তেলেঙ্গানা আন্দোলনের উপর একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ। তেলেঙ্গানা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস থেকে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর পর্যন্ত হায়দ্রাবাদ রাজ্যের তেলেগুভাষী অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ চলেছিল। ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে জঙ্গি কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা। হায়দ্রাবাদ রাজ্যের আটটি জেলায় এই বিদ্রোহ হয়েছিল, প্রধান কেন্দ্র ছিল লালগোন্ডা, বরঙ্গল ও খাম্মাম। তেলেঙ্গানা অঞ্চলের অন্ধ্র কনফারেন্স ও অন্ধ্র মহাসভা ছিল কমিউনিস্ট প্রভাবিত, তারাই এই কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। শুধু উচ্চবর্ণের কাম্মা ও রেড্ডিরা নয়, নিম্নবর্ণের মালা, মাগিদা ও উপজাতি কৃষকরা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।
ডি. এন. ধনাগারে লিখেছেন যে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের কারণ হল সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ও অত্যাচার। জাগিরদার, পাট্টাদার, দেশমুখ ও দেশপাণ্ডেরা বেগার শ্রম বেট্টি আদায় করত ছিল নানা অবৈধ কর। এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন শুরু হলে মহাজন ও সাহুকররা এসেছিল, কৃষক জমির অধিকার হারিয়ে ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকে পরিণত হয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই এক কুখ্যাত ভূস্বামীকে আক্রমণ করেছিল কৃষক গেরিলারা। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কৃষকরা ‘দলম’ গঠন করে সশস্ত্র সংঘাতের জন্য তৈরি হয়েছিল। সুমিত সরকার লিখেছেন এধরনের দশ হাজার কৃষক সেচ্ছাসেবী ছিল, ছিল দুহাজার জঙ্গি সদস্য।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে নিজাম ঘোষণা করেন যে তিনি স্বাধীন থাকবেন, ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেবেন না। এর বিরুদ্ধে কংগ্রেস সত্যাগ্রহ শুরু করেছিল, কমিউনিস্টরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। পরে কংগ্রেসের সঙ্গে কমিউনিস্টদের মতবিরোধ দেখা দেয়, এদের মধ্যে সহযোগিতার পর্বও শেষ হয়ে যায়। অভিজাত মুসলমানরা ‘মজলিশ-ইত্তেহাত-উল-মুসলিমিন’ গঠন করে সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক রাজাকর বাহিনী তৈরি করেছিল। এই রাজাকররা তেলেঙ্গানা অঞ্চলে সন্ত্রাস চালালে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছিল। কমিউনিস্টরা দলমের মাধ্যমে ভূস্বামীদের উদ্বৃত্ত জমি দখল করে ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করেছিল, পতিত ও অনাবাদি জমি ভূমিহীনদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী হায়দ্রাবাদ রাজ্যে প্রবেশ করলে নিজাম আত্মসমর্পণ করেন কিন্তু কমিউনিস্টরা আন্দোলন বন্ধ করেনি। ভারতীয় বাহিনীকে বাধাদান উচিত হবে কিনা তা নিয়ে কমিউনিস্টদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। কমিউনিস্ট নেতৃত্বের একাংশ পিপলস ডেমোক্রেটিক রেভোলুশনের কথা বলেছিল। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী কৃষক গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তেলেঙ্গানা আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে জঙ্গি, সবচেয়ে তীব্র, সুগঠিত কৃষক আন্দোলন। এই আন্দোলন চলেছিল ১৬ হাজার বর্গমাইল অঞ্চলে, এরমধ্যে ছিল তিন হাজার গ্রাম, লোকসংখ্যা তিরিশ লক্ষ। বিদ্রোহীরা দশ লক্ষ একর জমি দখল করে ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করেছিল। এই আন্দোলনে নিহত হন চার হাজার কর্মী, বন্দি ছিলেন দশ হাজার, বহু কৃষক কর্মী নির্যাতনের শিকার হন। ধনাগারের মতে, তেলেঙ্গানা আন্দোলনের দুর্বলতা হল এর মধ্যে শ্রেণি ও জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল। আন্দোলনের ফলে লাভবান হয় মাঝারি কৃষক। জমিদারের জমি বেশি দখল করা সম্ভব হয়নি, দখল করা হয়েছিল পতিত, অনাবাদি জমি। দলিত শ্রেণির মানুষজন এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল কিন্তু গেল ওমডেট জানিয়েছেন যে নেতৃত্ব এদের ওপর চাপানো অস্পৃশ্যতা ও অত্যাচার উৎপীড়নের প্রতিকারকল্পে কোনো ব্যবস্থা নেননি (The Communist leadership almost routinely ignored the issues of caste oppression and untouchability) ।
পি. সুন্দরাইয়া তেলেঙ্গানার মুক্তাঞ্চলগুলির বর্ণনা প্রসঙ্গে আন্দোলনের সুফল গুলির কথা উল্লেখ করেছেন। ‘সেচের উন্নতি ও কলেরা প্রতিরোধের ব্যবস্থা, বহু চাষির ও পরিবারের বিরোধের আপস মীমাংসা, মেয়েদের মর্যাদার কিছু উন্নতি, অস্পৃশ্যতা ও কুসংস্কার কমানো, আর বিপ্লবী মূল্যবোধগুলি প্রচারের জন্য লোকসংগীত ও নাটকের ব্যবহার’। সুমিত সরকার লিখেছেন যে তেলেঙ্গানা আন্দোলন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রেখে গিয়েছিল। প্রথমত, এই আন্দোলনের ফলে তেলেঙ্গানা অঞ্চলে স্বৈরাচারী ও সামন্ততান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটেছিল।
দ্বিতীয়ত, নিজামশাসিত হায়দ্রাবাদ রাজ্যের পতন ঘটলে ভাষাভিত্তিক অন্ধ্ররাজ্য গঠন করা সম্ভব হয়। তৃতীয়ত, বেট্টি বা বেগার শ্রমপ্রথা ফিরে আসেনি বা পুনবণ্টিত জমি কৃষকদের হারাতে হয়নি।
মূল্যায়ন :
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সরকার জাগিরদারি প্রথার অবসান ঘোষণা করেছিল, জমির ঊর্ধ্বসীমা ধার্য করে দেওয়া হয়। তবে এই আন্দোলনের ফলে একটি সম্পন্ন কৃষক শ্রেণির উদ্ভব হয় যারা রাজনীতিতে ছিল রক্ষণশীল।