব্বিশ পরগনা ও মেদিনীপুর জেলাতে ব্যাপক সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন হয়েছিল। আর একটি বড়ো কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দ্রাবাদ। হায়দ্রাবাদের বেশিরভাগ জমির মালিক ছিল নিজাম ও অভিজাতরা। এই রাজ্যের কৃষকরা ভূস্বামী, মহাজন ও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল।
সাম্যবাদীদের নেতৃত্বে পরিচালিত তেলেঙ্গানা আন্দোলন ১৯৪৫-৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। হায়দ্রাবাদ রাজ্য ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবার পর এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এসেছিল। তৃতীয় শক্তিশালী কৃষক আন্দোলনের ঘটনাটি ঘটেছিল মহারাষ্ট্রে। এখানকার ভারলি উপজাতির কৃষকরা ঠিকাদার, মহাজন ও জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল।
ভারতের কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোকেরা। সমাজবাদী ও সাম্যবাদী নেতারা কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। জাতীয় আন্দোলনের অনেক উজ্জ্বল তারকা প্রথম জীবনে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গান্ধিজি, জওহরলাল, সর্দার প্যাটেল, মদনমোহন মালব্য, সুভাষচন্দ্র বসু, জয়প্রকাশ নারায়ণ সকলে কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন।
ভারতের কৃষক আন্দোলনের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হল কৃষকদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। কৃষক নেতারা সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে সারাদেশের কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি। জাতীয় আন্দোলনের পক্ষে এর ফল শুভ হয়নি। পাঞ্জাব ও বাংলায় কৃষক আন্দোলনের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিকাশ ঘটেছিল। এই দুই অঞ্চলের হিন্দু জমিদার, মহাজন এবং মুসলিম কৃষককের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বকে সুকৌশলে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ভারত বিভাগের পটভূমি তৈরি করা হয়।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষের কৃষক আন্দোলন ছিল সাধারণভাবে নরমপন্থী। গোড়ারদিকে আন্দোলনকারীরা জমিদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদ দাবি করেনি বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা তাদের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তারা জমিদার ও সরকারকে ন্যায্য খাজনা ও রাজস্ব দিতে রাজি ছিল, তারা চেয়েছিল করভার ও ঋণভার থেকে মুক্তি, জমির অধিকার এবং সামন্ততান্ত্রিক কর ও শোষণ থেকে অব্যাহতি। স্বাধীনতার প্রাক্কালে কৃষকদের দাবিগুলি আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়। কৃষক আন্দোলন ক্রমশ জঙ্গিবাদী হয়ে উঠতে থাকে। তাদের দাবির চরিত্রও পালটে যায়। কৃষকরা দাবি করেছিল জমিদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদ, জমির অধিকার এবং ন্যূনতম মজুরি। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলও তারা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল।
কৃষক আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতি হল কৃষকের অধিকারবোধ, চেতনার উন্মেষ ও প্রসার। সারা ভারতের কৃষকরা জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় জাতীয় আন্দোলন জনগণতান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। প্রত্যেক কংগ্রেস অধিবেশনে কৃষকরা বিপুল সংখ্যায় যোগ দিতে থাকে। গান্ধিজি নিজেই লিখেছেন যে কৃষকদের জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেবার ফলে ভারতের স্বরাজ সাধনা সহজতর ও নিকটতর হয়েছে। গান্ধিজি শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলন পছন্দ করতেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল কৃষক আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হলে সরকার পক্ষ থেকে যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হবে তার ফলে নিরস্ত্র কৃষকেরই বেশি ক্ষতি হবে।
অনেকে বলেছেন যে কৃষক আন্দোলনের মধ্যে জঙ্গিবাদী প্রবণতা রোধ করার জন্য গান্ধিজি উদ্যোগী হয়েছিলেন। এরকম পরিস্থিতিতে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব চরমপন্থীদের হাতে চলে যাবার সম্ভাবনা ছিল, কংগ্রেস নেতৃত্ব তা চায়নি। পরিশেষে বলা যায়, সর্বভারতীয় কিষান সভা বা কংগ্রেস পরিচালিত জাতীয় আন্দোলন এদেশের ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষি, বর্গাদার বা ভূমিহীন কৃষকদের অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। জাতীয় আন্দোলনের এই দুর্বলতা ও অপূর্ণতা পরবর্তীকালে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বহু সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।