StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

নজরানা প্রথার অবলুপ্তি বা পতনের কারণগুলি আলোচনা কর

 

নজরানা প্রথার অবলুপ্তি বা পতনের কারণগুলি আলোচনা কর ।

চীনের দুর্বল প্রতিবেশী রাজা বা করদ রাজাদের কাছে নজরানা প্রথার প্রাসঙ্গিকতা ছিল। ব্যায়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য হোলেও তারা এই প্রথাকে মেনে নিয়েছিলেন। কারণ করদ শাসকরূপে চীনা সম্রাটের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা ‘ইনভেস্টিচার’ প্রদান জনগণের কাছে তাঁদের গ্রহণযোগ্য করে তুলত। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় থেকে করদ রাজ্যগুলি বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা পেত, দুর্দিনে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেত, চীনা সম্রাটদের কাছ থেকে বিলাস সামগ্রী পেত, বণিকেরা বাণিজ্যের সুযোগ পেত এবং সর্বোপরি চীনের উচ্চতর সংস্কৃতির সংযোগে নিজেরা সমৃদ্ধ হত।

চীনা সম্রাটের কাছে এই প্রথা ছিল আনন্দের এবং আত্মতৃপ্তির, কারণ এই প্রথার মাধ্যমেই করদ রাজ্যগুলি থেকে সর্বময় প্রভুরূপে তিনি স্বীকৃতি পেতেন। তাছাড়া প্রান্তিক এই করদ রাজ্যগুলিই বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে চীনের বহির্সীমান্তরূপে কাজ করত। সব মিলিয়ে করদ সম্পর্কের মাধ্যমে কনফুসীয় মালিকানাতত্ত্বের এবং স্তরবিনস্ত বিশ্বে চীনের শ্রেষ্ঠত্বর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। কিন্তু কালক্রমে এই নজরানা প্রথা প্রাসঙ্গিকতা হারায়। প্রথমত ব্যয়বহুল এই প্রথার বিপুল আর্থিক দায় লিউচিউ-র মত ছোট রাজ্যগুলির বহন করার ক্ষমতা ছিল না। ব্যয় বহুল ছাড়াও চীনের রাজদরবারে করদ মিশন পাঠানো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ও ঝামেলার ছিল।

কোরিয়ার ক্ষেত্রে ২০০-৩০০ জনের মিশনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন হত। তাছাড়া সিওল থেকে পিকিং ৭৫০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে ৫০ থেকে ৬০ দিন লেগে যেত। ১৮০৮ সালে নজরানা ও স্থানীয় উপহার মিলে খরচ হত ১ লক্ষ কপার টেল যা চীনা সম্রাট কর্তৃক কোরীয় রাজা ও তার পরিবারকে দেওয়া উপহারের প্রায় দশগুণ ছিল। রীতি অনুসারে করদ রাজা সিংহাসনে আরোহনের পরে পিকিং-এ বিশেষ দূত পাঠাতেন ইনভেস্টিচার প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে। এর চেয়ে বেশী ব্যয়বহুল ছিল চীনা ইনভেস্টিচার মিশনকে স্বাগত জানানো। চীনা রাজ ইনভেস্টিচার মিশন শুধু কোরিয়া, লিউচিউ ও আন্নামে পাঠানো হত।

ছোট করদ রাজ্যগুলি শুধু নিয়োগ পত্রের রাজকীয় পেটেন্টে সম্বলিত দূতদের স্বাগত জানাত। প্রত্যেক রাজকীয় ইনভেস্টিচার মিশনের আতিথেয়তার জন্য কোরীয় কোর্টকে গড়ে ২,৩০,০০০ তাম্রটেল ব্যয় করতে হত যা তার কেন্দ্রীয় সরকারের খরচের এক ষষ্ঠাংশের সমান ছিল। লিউচিউ সরকারকে প্রত্যেক ইনভেস্টিচার মিশনের জন্য ৩২০,০০০ রৌপ্যটেল ব্যয় করতে হত, কারণ চীনা রাজকীয় মিশনের স্বর্গীয় দূতেরা ব্যয়বহুল আবাসে পাঁচমাস কাটাত। এবং এত বিপুল আর্থিক চাপ বহনে অক্ষম লিউচিউ প্রায়শই অভিষেক অনুষ্ঠান গ্রহণের তারিখ ২ বছর পিছিয়ে দিত। অনেকে আবার এই মিশনের জন্য ১৭-১৮ বছর অপেক্ষা করত।

পশ্চিমি দেশগুলি চিনে বাণিজ্য করতে এসে এই প্রথার সম্মুখীন হয়। চিন পশ্চিমি দেশগুলির ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থা অনুসরণ করে চলেছিল। কাংসি, য়ুংচেং ও চিয়েন লুং-এর শাসনকালে অন্তত এক ডজন এশীয় দেশ এবং পর্তুগাল, হল্যান্ড ও রাশিয়া এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। চিন থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থিতির জন্য এদের নিয়মিতভাবে মিশন পাঠাতে হত না। ১৬৫৫-১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পশ্চিমি দেশগুলি চিনে ১৭টি মিশন পাঠিয়েছিল, একটি মাত্র মিশন ছাড়া আর সকলে কাউটাও করতে বাধ্য হয়েছিল।

চিন বিদেশি সরকারি মিশনগুলি সম্পর্কে কঠোরভাবে কাউটাও প্রয়োগ করত, বেসরকারি বণিকদের ক্ষেত্রে তেমন কঠোরতা ছিল না। বিদেশিরা ম্যাকাওয়ে থেকে ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করত, এদের লাভ হত প্রচুর কিন্তু নানা বাধা-নিষেধ মেনে বাণিজ্য করতে হত। কিন্তু সমস্যা হল উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পশ্চিমি সরকার ও বেসরকারি বণিকরা নজরানা প্রথার বিরোধিতা করতে থাকে। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধ শেষে শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল, স্বাধীনভাবে ইউরোপীয় কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চিনের সঙ্গে বাণিজ্য করতে চেয়েছিল। চিনের বক্তব্য হল ‘আমরা তোমাদের ডেকে আনিনি, আমাদের রীতি মেনে তোমাদের বাণিজ্য করতে হবে।’ শক্তি মদমত্ত ইউরোপের উত্তর হল : ‘আমাদের বাধা দিতে পারবে না, আমাদের শর্তে আমরা আসব, বাণিজ্য করব।’ এই দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের জন্য পশ্চিমের সঙ্গে চিনের সংঘাত শুরু হয়ে যায়।

চিনের নজরানা প্রথার বিরুদ্ধে পশ্চিমি দেশগুলি যখন সোচ্চার এই প্রথার কার্যকারিতা অনেকখানি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে দুটি কারণে এই ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্যাম, আনাম, মালয় দ্বীপপুঞ্জ ও জাভার সঙ্গে চিনা জাঙ্ক বণিকদের বাণিজ্য বেড়ে চলেছিল। এই অঞ্চলের দেশগুলি চিনে করদ মিশন পাঠানো বন্ধ করেছিল, এতে তাদের বাণিজ্য ব্যাহত হয়নি। চিনের ক্যান্টন বন্দরে ইউরোপীয়রা যে বাণিজ্য করত তা নজরানা প্রথা বহির্ভূত ছিল। এই বাণিজ্য বেড়ে চলেছিল, এর নেতৃত্বে ছিল ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ড এই প্রথা ভেঙে ফেলার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিল। আফিম যুদ্ধের পর চুক্তি ভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, নজরানা ব্যবস্থার পতন ঘটে।

চীনের দিক থেকেও নজরানা ব্যবস্থা খুব বেশী লাভ জনক ছিল না। নজরানা মিশনের ব্যবস্থাপনার জন্য চীনাসম্রাটের যে খরচ হয় তা প্রাপ্ত নজরানা ও উপহারের চেয়ে বেশী ছিল। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবর্গও এই প্রথাকে অপমানজনক ও আপত্তিকর মনে করত এবং বাধ্য হয়ে মেনে নিত। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবর্গের বাণিজ্যিক মিশনের প্রতি মাঞ্চু সরকার যতটা কঠোর মনোভাব দেখাত তা ব্যক্তিগত পাশ্চাত্য বণিকদের ক্ষেত্রে দেখাত না।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর পাশ্চাত্য বণিকদের ম্যাকাও-এ থাকার এবং ক্যান্টনে বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এই বণিকেরাই তাদের বাণিজ্যিক আদান প্রদানের মাধ্যমে দ্রুত ব্যাপক লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই সরকারী বেসরকারী সব পাশ্চাত্য বণিকেরা এই নজরানা প্রথা অবসানের জন্য উদ্যোগী হয়। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির সংঘবদ্ধ সোচ্চার প্রতিবাদে নজরানা প্রথার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় বণিকেরা আরও স্বাধীনতা দাবি করে। নেপোলোনীয় যুদ্ধ থেকে সদ্য মুক্ত ও শিল্পবিপ্লবে বলশালী ইউরোপীয় দেশগুলি চীনের এই অসম ব্যবস্থাকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না।

ইউরোপীয় আইন ও কটূনীতিভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তারা চাপ দিতে থাকে এর উত্তরে চীনারা জানায় : “আমরা তোমাদের আসতে বলিনি। যদি তোমরা আস তাহলে তোমাদের অতি অবশ্যই আমাদের মত চলতে হবে।” এর উত্তরে পশ্চিমী শক্তির বক্তব্য হলঃ “তোমরা আমাদের এখানে আসা আটকাতে পারবে না এবং আমরা আমাদের শর্ত মেনেই আসব।” এরপরে চীনের সঙ্গে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবর্গের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। বস্তুত পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলি যখন নজরানা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে তখন এই ব্যবস্থার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই নজরানা প্রথা দুটি ধ্বংসাত্মক প্রভাবের কবলে পড়ে। একটি হল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাথে চীনের জাংক বাণিজ্য (Junk trade) বা Nan yang এবং অপরটি হল ক্যান্টন বন্দরে ইউরোপীয় বাণিজ্যের বিকাশ। এই দুটি বাণিজ্যই নজরানা প্রথার আওতার বাইরে ছিল। শত শত চীনা জাহাজ বিপুল পণ্যের সম্ভার নিয়ে শ্যামদেশ, আন্নাম, মালয় উপদ্বীপ, জাভা ও মালাক্কায় পাড়ি দিত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে নজরানা বিহীন চীনের এই নিজস্ব বাণিজ্য নজরানা প্রথাকে অর্থহীন করে তোলে। ইংল্যান্ডের নেতৃত্বে ক্যান্টনে স্বাধীন ইউরোপীয় বাণিজ্যের দ্রুত বিকাশ নজরানা ব্যবস্থার উপর শেষ আঘাত হানে। 

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *