তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করো
চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে তাইপিং বিদ্রোহের নেতা ও তার অনুগামীরা গঠন করেন ঈশ্বর ভক্তদের সমিতি (Society of God worshippers)। প্রথমদিকে হুং শিউ চুয়ানের দুজন প্রধান সহকর্মী হলেন ফেং উন শান ও ইয়াং শিউ চিং। কোয়াংসি প্রদেশের চিন তিয়েন ছিল তাদের প্রধান কার্যালয়। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তারা মাঞ্চু সরকারের সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়, ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ১১ জানুয়ারি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মহান শান্তির স্বর্গরাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেছিল (তাইপিং তিয়েন কুয়ো)। হুং হলেন স্বর্গরাজ্যের রাজা, অন্যরা হলেন তাঁর সহযোগী।
প্রথমের দিকে তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি ছিল মাঞ্চু-বিরোধী, অপশাসন-বিরোধী এবং সামন্ততন্ত্র-বিরোধী। চিনের ভূস্বামী জেন্ট্রিরা তাইপিং আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছিল। ক্ষমতা দখল করে হুং তাঁর প্রধান পাঁচজন সহযোগীর মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করেন (ফেং উন শান, ইয়াং শিউ চিং, শিয়াও চাও কুই, শি-ডা-কাই এবং ওয়েই চ্যাং লুই)। সামরিক ও বেসামরিক কাজকে পৃথক করা হয়নি। কৃষক চাষ করত আবার যুদ্ধ করত, অফিসাররা শাসন, বিচার ও জনকল্যাণমূলক কাজের তদারকি করত আবার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিত। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে মহিলারা যুক্ত হয়েছিল। তাইপিংদের নতুন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা ছিল ধর্মনির্ভর (Taiping kingdom was a threocracy)। তাদের সংবিধান হল স্বর্গরাজ্যের ভূমি ব্যবস্থা সংক্রান্ত দলিল (The Land System of the Heavenly kingdom)। এই দলিলে তাইপিং নেতাদের ভূমি, প্রতিরক্ষা, শাসন, অর্থ, বিচার ও শিক্ষা সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।
তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান আদর্শ ছিল সমতা। সবাই ঈশ্বরের সন্তান, সকলে তাঁর আশীর্বাদ সমানভাবে ভোগ করবে (All children of God must share his blessings, must be free from want, must have land to till, rice to eat clothes to wear and money to spend)। সকলে জমি, খাদ্য, বস্ত্র ও ব্যয় করার মতো অর্থ পাবে। জমি সকলের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করার ব্যবস্থা হয়, উদ্বৃত্ত ফসল তাইপিং কোষাগারে জমা হবে (Their ideal of brotherhood was expressed in a system of primitive economic communism)।
চিনের পুরোনো ঐতিহ্যে সম্পত্তির যৌথ মালিকানার ধারণা ছিল, তাইপিং স্বর্গরাজ্যে সামাজিক কুপ্রথা নেশা, মদ্যপান, পদবন্ধন, জুয়া, ব্যভিচার, পতিতাবৃত্তি, দাসপ্রথা ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয়। নারী-পুরুষের সমান অধিকার মেনে নেওয়া হয়। তাইপিং বিদ্রোহীরা খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করেছিল, প্রথাগত তাও, বৌদ্ধ ও কনফুসীয় মন্দির ও মূর্তি ভেঙেছিল, পূর্বপুরুষ পূজাও নিষিদ্ধ হয়েছিল। খ্রিস্টান আদর্শের ওপর নির্ভর করে, মোজেসের মডেলে, দশটি পালনীয় নীতির কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। তাইপিং বিদ্রোহীরা পুরোনো ব্যবস্থার অনুকরণে ছটি প্রশাসনিক বিভাগ গঠন করেছিল, সরকারি চাকুরিতে প্রবেশিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিল যদিও এই পরীক্ষা ছিল তুলনামূলকভাবে সহজ। তারা একটি নতুন ক্যালেন্ডারও চালু করেছিল।
তাইপিং শাসকরা জনসেবামূলক কাজকর্মকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। অসমর্থ, দুর্বল, রুগ্ন ব্যক্তি, বিধবা ও অনাথদের রাষ্ট্রীয় সাহায্যদানের ব্যবস্থা হয়। নৈতিক চরিত্র গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়। তাইপিং বিদ্রোহীরা পশ্চিমি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণে আগ্রহ দেখিয়েছিল। তাইপিং রাজধানী নানকিং শহরে হং-এর আত্মীয় প্রধানমন্ত্রী হুং জেন কান (Hung Jen-kan) পশ্চিমি বিজ্ঞান ও অর্থনীতি অধ্যয়ন করেন। তিনি তাইপিং অধিকৃত অঞ্চলে ব্যাংক, রেলপথ, ডাক-তার ব্যবস্থা, স্কুল, হাসপাতাল, বাষ্পীয় পোত ইত্যাদি প্রবর্তনের মাধ্যমে আধুনিকতার সূত্রপাত করতে চেয়েছিলেন।
মানবেন্দ্রনাথ রায় জানিয়েছেন যে বহু নিন্দিত, ভ্রান্ত ব্যাখ্যাত এবং স্বল্পজ্ঞাত তাইপিং বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে চিন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে পদার্পণ করেছিল। তিনি তাইপিং বিদ্রোহকে ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য হল বুর্জোয়ারা বিদ্রোহ শুরু করেছিল, কৃষকেরা তাতে যোগ দিয়েছিল। এই ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকরা গ্রহণ করেননি কারণ চিনের বুর্জোয়া জেন্ট্রি এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়নি, তারা আক্রমণের শিকার হয়েছিল। চিনে ফ্রান্সের মতো বুর্জোয়া শ্রেণী ছিল না। জার্মান পণ্ডিত উলফগাঙ্গ ফ্রাঙ্ক বলেছেন এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ, কৃষক, খনি মজুর ও দস্যুরা। জ্যঁ শোনো বলেছেন জীবনযুদ্ধে পরাস্ত, হতাশ, দারিদ্র্যক্লিষ্ট একদল মানুষ প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। দক্ষিণ চিন থেকে শুরু করে বিদ্রোহীরা মধ্য চিনের সমৃদ্ধ ইয়াংসি উপত্যকায় ঘাঁটি গঠন করেছিল। সমাজ বিজ্ঞানীরা এই মাধু-বিরোধী অভ্যুত্থানের মধ্যে জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ লক্ষ করেছেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জাতির লোকেরা বিদেশি তাতার বংশোদ্ভূত মাঞ্চুদের বিরোধিতায় নেমেছিল। এরা বিদেশি খ্রিস্টানধর্ম, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেছিল। কনফুসীয় সংস্কৃতির এরা বিরোধিতা করেছিল তবে পারিবারিক জীবনে ‘লি’ ধর্মকে বাতিল করেনি।
চিনের জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হল কৃষক, তাইপিং বিদ্রোহে দরিদ্র কৃষকেরা যোগ দিয়েছিল। সন্দেহ নেই তাইপিং ছিল প্রধানত ও মূলত কৃষক বিদ্রোহ। মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা একে সামন্ততন্ত্র-বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে ইজরায়েল এপস্টেন মনে করেন এটি ছিল পুরোনো ধারার কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ থেকে আধুনিক গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। জ্যঁ শ্যেনো এই বিদ্রোহের মধ্যে কৃষক বিদ্রোহের উপাদান লক্ষ করেছেন। বিদ্রোহীরা ইয়াংসি উপত্যকা ধরে অগ্রসর হলে দলে দলে কৃষকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।
বিদ্রোহীরা জমিদারের নথিপত্র, মহাজনের কাগজপত্র, ঋণপত্র ইত্যাদি পুড়িয়ে দিয়েছিল, কয়েকজন ভূস্বামী ও মহাজন নিহত হয়। ধনীদের সম্পত্তি লুট করে দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে তা বণ্টন করা হয়। কৃষকেরা বিদ্রোহীদের বন্ধু বলে গণ্য করেছিল (The presence of the rebels seems to have hardened tenants’ determination to resist extortionate rents, and in some cases landlords had to content themselves with partial payments)।
বিদ্রোহীদের দেখে কৃষকেরা উৎসাহিত হয়, ভূস্বামীদের জবরদস্তি কর আদায়ে বাধা দিয়েছিল, ভূস্বামীরা অল্প বা আংশিক কর নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। কৃষকেরা জমি পেয়েছিল, উৎপীড়নমূলক কর ব্যবস্থা থেকে অব্যাহতি লাভ করেছিল। তাইপিং শাসকেরা কৃষি ও শিল্প বাণিজ্যক্ষেত্রে সহনশীল কর ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন। (The economy of Taiping areas was in general less tax-ridden than that of the old regime, in the mercantile sector as well as the agricultural)। তাইপিং অধিকৃত অঞ্চলে ভাগচাষি বা বর্গাদারদের (tenant farmers) দেয় খাজনার হার কমেছিল, ব্যবসায়ীদের কম শুল্ক দিতে হত। শুল্ক ও ভূমিকর আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমেছিল (Taiping trade taxes were less ruinous than the ubiquitous likin, being apparently betterregulated and more honestly administered) চিৎ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা থেকে তাইপিং রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা অবশ্যই পৃথক ছিল (The Taiping society presented a marked contrast to the Ching society)।
তাইপিং বিদ্রোহীরা নানকিং শহরে তাদের রাজধানী স্থাপন করেছিল, এর প্রতীকমূল্য কম নয়। মিং শাসকেরা মোঙ্গলদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে নানকিং-এ রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। এই বিদ্রোহের জাতীয় চরিত্রে প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন ওয়েই চ্যাং হুই-এর মতো কয়েকজন ভূস্বামী ও শিডা কাই-এর মতো কয়েকজন বুদ্ধিজীবী। তাইপিং বিদ্রোহ পরিচালনা ও শাস্ত্র স্থাপনে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অনেকে তাইপিং বিদ্রোহের মধ্যে মধ্যযুগের ইউরোপের কৃষক বিদ্রোহের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। ইংল্যান্ডের জন বুল, জার্মানির টমাস মুঞ্জার বা বোহেমিয়ার হাসের সঙ্গে হুং-এর তুলনা করা হয়েছে। এদের আন্দোলনের মধ্যেও ধর্মীয় উপাদান ছিল, ধর্মীয় নেতারা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে বিদ্রোহ ঘটিয়েছিলেন। তাইপিং বিদ্রোহ নতুন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা গঠনের সংকল্প নিয়ে শুরু হয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহীরা পুরোনো রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো ভেঙে দিতে পারেনি। দলিত, উৎপীড়িত ও শোষিত মানুষের মুক্তি কামনা নিয়ে যে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল অধিকতর শক্তিশালী রাষ্ট্র ও সামরিক শক্তির কাছে তা পরাস্ত হয়।
এম. এন. রায় তাঁর রেভোল্যুশন এ্যান্ড কাউন্টার রেভোল্যুশন ইন চায়না গ্রন্থে তাইপিং বিদ্ৰোহকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে উল্লেখ করেছেন। এর লক্ষ্য ছিল তিনটি—বিদেশি মাঞ্চু বংশের উচ্ছেদ, সেই সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটানো, মূর্তি পূজার অবসান ঘটিয়ে ধর্মীয় সংস্কার সাধন আর সেই সঙ্গে পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারের উচ্ছেদ। তৃতীয় লক্ষ্য হল আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন। তাইপিং আদর্শে বলা হয় ‘সকলে একত্রে চাষ করবে, একত্রে খাদ্য গ্রহণ করবে, পোশাক ও অর্থ যৌথভাবে ব্যবহার করা হবে’ (Having fields let them cultivate together; and when they get rice, let them eat together. so also with regard to clothes and money, let them use them in common) তাইপিং রাষ্ট্রে বাণিজ্য প্রসারিত হয়, কারিগররা পেয়েছিল রাষ্ট্রের উৎসাহ। সামন্ততান্ত্রিক উৎপীড়নের অবসান ঘটেছিল, ইয়াংসি উপত্যকায় চা ও রেশমের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, রপ্তানি বেড়েছিল। কৃষকের উদ্বৃত্ত উৎপাদন শহরের কারিগরি পণ্যের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য হয়েছিল। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি উৎসাহ পেয়েছিল।
এম. এন. মতে, বিপ্লব ফরাসি বিপ্লবের মতো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। চিনে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল ক্ষয়িষ্ণু, জরাজীর্ণ। সমগ্র জুড়ে পরিবর্তনের হাওয়া, তা সত্ত্বেও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব চিনে পরাভূত হয় কারণ বুর্জোয়ারা | ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট, তারা বিপ্লব ঘটাতে পারেনি। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষণ হল তিনটি কৃষক বিদ্রোহ, পুঁজিবাদের সম্প্রসারণবাদী প্রবণতা এবং শিল্প শ্রমিকদের আবির্ভাব। প্রথম লক্ষণ দুটি চিনে ছিল, তৃতীয়টি ছিল অনুপস্থিত। তাইপিং বিদ্রোহীরা রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন চেয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাদের রাজতন্ত্র ছিল সীমাবদ্ধ, স্বৈরতান্ত্রিক নয়। তাঁর মতে, তাইপিং বিদ্রোহের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ধর্ম-নির্ভরতা, ভূ-সম্পত্তির যৌথ মালিকানা, আদিম সাম্যবাদ, সামন্ততন্ত্রের বিরোধিতা, মাঞ্চু রাজবংশের বিরোধিতা, বিদেশিদের প্রতি মৈত্রী, শিল্প ও বাণিজ্য বিকাশে আগ্রহ এবং অগ্রগামী সমাজ ভাবনা।
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে কার্ল মার্কস রেভোল্যুশন ইন চায়না এ্যান্ড ইউরোপ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে তিনি বিপ্লবীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন যে দশ বছর ধরে চিনে যে নিরন্তর বিদ্রোহ চলেছিল তা এখন এক প্রচণ্ড বিদ্রোহে পরিণত হয়েছে। আধুনিক চিনা ঐতিহাসিকরা মনে করেন ব্যাপ্তি ও প্রভাবের দিক দিয়ে বিচার করে বলা যায় অতীতের কোনো কৃষক বিদ্রোহের সঙ্গে এটি তুলনীয় নয়। এক দশকের অধিককাল এই বিদ্রোহ স্থায়ী হয়েছিল, এর প্রভাব পড়েছিল সমগ্র চিনের ওপর। পাই শাং তি হুই (Pai Shang Ti Hui) নামে একটি সংগঠন এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, শিক্ষামূলক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।
তাই পিং বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রব্যবস্থা স্থাপন করেছিল, চিং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, এরা সামন্ততন্ত্র এবং বিদেশি পুঁজিবাদী আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহের সঙ্গে তাইপিং বিদ্রোহীদের মৌল পার্থক্য ছিল এখানে। এই সময়কালে চিনে দুটি প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল—একটি হল বিদেশি পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রসার অপরটি হল চিনের অভ্যন্তরে পণ্য উৎপাদনে অগ্রগতি। এই দুই প্রবণতার ফলে চিনের ভূস্বামী ও কৃষক শ্রেণীর মধ্যে ভাঙন ধরেছিল, দুই শ্রেণীর মধ্যে নতুন শ্রেণীর উদ্ভবের আভাস ছিল লক্ষণীয়। তাইপিং বিদ্রোহের মধ্যে সমাজ রূপান্তরের এই লক্ষণগুলি ছিল স্পষ্ট। তাইপিং বিপ্লবের প্রধান হুং চিং রাজবংশের পতন চেয়েছিলেন, কিন্তু মিং রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাননি। তিনি যে রাজতন্ত্র স্থাপন করেন তা পুরোনো ধরনের রাজতন্ত্র নয়। মানুষে মানুষে তিনি ভেদাভেদ করেননি, তারতম্য ছিল না নারী ও পুরুষের মধ্যে। তিনি কৃষককে জমির মালিকানা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ অবশ্যই পরিবর্তিত হত। নতুন সমাজ গড়ে উঠত।
এফ. মাইকেল ও জোসেফ লেডেনসনের মতো চিন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন 1 তাইপিং ছিল বৈপ্লবিক আন্দেলন। কিন্তু ভিনসেন্ট শি (Shih) এই আন্দোলনকে বৈপ্লবিক বলতে চান না। তাঁর বক্তব্য হল বিদ্রোহীরা শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের দিকে নজর দিয়েছিল, তাদের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনার অভাব ছিল। সমাজে মৌলিক পরিবর্তন ঘটানোর ব্যাপারে তারা আগ্রহ দেখায়নি। সরকারি প্রশাসনি কাঠামো আগের মতো ছিল, মনোলোকেও বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেনি। পশ্চিম সভ্যতাও খ্রিস্টধর্ম, ধ্যান-ধারণা থেকে তাঁরা কিছু উপাদান পেয়েছিলেন। এসকে মধ্যে বিপ্লবী উপাদান ছিল কিন্তু সেগুলির যথাযথ রূপায়ণ ঘটেনি। খ্রিস্টের যৌ বাণীর সঙ্গে প্রাচীন চিনের ধ্যান-ধারণা সংগতিপূর্ণ ছিল সেগুলিকে তারা গুরু দিয়েছিল।
উনিশ শতকের চিনের ইতিহাসকে শুধু পশ্চিমি প্রভাব ও চিনা প্রতিক্রিয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এর ফলে চিনে পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত হয়েছিল সন্দেহ নেই। এই পর্বে তিনটি সুস্পষ্ট ধারা লক্ষ করা যায়—বিদ্রোহ, সংস্কার ও মিশনারি বিরোধী আন্দোলন। তাইপিং বিদ্রোহের সময় কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস চিনা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব হবে প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি। এসব কারণে তাইপিং বিদ্রোহের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এটি কৃষক বিদ্রোহ, না বিপ্লব? এই প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে দেওয়া যায় না। স্বীকার করতে হবে বিদ্রোহীদের বেশিরভাগ ছিল কৃষক, তাদের বহু অভাব-অভিযোগ ছিল, এজন্য তারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়িয়েছিল। এই অর্থে তাইপিং বিদ্রোহ হল কৃষক বিদ্রোহ। কিন্তু তাইপিং বিদ্রোহে কৃষি বিপ্লবের কথা ছিল না, চাষিকে জমির মালিকানা দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতিও ছিল না।
বিদ্রোহীরা শুধু রাজশক্তিকে আক্রমণ করেনি, তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল সনাতন সমাজব্যবস্থা। কনফুসীয় সমাজব্যবস্থাকে আক্রমণ করা হয়, আদর্শ হিসেবে কনফুসিয়াস পরিত্যক্ত হন। অতীতের কৃষক বিদ্রোহের সঙ্গে তাইপিং বিদ্রোহের পার্থক্য এখানে। অন্যান্য কৃষক বিদ্ৰোহ বৌদ্ধ, তাও বা কনফুসীয় পন্থাকে আক্রমণ করেনি। তাইপিং বিদ্রোহীরা খ্রিস্ট ধর্মের এক পরিবর্তিত রূপকে (pseudo Christianity) আশ্রয় করেছিল, কনফুসিয়াস তার প্রভাব হারিয়েছিলেন। চেতনার জগতে বিপ্লব ঘটে যায়।