তাইপিং ও বক্সার বিদ্রোহের তুলনামূলক আলোচনা কর ।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চিনের ইতিহাসে দুটি বড়ো রকমের বিদ্রোহের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়—তাইপিং (১৮৫০-১৮৬৪) ও বক্সার (১৮৯৯-১৯০১)। ১৮৩১ ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল হল পশ্চিমি অভিঘাত ও চিনা প্রতিক্রিয়ার পর্ব। এই সময়কালে চিনে পশ্চিমি অনুপ্রবেশের তীব্রতা বেড়েছিল। আফিম যুদ্ধের পর পশ্চিমি দেশগুলি চিনের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তার কাছ থেকে অতিরাষ্ট্রিক অধিকার, সর্বাধিক অনুগৃহীত দেশের মর্যাদা ও শুল্ক ক্ষেত্রে ছাড় আদায় করে। নিয়েছিল। চিনের অভ্যন্তরে বিদেশিদের অনেকগুলি উপনিবেশ স্থাপিত হয়, চিন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে এক আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশে পরিণত হয়। বিদেশিরা চিনের অভ্যন্তরে চার্চ বানিয়ে ধর্ম প্রচারের অধিকার পেয়েছিল। অনেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
চিনের বিদেশি মাঞ্চু রাজবংশ দেশকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারিনি। দেশের শাসক গোষ্ঠী সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে কৃষক ও দরিদ্র মানুষদের রক্ষা করতে পারেনি। মাঞ্চুরা ছিল বিদেশি তাতার বংশের লোক, চিনাদের সঙ্গে তাদের জাতিগত মিল ছিল না। চিং রাজবংশের শাসনকালে সর্বদা এই রাজবংশ বিরোধিতা ছিল। এই বিরোধিতা বেড়েছিল কারণ মাঞ্চু শাসকগোষ্ঠী জাতি বৈষম্যকে অনুসরণ করত, আমলাতন্ত্রের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড দুর্নীতি আর জনগণের দুঃসহ করভার। জমির ওপর মাত্রাতিরিক্ত কর স্থাপন করা হয়, জনসংখ্যা বেড়ে চলেছিল, সেই অনুপাতে উৎপাদন বাড়েনি, কৃষির সম্প্রসারণ ঘটেনি। সংখ্যালঘু জাতিগুলির প্রতি বৈষম্য ছিল, বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে আয় কমেছিল, ঘাটতি বেড়েছিল। দেশের সর্বত্র নৈরাজ্য চলেছিল, কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হলে আঞ্চলিক শক্তি সবল হয়ে উঠেছিল। এই পটভূমিকায় উনিশ শতকের মধ্যভাগে চিনে তাইপিং বিদ্রোহ হয়। চিনের দক্ষিণাঞ্চল হল বিদ্রোহের উর্বর ক্ষেত্র; এখানে মাঞ্চু শাসন অনেক দেরিতে স্থাপিত হয় এবং সেই শাসন যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না।
অষ্টাদশ শতকে চিনের দক্ষিণাঞ্চলে জনসংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে চলেছিল, এই অঞ্চলের ওপর বিদেশিদের অভিঘাত পড়েছিল। চিনের পূর্ব ও দক্ষিণ উপকূলে বিদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি স্থাপিত হয়, শহর গড়ে ওঠে। আফিম যুদ্ধের পর চিনের প্রথাগত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, চিনা কারিগর ও শিল্পীরা দুর্দশার মধ্যে পড়ে যায়। কৃষকরাও ভালো ছিল না, তাদের জমির অধিকার ছিল না, ভূস্বামীরা তাদের ওপর অধিক হারে খাজনা বসিয়েছিল। অনেকে ভূমি থেকে উৎখাত হয়েছিল। এই অঞ্চলে অনেকগুলি গুপ্ত সমিতি সক্রিয় ছিল, ছিল চোরাকারবারি ও জলদস্যুরা। এদের নিয়ে হুং শিউ চুয়ান তাঁর ‘তাইপিং তিয়েন কুয়ো’ বা মহাশান্তিময় ঈশ্বরের রাজত্ব স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন কোয়াংটুং প্রদেশের হোয়া জেলার বাসিন্দা। তিনি ‘সান দিয়েন হুই’ নামে ঈশ্বর ভক্তদের এক সমিতি গঠন করেন। প্রচার করেন জিহোবা হলেন বিশ্বপিতা, যিশু ও তিনি তাঁর পুত্র। তিনি তাইপিং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে উপাধি নেন তিয়েন ওয়াং বা বিশ্বপতি। নানকিং শহরে তিনি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন, চোদ্দ বছর ধরে তিনি এই আন্দোলন টিকিয়ে রেখেছিলেন, সম্রাটের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেন।
হুং শিউ চুয়ান ন্যায় ও সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নতুন সমাজ গঠনের কথা বলেন। তাদের প্রচারিত ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কিত দলিলে তাইপিং নেতাদের সামাজিক কথা জানা যায়। জমির মালিকানা হল রাষ্ট্রের, প্রয়োজন অনুযায়ী প্রত্যেক কৃষক জমি পাবে। প্রাচীন চিনের ঐতিহ্যে কৃষকের কল্পরাজ্যের ধারণা ছিল, সেই প্রাচীন ঐতিহ্যকে হুং বাস্তবে রূপায়িত করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। সমর্থকদের বেশিরভাগ ছিল কৃষক, নিম্নবর্গের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষরাও তাঁর আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। বিক্ষুব্ধ কৃষক ও গুপ্ত সমিতির সদস্যরা তাঁর আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। তিনি বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, বিধবা, অনাথ শিশুদের আশ্রয় ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেন। সৈন্যবাহিনী ও সরকারি চাকরিয়ে তিনি মহিলাদের প্রবেশের অধিকার দেন। আইন করে তিনি মেয়েদের পদবন্ধন, গণিকাবৃত্তি ও পুরুষের বহুপত্নী গ্রহণ নিষিদ্ধ করে দেন। সব ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা হয়েছিল।
তাইপিং বিদ্রোহ শুধু কৃষক বিদ্রোহ ছিল না, সমস্ত স্তরের শোষিত মানুষ এতে যোগ দিয়েছিল। কৃষকের স্বার্থ রক্ষার কথা বলা হলেও কৃষি বিপ্লব ঘটানোর কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তাইপিং বিদ্রোহ শুধু কৃষকের অভিযোগ নিয়ে গড়ে ওঠেনি, এর মধ্যে সনাতন সমাজব্যবস্থার বিরোধিতা ছিল, কনফুসীয় সমাজব্যবস্থাকে আক্রমণ করা হয়। তাইপিং বিদ্রোহের নেতারা সকলে খ্রিস্টান ছিলেন। তাইপিং বিদ্রোহের সময় খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার চলেছিল, চিনের রক্ষণশীল মানুষ অবশ্যই তা পছন্দ করেনি। তা সত্ত্বেও এই আন্দোলন বিরাট আকারে দেখা দিয়েছিল, চিনের দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছিল এই বিদ্রোহ। এর প্রচণ্ড গতিবেগ শাসকগোষ্ঠীকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, প্রায় সারা দেশের ওপর এর প্রভাব পড়েছিল। এই আন্দোলন, এর প্রচণ্ড গতি ও মাঞ্চু বিরোধিতার জন্য চিন পশ্চিমি অভিঘাতের ঠিকমতো মোকাবিলা করতে পারেনি। জাপানের তুলনায় পশ্চিমি অভিঘাতের চিনা প্রতিক্রিয়া ছিল অবশ্যই মন্থর।
বক্সার আন্দোলন ছিল একটি স্বল্পকাল স্থায়ী ঘটনা। পশ্চিমি ঐতিহাসিকরা একে ‘গ্রীষ্মকালের পাগলামি’ বলে উল্লেখ করেছেন।” দুবছরের মধ্যে এই বিদ্রোহ বিদেশিরা দমন করেছিল। বিদেশিরা গোড়ার দিকে তাইপিং বিদ্রোহের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন হলেও শেষদিকে এই বিদ্রোহ দমনে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। বক্সার বিদ্রোহ ছিল প্রধানত বিদেশি খ্রিস্টান মিশনারি বিরোধী। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টান মিশনারিরা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শিক্ষা ও পরিষেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের পক্ষ নিয়ে এবা সামাজিক বিরোধে হস্তক্ষেপ করত, ক্ষতিপূরণ আদায় করত। মাঞ্চু শাসকগোষ্ঠী খ্রিস্টান মিশনারিদের বিরাগভাজন হতে চাইত না, এতে পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল।
চিনের মানুষ বিদেশিদের দেখেছিল প্রধানত মিশনারি রূপে। এদের কার্যকলাপ চিনাদের ভালো লাগেনি কারণ এরা চিনের। প্রথাগত ধর্ম ও আচার-আচরণকে আক্রমণ করত। গ্রামীণ ভূস্বামী জেন্ট্রিদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, চার্চ ও যাজকরা গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র রূপে গড়ে উঠতে থাকে। গুপ্ত সমিতিগুলি চার্চ পোড়াতে থাকে, মিশনারিদের হত্যা শুরু হয়ে যায়। গোড়ার দিকে বক্সার আন্দোলন মাধু বিরোধী ছিল। তারা বিদেশিদের আক্রমণ করে, পশ্চিমি শক্তির সঙ্গে সংঘাত বাধিয়ে মাথুদের উৎখাত করতে চেয়েছিল। আন্দোলনের একটি পর্যায়ে রাজদরবারের গোপন সমর্থন পেয়ে তারা মাণ্ডু বিরোধিতা ত্যাগ করে বিদেশি বিরোধিতাকে প্রধান লক্ষ্য করেছিল। আই-হো-চুয়ান নামক মুষ্টিযোদ্ধাদের ন্যায়পরায়ণ সমিতি এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের এই দুই বিদ্রোহের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি ছিল। মিল হল গোড়ার দিকে উভয়ে মাঞ্চু রাজবংশকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল, উভয় আন্দোলন গুপ্ত সমিতিগুলির সমর্থনের ওপর নির্ভর করেছিল। উভয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল। তাইপিংরা মাধু বিতাড়ন ও বক্সাররা বিদেশি বিতাড়নের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছোতে চেয়েছিল। এদের অনুগামীরা ছিল প্রধানত কৃষক আর নিম্নবর্গের দরিদ্র মানুষ, শোষিত নিপীড়িত দরিদ্ররা এই দুই আন্দোলনের শক্তি জুগিয়েছিল। তাইপিংরা বিদেশি বিরোধিতায় নামেনি, বরং বিদেশিদের সহযোগিতা লাভের চেষ্টা করেছিল। বক্সাররা বিদেশি খ্রিস্টান মিশনারিদের তাড়িয়ে চিনকে সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত করতে চেয়েছিল, মিশনারিদের সাম্রাজ্যবাদের প্রতীকরূপে গণ্য করা হয়।
তাইপিং আন্দোলন ছিল চিনের বেশিরভাগ অঞ্চল জুড়ে, চলেছিল চোদ্দ বছর। অপরদিকে বক্সার বিদ্রোহ ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক এবং মিশনারি অধ্যুষিত অঞ্চল ঘিরে চলেছিল মাত্র দু’বছর। একটি হল গ্রামীণ, অপরটি শহুরে আন্দোলন; বক্সার বিদ্রোহ ছিল রক্ষণশীল, প্রগতি বিরোধী, এরা তন্ত্র-মন্ত্রে বিশ্বাস করত, অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রয়োগ করে এরা বিদেশিদের পরাস্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। এদের কর্মপদ্ধতি ছিল। অবাস্তব, যুগের সঙ্গে সংগতিহীন, অপরদিকে তাইপিং বিদ্রোহীরা ছিল প্রগতিশীল, প্রথাগত সমাজব্যবস্থার বিরোধী। অত্যাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণের মানসিকতা তাদের ছিল, বক্সাররা পুরোনো পন্থায় বিশ্বাস রেখেছিল।
তাইপিং ও বক্সার বিদ্রোহের সংগঠন ও কর্মসূচির মধ্যেও বিরাট পার্থক্য ছিল। তাইপিং বিদ্রোহীরা একটি বিকল্প রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার কল্পনা করেছিল, এই উদ্দেশ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। কর্মসূচিকে রূপায়িত করার জন্য তারা দক্ষ সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তাইপিং রাজ্যকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, এদের ইতিবাচক কর্মসূচি ছিল, উপযুক্ত সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল। বক্সারদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পুরোপুরি নেতিবাচক, বিদেশিদের হত্যা ও বিতাড়ন ছাড়া তাদের অন্য কোনো কর্মসূচি ছিল না। চিনের পুরোনো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌল ত্রুটি দূর করার জন্য তারা কোনো চিন্তাভাবনা করেনি, কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য কোনো সংগঠনও তারা গড়ে তুলতে পারেনি। বিদেশি বিরোধী আন্দোলনকে সফল করতে হলে যে ধরনের ঐক্যবদ্ধ সংগঠন ও নেতৃত্বের দরকার ছিল তা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। দুটি বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত দমিত হয়, কিন্তু তাইপিং বিদ্রোহ গভীর ও স্থায়ী প্রভাব রেখে যায়। শাসকগোষ্ঠী নানাধরনের সংস্কার প্রবর্তন করে শাসিত জনগণের দুর্দশা লাঘব করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল। বক্সার বিদ্রোহ এধরনের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখতে পারেনি, তবে জনগণ বক্সার বিদ্রোহ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে বিদেশিরা নয়, দেশের আসল শত্রু হল চিং রাজবংশ। এই সময় থেকে চিং রাজবংশের উৎখাত পরিকল্পনা বাস্তব রূপ নিতে থাকে। দেশপ্রেমিকরা ড. সান ইয়াৎ-সেনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়, এক দশকের মধ্যে মাধু রাজবংশের পতন ঘটে।