তাইপিং বিদ্রোহের কারণ গুলি আলোচনা করো। তাইপিং বিদ্রোহের পটভূমি বা প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।
সূচনা :
তাইপিং বিদ্রোহের সূচনা হয় দক্ষিণ চীনের কোয়াংসি প্রদেশে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে। নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন দক্ষিণ চীনের কোয়াংটুং (kwangtung) প্রদেশের হাক্কা চাষী পরিবারের হুং শিউ-চুয়ান (Hung Hsiu-Chuan, ১৮১৪-১৮৬৪)। তাঁর পূর্বসূরীরা উত্তর চীন থেকে দক্ষিণ চীনে অভিযান করে কোয়াংসি প্রদেশে বসতি স্থাপন করে। বালক হিসেবে হুং অহংকারী ও অস্থিরচিত্ত হলেও শিক্ষায় যথেষ্ট সম্ভাবনার পরিচয় দেন। তাঁর শিক্ষক ও পরিবারের বয়ঃজ্যোষ্ঠদের আশা ছিল যে সে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার উত্তীর্ণ হয়ে বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
এই সময় কনফুসীয় কল্পনাবাদের (utopianism) প্রতি হুং-এর যেমন গভীর আস্থা জন্মেছিল তেমনি মাথু অপশাসনের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।১৮৩৭ থেকে ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এই দুই বছর হুং গ্রামের শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন।তিনি প্রচার দ্বি চালান যে চীনাবাসীকে অপশক্তির কবল থেকে বাঁচানোর জন্য ঈশ্বর তাঁকে দৈবশক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। দানব শক্তিকে ধ্বংস করে চীনে ঈশ্বরের রাজ্য (Kingdom of God) প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। কিছু দিনের মধ্যেই হাক্কা, মিয়াও এবং ইয়াও সম্প্রদায়ভুক্ত দরিদ্র হতাশগ্রস্ত কৃষক ও জাতীয়তাবাদী চীনারা তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। ১৮৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দের মহা দুর্ভিক্ষের সময় “Heaven and Earth Society-র সদ্যসরা দরিদ্রদের সাহাযার্থে ধনীদের লুন্ঠনের অজুহাত দিয়ে কোয়াংসিতে বিদ্রোহ করে। ঈশ্বর পূজারীরা এই বিশৃঙ্খলার দ্বারা লাভবান হয়েছিল।
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জানুয়ারী হুং-এর ৩৭ তম জন্ম দিনে তাইপিং বিদ্রোহের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়। হুংকে (Hung) নবপ্রতিষ্ঠিত মহা শান্তির স্বর্গীয় রাজ্যের স্বর্গীয় রাজা হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
তাইপিং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গুপ্ত সমিতিগুলির সংযোগ ছিল, বিশেষ করে ট্রায়াড (Triad) জাতীয় গুপ্ত সমিতির সদস্যরা ঈশ্বরপূজারীদের সঙ্গে যোগ দেয়। রাজনৈতিক দিক থেকে তাইপিং বিদ্রোহীরা মিং রাজবংশের সমর্থক ছিলেন। তাঁরা চিং বা মাঞ্চুবংশের উচ্ছেদ ঘটিয়ে মিং বংশকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাই তারা প্রাকৃ মাঞ্চু যুগের কেশ-বিন্যাস গ্রহণ করেন এবং মস্তকের অগ্রভাগ মুণ্ডিত না করে লম্বা কেশ রাখেন। তাই তাঁরা দীর্ঘকেশ দস্যু বা দীর্ঘকেশ বিদ্রোহী নামে পরিচিত হন। তাইপিং বাহিনী প্রবল বিক্রমে মাঞ্চু রাজ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের হটিয়ে দেয়। এই সময় হুং-এর প্রধান সহযোগীদের রাজা উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
তাইপিং বিপ্লবীরা প্রায় সকলেই শোষিত শ্রেণী থেকে এসেছিলেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন দরিদ্র কৃষক কাঠকয়লা প্রস্তুতকারক, কূলী, খনি মজুর এবং প্রাক্তন জলদস্যু। তাইপিং বিদ্রোহীরা কোয়াংসি থেকে হিউনান, হুপে, নানকিং প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
তাইপিং বিপ্লবীরা প্রায় সকলেই শোষিত শ্রেণী থেকে এসেছিলেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন দরিদ্র কৃষক কাঠকয়লা প্রস্তুতকারক, কুলী, খনি মজুর এবং প্রাক্তন জলদস্যু। তাইপিং বিদ্রোহীরা কোয়াংসি থেকে হিউনান, হুপে, নানকিং প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহ চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত হয়।
• সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ
ঐতিহ্যগতভাবে চীনারা এই তত্ত্বে বিশ্বাসী যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে শিথিলতা বা ব্যর্থতা দেখা দিলেই দেশ বৈদেশিক আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে চিং সরকারের দুর্বলতা এবং চীনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে অক্ষমতাই দেশকে পাশ্চাত্য আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মুখে ঠেলে দেয়। শাসক শ্রেণী শক্তিশালী ও দক্ষ হলে বলিষ্ঠ হস্তে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করতে পারতেন এবং পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ রোধ করতে পারতেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে মাঞ্চু শাসকদের মধ্যে সেই দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টি লক্ষ্য করা যায়নি।
উত্তরাধিকার সূত্রেই মাঞ্চুশাসকেরা বহুদিনের দৃঢ় প্রোথিত আর্থ-সামাজিক সমস্যা বয়ে নিয়ে এসেছিলেন যা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহকে অনিবার্য করে তুলেছিল। মধ্য ঊনিশ শতকের প্রায় দু হাজার বছর আগে থেকে চলে আসা চীনের সামাজিক কাঠামো ও উৎপাদন পদ্ধতি প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। কৃষিভিত্তিক চীনা সমাজের সামাজিক শৃঙ্খলা অনেকাংশেই নির্ভর করত ভূমির যথাযথ বন্টনের উপর। দেশের বিদ্রোহ জনিত কারণে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হ’লে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু লোকের প্রাণনাশ হলে যে জনসংখ্যা হ্রাস পেত তার ফলে মাথাপিছু ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। আবার শান্তি ফিরে এলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মাথা পিছু জমির পরিমাণ কমে যেত।
দারিদ্র্য ক্লিষ্ট জনগণ তখন তাদের হতাশা মোচনের জন্য দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করত অথবা বিদ্রোহে অংশ নিত। চীনের ইতিহাসে এইভাবে প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা পর্যায়ক্রমে শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে ভূমি ও মানুষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষিত হত। ইম্যানুয়েল সু-এর ভাষায় “the alteration of order and disorder was nature’s way of maintaining social equilibrium, and the Chinese had been at the mercy of this process since time immemorial” চীনা দার্শনিক মেনশিয়াস (Mencius; 373-288 BC) বলতেন যে বিশৃঙ্খলার যুগের শেষে শৃঙ্খলার যুগের আগমন ঘটে এবং চীনারা বিশ্বাস করত প্রতি তিরিশ বছর অন্তর ছোট বিশৃঙ্খলা এবং প্রতি একশ বছর অন্তর বড় বিদ্রোহ ঘটবে।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গ এই ঘটনাকে ‘dynastic circle’ আখ্যা দিয়েছেন। যদিও বাস্তবে এটা ছিল “ইতিহাসের প্রাকৃতিক বিবর্তন” (natural evolution of history)। সম্রাট কাং শি (Kang Shi), ইয়ং চেং (Yung Cheng) এবং চিয়েন লুং (Chien lung)-এর ১৫০ বছরের রাজত্বকালের শান্তিশৃঙ্খলা চীনে যে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল সেই অনুপাতে মাথাপিছু আবাদী জমির পরিমাণ বৃদ্ধি হয়নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ভূমি বৃদ্ধির অনুপাতের এই বৈপরিত্যের কারণেই মাথাপিছু ভূমিচাষ অত্যধিক হ্রাস পায়। ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে যেখানে প্রাপ্ত ৭০৮ মিলিয়ন মৌ জমি মাথাপিছু ৩.৮৬ মৌ হিসেবে বন্টিত হয় সেখানে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ৭৯১ মিলিয়ন জমি মাথাপিছু ২.১৯ মৌ হারে বন্টিত হয়। ১৮১২-৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ হ্রাস পেলে মাথাপিছু আবাদী জমির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১.৮৬ মৌ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনিত ব্যক্তি মালিকানার ভূমি সংকোচন কৃষকদের দুর্দশা বাড়িয়ে ছিল। ছোট জমির উৎপাদন কৃষকের জীবন ধারনের উপযোগী না হলে সে তা বিক্রি করতে বাধ্য হত। এইভাবে কৃষক জমিদারের ভাড়াটে চাষীতে রূপান্তরিত হত এবং ধনী জমিদার শ্রেণীর জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে চিলির হো পরিবার এইভাবে ১ মিলিয়ন মৌ জমির মালিক হয়েছিল যা চীনের চাষযোগ্য জমির ১/৭০০ ভাগ ছিল। শুধু জমিদার শ্রেণী-ই নয়, ধনী বণিক, কুসীদজীবী বন্ধক গ্রহীতারাও প্রচুর জমির মালিক হয়। এর ফলে জমির দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। মাঞ্চু শাসনের প্রথম পর্বে যেখানে ১ মৌ জমির দাম ১ অথবা ২ টেইল (tael) ছিল তা তাঁদের রাজত্বকালের মধ্যপর্বে বৃদ্ধি পেয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৭ অথবা ৮ টেইল।
দেশের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জমি ছিল ধনী পরিবারগুলির হাতে। আরও ১০ শতাংশ জমি ব্যানারমেন এবং সরকারী ডিপ্লাগুলির অধীন ছিল। এর ফলে বাকী ৩০ শতাংশ জমি ৪০০ মিলিয়ন লোকের জন্য বরাদ্দ ছিল। ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ লোকের কোন জমিই ছিল না। এই ভূমিহীন চাষীদের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা। তারা কুসীদজীবীদের শোষণের শিকার হয়। ভূমিচ্যুত জনগণ আশ্রয় নেয় শহরে বন্দরে কুলি, মজুর, ডক-শ্রমিক এবং জাহাজের খালাসি হিসেবে। চীনে বৃহৎ কলকারখানা অথবা বড় উদ্যোগপতি থাকলে এই উদ্বৃত্ত জনগণকে গঠনমূলক কাজে নিয়োগ করা যেত। কিন্তু তা না থাকায় হতাশাগ্রস্ত বেকারশ্রেণী বিদ্রোহের আশ্রয় নেয়। চীনের কৃষকশ্রেণী এই সময় প্রায় ভূমিদাসের পর্যায়ে নেমে আসে। এই সর্বহারার জনস্রোতই (floating population of paupers) চীনে বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
• আফিম যুদ্ধের ফল
আফিম যুদ্ধের ফলে যে পরপর বন্দরের উন্মুক্তি ঘটে তা চীনে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বাড়িয়ে তোলে এবং চীনাদের জাতীয় জীবনে নেমে আসে এক অর্থনৈতিক সঙ্কট। এই যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের ফলে নানাকিং-এর সন্ধিতে আফিম ব্যবসা নিষিদ্ধ হয়নি; ফলে লাভজনক এই ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটে। উন্মুক্ত নতুন বন্দরগুলি দিয়ে আগত বিদেশী পণ্য চীনের বাজার ছেয়ে ফেলে। ফ্যাক্টরিজাত বিদেশী সূতি বস্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় চীনের হস্তশিল্প পেরে ওঠেনি। কর্মচ্যুত হতাশ দেশীয় শিল্পী কারিগর শ্রেণী: তাই বিদ্রোহের আশ্রয় নেয়। আফিমের বিনিময়ে চীন থেকে প্রভূত রৌপ্য বিদেশে চলে যাওয়ায় রৌপ্যমুদ্রা ও তাম্রমুদ্রার বিনিময় মূল্যে বিরাট তারতম্য দেখা দেয়। আফিমের চোরাই চালানের বৃদ্ধির ফলে এই বিনিময় মূল্যের বৃদ্ধি ১০০ শতাংশেরও বেশী হয়েছিল। চাষী, কারিগর শ্রেণী ও শ্রমজীবীদের ঘাড়ে বাড়তি করের বোঝা চাপে। কারণ তাদের মজুরী বা উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পেতেন তাম্র মুদ্রায়। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কর বৃদ্ধির পরিমাণ ৩৩ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে জনগণের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
• প্রশাসনিক দুর্নীতি
তাও কুয়াং (Tao Kuang ১৮২১-৫০) -এর রাজত্বে চীনের রাজনৈতিক অবস্থা শুধু দুর্নীতিপূর্ণই ছিল না অতীতের সুদিনের সুব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার এক কৃত্রিম প্রয়াসও লক্ষ্য করা যায়। সরকারী কাজে নিষ্ঠার অভাব, অনিশ্চয়তা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। জনকল্যাণের কোনো পরিকল্পনাই তখন গৃহীত হয়নি। উপরন্তু মোটা টাকার বিনিময়ে যথেচ্ছভাবে সরকারী পদগুলি বিক্রি করা হত। ৩০০০ টেইলের বিনিময়ে ম্যাজিস্ট্রেটের পদ বিক্রি হত। যোগ্যতার পরীক্ষা না দিয়ে অর্থের বিনিময়ে যে ব্যক্তি ঐ পদে বসতেন, স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনিক উন্নতির পরিবর্তে অর্থ পুনরুদ্ধার করাই তার মূল লক্ষ্য হত। এর ফলে চীনা প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা লোপ পায়।
• সামরিক অবক্ষয়
দুর্নীতি ও অদক্ষতা সামরিক বাহিনীকেও স্পর্শ করে। মাঞ্চু বংশের ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে যে ব্যানারমেনদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, দীর্ঘদিন ধরে তাদের দৈহিক ও নৈতিক অপকর্ষতা লক্ষ্য করা যায়। আফিমের যুদ্ধে পাশ্চাত্য শক্তির কাছে চীনের পরাজয় তার সামরিক দুর্বলতা প্রকাশ করে। চীনা সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। সাধারণ সেনা তাদের অধিকর্তাদের নির্দেশ অমান্য করতে শুরু করে। সম্রাট কাংশির সময়কাল থেকেই মাধু সেনাবাহিনীর অবক্ষয় এই পর্যায়ে এসেছিল যে তারা তিন সামন্তের (Three Feudatories -1673-81) বিদ্রোহ দমনে অক্ষম হয় এবং মাঞ্চু রাজদরবারকে Green Standard Army-র উপর নির্ভরশীল হতে হয়। ১৭৯৬-১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে White Lotus বিদ্রোহের সময় Green Standard সেনাবাহিনী তার দক্ষতা হারায় এবং মাধু সরকারকে স্থানীয় সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভর করতে হয়। মাঞ্চু সেনাবাহিনীর এই ক্রমান্বয়িক অবক্ষয় বিশেষত আফিমের যুদ্ধে পরাজয় বহির্জগতে এবং দেশের অভ্যন্তরে মাঞ্চু শাসকদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। এর ফলে গুপ্ত সমিতিগুলি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী চীনারা মাঞ্চুশাসন বিরোধী জাতীয়তাবাদী বিপ্লব সংগঠিত করতে উৎসাহিত হয়।
• প্রাকৃতিক বিপর্যয়
চীনের আর্থ-সামাজিক সংকট, সামরিক ও প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতির সঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যুক্ত হয়ে চীনে বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। তাইপিং বিদ্রোহের পূর্ববর্তী এক দশক (১৮৪০ থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের যুগ-এর মধ্যে ১৮৪৭ সালে হোনানের খরা, হুপে (Hupeh), আনহউই (Anhewi), কিয়াং সু (Kiangsu) এবং চেকিয়াং (Chekiang) – এ ইয়াংসি নদীর প্লাবন, ১৮৪৯-এ কোয়াংসিতে দুর্ভিক্ষ এবং পীত নদীর দক্ষিণ থেকে উত্তরে সান্টুং-এ গতি পরিবর্তন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি সাহায্যের অপ্রতুলতা গরীব জনগণের কষ্ট লাঘব করতে পারেনি। দুঃখ মোচনের জন্য বেপরোয়া জনগণ তাই বিদ্রোহের আশ্রয় নেয়।
• বিদ্রোহপ্রবণ দক্ষিণ চীন
নানা কারণে দক্ষিণ চীন বিদ্রোহ প্রবণ হয়ে উঠেছিল। প্রথমত চীনের এই দক্ষিণাংশ ছিল মাঞ্চু শাসকদের শেষ বিজিত এলাকা এবং চীনের শাসনকেন্দ্র পিকিং থেকে এর দূরত্ব ছিল অনেক। এর ফলে এই অঞ্চলে বিদেশী প্রভাব গভীরভাবে অনুভূত হয়। আফিমের যুদ্ধের পর পাশ্চাত্য ব্যবসার কেন্দ্র সাংহাইতে স্থানান্তরিত হ’লে ক্যান্টনের চা ও রেশম পরিবহনের এবং জাহাজে মাল চালানের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরা কর্মচ্যুত হয়। দ্বিতীয়ত দক্ষিণের অধিবাসীদের আর্থিক সংকট দেশীয় এবং অতিথি বাসিন্দা বা ‘হাক্কা সম্প্রদায়ের সংঘাতে জটিল আকার ধারণ করে। আদিতে ‘হাক্কা’ সম্প্রদায় মধ্য চীনের অধিবাসী ছিল যারা সুং (১১২৭-১২৭৮ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে বর্বর আক্রমণের ভয়ে দক্ষিণে কোয়াংটুং এবং কাংসি প্রদেশে অভিপ্রয়াণ করে। হাক্কা সম্প্রদায়ের বিশেষ আচার ব্যবহার, ভিন্ন ভাষা ও জীবনধারা স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে সংমিশ্রণের প্রধান অন্তরায় ছিল। তাছাড়া তারা খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত ছিল। এই বিভিন্নতার জন্য তারা সমাজ বহির্ভূত বিশেষ গোষ্ঠীরূপে চিহ্নিত হয়েছিল যাদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের প্রায়শই সংঘাত বাধত। হাক্কা সম্প্রদায় স্থানীয় অধিবাসীদের কুসংস্কারপূর্ণ মনোভাবের জন্য তাদের আক্রমণ করত। আর স্থানীয় অধিবাসীরা হাক্কা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিভিন্নতাকে ঘৃণা করত। গভীর সামাজিক শিকড় বিহীন এই ‘হাক্কা’ সম্প্রদায় স্থানীয়দের চেয়ে স্বভাবে স্বাধীনচেতা ও সাহসী ছিল। তাদের প্রধান পেশা ছিল চাষবাস, কাঠকয়লা তৈরী ও খনির কাজ। এই শ্রেণী থেকেই তাইপিং নেতৃবৃন্দ তাঁদের অনুচরদের সংগ্রহ করে। দক্ষিণ চীন এইভাবে বিদ্রোহের সূতিকাগারে পরিণত হয়।
• তাইপিং আদর্শ এবং প্রতিষ্ঠান
তাইপিং বিদ্রোহীদের কল্পরাজ্য ছিল ধর্মরাষ্ট্র (theocracy), যেখানে ধর্ম, সামরিক ও অসামরিক প্রশাসন, সংস্কৃতি ও সমাজ সবই ছিল একই সূত্রে গাঁথা। ধর্ম ভিত্তিক এই রাজ্যের রাজধানী ছিল স্বর্গীয় রাজধানী, নেতা হলেন স্বর্গীয় রাজা, রাজপ্রাসাদ হল স্বর্গীয় প্রাসাদ, রাজ নির্দেশ হ’ল স্বর্গীয় ঘোষণা এবং রাজকোষ হল স্বর্গীয় রাজকোষ। আফিম, তামাক ও মদের নেশা, গণিকা বৃত্তি, পদবন্ধন, দাস-বিক্রয়, জুয়া এবং বহু বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। আন্দোলনের আদিপর্বে তাইপিং নেতাদের মধ্যে যে বিশুদ্ধবাদী প্রেরণা ও ধর্মীয় উন্মাদনা ছিল তা তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে। তাইপিং রাষ্ট্রের প্রাথমিক দলিল হল স্বর্গীয় রাজ্যের ভূমি ব্যবস্থা (The Land system of the Heavenly Kingdom) যা ভূমিব্যবস্থা ছাড়াও সামরিক, অসামরিক, আর্থিক, বিচার বিভাগীয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও আলোকপাত করে। বস্তুত এটা ছিল তাইপিংদের সংবিধান।
তাইপিং আদর্শের এক অভিনব দিক হল ব্যক্তিগত ভূমি ও সম্পত্তির মালিকানার অবসান। এই আদর্শের প্রেরণা ছিল এই যে ঈশ্বরের সব সন্তানই তাঁর আশীর্বাদ পাবে এবং জীবনের সব অভাব থেকে মুক্ত হবে। তাই তার চাষের জন্য জমি থাকবে, আহারের চাল থাকবে, বসনের কাপড় থাকবে এবং খরচের জন্য অর্থ থাকবে। এই আদর্শবাদী রাষ্ট্রের লক্ষ্যে পৌছনোর জন্য তারা চীনের প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। তাইপিং বিদ্রোহীরা তাই উৎপাদনের মাপকাঠিতে চীনের জমিকে নটি শ্রেণীতে ভাগ করেছিল। আদিম সাম্যবাদী নীতির ভিত্তিতে তারা ভূমি বন্টন করে। জমি পরিবারের ভিত্তিতে বন্টিত হয়নি, একেকটি পরিবারের সভ্য সংখ্যার ভিত্তিতে বন্টিত হয়েছিল।
জমি বন্টিত হয়েছিল কৃষিকার্যের জন্য যার ওপর কারও ব্যক্তিগত মালিকানা ছিলনা। ফলে. জমি কেউ বিক্রি করতে পারবে না। ষোলো বছরের ঊর্ধ্বে সকল নারী পুরুষ সমপরিমাণ জমি পাবে। ষোলো বছরের কম বয়সীদের জন্য অর্দ্ধেক পরিমাণ জমি বরাদ্দ হয়। বণ্টিত জমিতে শুধু শস্য উৎপাদনেরই অধিকার দেওয়া হয় মালিকানা নয়। আর উদ্বৃত্ত শস্য শস্যাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে সঞ্চয় নিষিদ্ধ হয়।
ভূমির সম্প্রদায়গত ব্যবহারের উল্লেখ প্রাচীন চীনা গ্রন্থ “The Rites of Chou” এ পাওয়া যায়। তাইপিং বিদ্রোহীরা নিষ্ঠার সঙ্গে এই আদর্শ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেও নিরস্তর যুদ্ধ বিগ্রহ ও দেশের অশান্ত অবস্থার দরুন সংস্কারগুলি সীমিত ক্ষেত্রে কার্যকারী করা সম্ভব হয়।
তাইপিং সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের অন্যতম বিশেষত্ব হল এই দুইয়ের মধ্যে ঐক্য সাধন। এখানে সৈন্যরাই হল কৃষক এবং অফিসারদের সামরিক ও অসামরিক দ্বিবিধ দায়িত্ব পালন করতে হত। প্রতি ১৩,১৫৬ পরিবার পিছু একজন কমান্ডার নিযুক্ত হতেন, যার ওপরে পাঁচটি ডিভিসনের দায়িত্ব অর্পিত হত। প্রতিটি ডিভিসন আবার পাঁচটি ব্রিগেড নিয়ে গঠিত হত। প্রতিটি ব্রিগেড কমান্ডারের অধীনে পাঁচজন ক্যাপ্টেন থাকতেন যারা পাঁচজন মাস্টার সার্জেন্টদের নির্দেশ দিতেন। এই মাস্টার সার্জেন্টরা আবার পাঁচটি করপোরালের দায়িত্বে নিযুক্ত হতেন যাদের প্রত্যেকেই চারজন সৈন্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাইপিং সেনাবাহিনী তাই ১০,০০০ সৈন্য ও ৩১৫৬ জন অফিসার নিয়ে গড়ে উঠেছিল। তাইপিং ব্যবস্থায় সামরিক আধিকারিকরা আবার বেসরকারি প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত হতেন।
তাইপিং সমাজে প্রতি ২৫টি পরিবার নিয়ে একটি মূল একক তৈরী হত যার অধীনে এক গণ শস্যাগার ও গীর্জা থাকত এবং মাস্টার সার্জেন্ট এর পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। তিনি অসামরিক, শিক্ষা, ধর্ম, আর্থিক এবং বিচার সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন। এমনকি উল্লিখিত ২৫টি পরিবারের মামলা মোকদ্দমা, বিবাহ এবং অন্ত্যোষ্টিক্রিয়াদিও তিনি পরিচালনা করতেন। শান্তির সময় সৈন্যগণ এবং করপোরাল (Corporal) বা নিম্নপদস্থ আধিকারিকগণ বেসামরিক দায়িত্ব পালন করতেন। তাইপিং বিদ্রোহীরা পূর্বপুরুষদের পূজা বা উপাসনা নিষিদ্ধ করেন এবং মন্দির ও মূর্তি দেখলেই তা ধ্বংস করতেন।
ধর্ম ও সংস্কৃতির ঐক্যসাধন ছিল তাইপিং প্রতিষ্ঠান সমূহের এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক। তাইপিং রাজ্যে জনগণের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল খ্রিস্টান ভাবধারার প্রসার ঘটানো। হুং-এর ব্যাখ্যা নির্ভর বাইবেল শিশুদের জন্য সংকলিত হয়েছিল। স্রষ্টারূপে এবং রক্ষাকর্তা রূপে ঈশ্বর তথা যীশুর মহিমা প্রচার তাইপিং ধর্ম ও সংস্কৃতির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। বর্তমান কালের প্রগতিশীল লেখকেরা তাইপিংদের সহজ সরল লিখন শৈলীকে ১৯১০ এবং ১৯২০-র দশকের নব্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পূর্ব-রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাইপিং রাজ্যে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হত, তবে চিং যুগের পরীক্ষা ব্যবস্থার মত তাতে ধ্রুপদী লিখন শৈলীর প্রয়োজন ছিল না। সহজ সরল ভাষাই সেখানে ব্যবহৃত হত। পরীক্ষাতে বিষয়বস্তু কনফুসীয় সাহিত্য থেকে না নিয়ে বাইবেল, খ্রিস্টান পুস্তিকা এবং তাইপিং ইস্তাহার থেকে সংগৃহীত হত। নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীই এই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারতেন। তাইপিং পরীক্ষা পদ্ধতির মান খুব একটা কঠিন ছিল না। কথিত আছে হুপের কোন এক পরীক্ষায় ১০০০ জনের মধ্যে ৮০০ জনই উত্তীর্ণ হয়েছিল।
তাইপিংদের গৃহীত পঞ্জিকা চান্দ্র পঞ্জিকা ও সৌর পঞ্জিকার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। ৩৬৬ দিনে বিভক্ত বছরের অযুগ্ম মাসগুলি ৩১ দিনের এবং যুগ্ম মাসগুলি ৩০ দিনের ছিল। তাইপিং ক্যালেন্ডারের প্রথম বছরের ১লা জানুয়ারী ছিল ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী।
তাইপিং রাজ্যে স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল। সামরিক অসামরিক উভয় প্রশাসনের ক্ষেত্রেই নারীর সেবা প্রদানের অধিকার ছিল। জানা যায় হুং-এর বোনের নেতৃত্বে ১ লক্ষ মহিলা ও সেনা অফিসার ছিল। নানকিং-এ তাইপিংদের মহিলা আবাসিক হলগুলিতে (Women’s Residential Hall) অবিবাহিত মহিলা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত সৈনিকদের স্ত্রীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। হুং (Hung)-এর সুদক্ষ নেতৃত্বে সংগঠিত মহিলা বাহিনীর রাজপথে নিঃসঙ্কোচে বিচরণ নানকিং-এর খ্রিস্টান পাদ্রীদেরও মুগ্ধ করেছিল। তাইপিং রাজ্যে নারী স্বাধীনতা ছিল লক্ষ্য করার মত। দ্বাদশ শতকের নারীদের পদবন্ধনের কুপ্রথা এখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। গণিকা-বৃত্তি, দাসত্ব ও আফিম সেবন নিষিদ্ধ হয়। সবদিক থেকে তাইপিং সমাজ চিং বা মাঞ্চু বংশের তুলনায় উন্নত ছিল।
তাইপিং আন্দোলনের প্রথম পর্বে তাদের প্রচলিত খ্রিস্টীয় আদর্শ বিদেশীদের সহানুভূতির উদ্রেক করলেও তারা ক্যাথলিক বিরোধী ছিলেন। আবার প্রোটেস্টান্ট পাদ্রীদের তাদের কাছের মানুষ মনে করলেও তাইপিং রাজ্যে তাদের ধর্মপ্রচারের সুযোগ ছিল না। বিদেশী বণিকেরা আশা করেছিলেন যে তাইপিং রাজ্যে তাদের বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে; কিন্তু তাইপিংরা আফিম সেবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় বিদেশীরা এই লাভজনক বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া বিদেশীদের অতিরাষ্ট্রিক অধিকার নিয়ে তাইপিংদের সঙ্গে বিরোধ বাধে। অতিরাষ্ট্রিক অধিকার ভোগের সুবাদে বিদেশীরা চীনে বসবাস করেও নিজের দেশের আইনের অধীন ছিলেন যা তাইপিংরা দিতে নারাজ ছিল। তাদের নীতি ছিল তাইপিং রাজ্যে বসবাসকারী বিদেশীদের তাইপিং সরকারের আইন মানতে হবে। তাইপিং বিদ্রোহীরা চীনা জাতীয়তাবাদী অধিকারের ওপর জোর দিলে বিদেশীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাধে। বস্তুত তাইপিংদের মহান শাস্তির রাজ্য সম্পর্কে বিদেশীদের মিশ্র অনুভূতি ছিল। প্রাথমিক পর্বে বিদেশী রাষ্ট্রবর্গ তাই নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে।
প্রাথমিক পর্বে তাইপিং বিদ্রোহীরা অনেকটা সফল হয়েছিলেন। কারণ বিদেশী মাধু বংশের অপশাসনের বিরুদ্ধে এই জাতীয়দাবাদী সংগ্রাম চীনা সাধারণ জনগণের সমর্থন পেয়েছিল। চীনের গুপ্ত সমিতিগুলিও তাদের প্রভূত সাহায্য করেছিল। চীনবাসীকে মাঞ্চু অপশাসনের হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে তাইপিং বিদ্রোহের তিন প্রধান নেতা হুং শিউ-চুয়ান, ফেং উন-শান এবং ইয়াং শিউ চিং সংগ্রাম শুরু করেন।
মিং জাতীয়তাবাদী আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে নানকিং-এ তাদের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্রোহের প্রাথমিক পর্বের অভাবনীয় সাফল্য সেংকুয়ো ফানের সুদক্ষ নেতৃত্বে সংগঠিত হুনান বাহিনীর দ্বারা রুদ্ধ হয়ে যায়। সেং তাইপিং বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য সুপরিকল্পিত ভাবে সর্বাত্মক প্রয়াস চালান। সাংহাইয়ের ধনী চীনা ব্যবসায়ীরা তাইপিং বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে আমেরিকান ফ্রেডারিখ টাউনশেন্ড ওয়ার্ড-এর নেতৃত্বে একটি বিদেশী ভাড়াটে সৈন্য বাহিনী (mercenary) গড়ে তোলেন। এই বাহিনী বিদ্রোহ | দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ইতিমধ্যে ইংলন্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি বিদেশী রাষ্ট্রগুলি তাদের নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়ে তাইপিং বিদ্রোহ দমনে এগিয়ে আসে। এই সমবেত প্রচেষ্টার ফলে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মাঞ্চু বাহিনী নানকিং পুনর্দখলে সমর্থ হয়। এবং এর সাথেই তাইপিং বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
মূল্যায়ন :
দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ১৬টি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল — ধ্বংস হয়েছিল ৬০০ টিরও বেশী নগর। এই বিদ্রোহ পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের বিরুদ্ধে পরিচালিত না হলেও তারা আশঙ্কিত ছিলেন যে বিদ্রোহীরা সফল হ’লে সন্ধিব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে এবং তার বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই আমেরিকা ও ব্রিটেন তাইপিং বিদ্রোহ দমনের জন্য মাঞ্চু সরকারকে সাহায্য দানে এগিয়ে আসে। তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তাইপিং বিদ্রোহীরা পরাজিত হয় এবং বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।