StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

নজরানা প্রথার উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল

নজরানা প্রথার উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল 

মিং রাজবংশের শাসনকালে (১৩৬৮-১৬৪৩) চিনে ঔপনিবেশিক অনুপ্রবেশের সূচনা হয়েছিল। রেনেসাঁস থেকে ইউরোপীয় জাতিগুলি নতুন দেশ, অনাবিষ্কৃত জলপথ ও অজানা জগৎ আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেছিল। উপনিবেশ স্থাপন, অখ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মপ্রচার ও বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা ছিল লক্ষ্য। প্রাচ্যের মশলা সংগ্রহ করার দিকে তাদের নজর পড়েছিল (The age of discovery was suffused with a new spirit of adventure, fed by the lust for empire, by the evangelical zeal to spread christianity to the heathen world, and by the mercantile search for the spice trade)। নতুন দেশ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে পর্তুগাল অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। পর্তুগাল প্রাচ্যে গোয়া ও মালাক্কা দখল করে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে মশলা উৎপন্ন হত। চিনা বণিকরা রেশম, সাটিন, বাসনপত্র ইত্যাদি নিয়ে এই অঞ্চলে বাণিজ্য করতে আসত, নিয়ে যেত মশলা, আদা, সুগন্ধী দ্রব্য ও সোনা।

চিনা বণিকদের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠার পর পর্তুগিজরা চিনে পৌঁছোনোর কথা ভেবেছিল। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ রাফায়েল পেরেস্ট্রেলো তাঁর বাণিজ্যপোত নিয়ে চিনের বন্দরে গিয়ে হাজির হন, বাণিজ্য করে লাভবান হন। তিনি হলেন প্রথম ইউরোপীয় যিনি চিনে বাণিজ্য করতে গিয়েছিলেন। পরের বছর টম পাইরেস পর্তুগালের রাজার দূত হিসেবে চিনে গিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিল আটখানি জাহাজ। ক্যান্টন বন্দরের কাছে সেন্ট জন, ল্যাম্বাকাও ও ম্যাকাও দ্বীপে তারা বসবাস করতে থাকে। ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে তারা ম্যাকাওতে বসবাস ও বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করেছিল। চিন কখনও চুক্তি করে ম্যাকাও পর্তুগালের হাতে সমর্পণ করেনি তবুও পর্তুগিজরা এটাকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে গণ্য করতে থাকে। পর্তুগিজরা বাণিজ্যের জন্য চিন সরকারকে বার্ষিক ২০,০০০ টায়েল শুল্ক দিত।

স্পেন ফিলিপিন অধিকার করার পর চিনের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু হয়েছিল। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয়রা চিনে বাণিজ্য করতে এসেছিল, ফুকিয়েন ও চিকিয়াং উপকূলে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করেছিল। চিনের ফুচাও, এময়, চুয়ানচাও | এবং ম্যানিলা, মেক্সিকো ও স্পেনের মধ্যে বাণিজ্য বেড়ে চলেছিল। স্পেন তাইওয়ানকে বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচারের ঘাঁটি করেছিল কিন্তু ওলন্দাজরা সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজরা চিনে এসেছিল মশলার খোঁজে, জাভা অধিকার করে মশলা বাণিজ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ইতিমধ্যে চিনে চিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, দুজন ওলন্দাজ দূত সম্রাটের সঙ্গে দেখা করে কাউটাও করে উপঢৌকন দিয়েছিল। চিং সরকার তাদের দূত পাঠানোর অধিকার দিয়েছিল। কোয়াংটুং ও ফুকিয়েন অঞ্চলে তারা বাণিজ্য করার অধিকার পেয়েছিল।

১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিরা চিনে এসে হাজির হয়, ক্যান্টনে তাদের কুঠি স্থাপিত হয়। চারটি বন্দর থেকে বিদেশিরা বাণিজ্য করতে পারত। এই চারটি বন্দর হল ক্যান্টন, চ্যাংচৌ, নিংপো ও যুনতাইশান। এই চারটির মধ্যে ক্যান্টন ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ কারণ এটি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কাছাকাছি। এরপর একে একে ফরাসি (১৬৯৮), দিনেমার (১৭৩১) ও মার্কিনিরা (১৭৮৪) চিনে এসেছিল। বিদেশিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কলহ ছিল, পর্তুগিজরা লুঠপাটে আগ্রহ দেখিয়েছিল, ডাচরা জলদস্যু বৃত্তিতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। এসব কারণে চিনারা বিদেশিদের পছন্দ করত না। পর্তুগিজরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছিল, এজন্য চিনারা তাদের পছন্দ করত না। বিদেশিদের সঙ্গে ভারী কামানগুলি চিনাদের সন্দেহ ও আতঙ্কের কারণ হয়েছিল। বিদেশিদের তারা অসভ্য ও বর্বর হিসেবে গণ্য করেছিল (Their violent and reckless conduct confirmed the Chinese view of foreigners as barbarians)। পশ্চিমি বণিকরা চিনের দক্ষিণ উপকূলের বন্দরগুলিতে বাণিজ্য করত, দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি পায়নি, দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর এদের তেমন প্রভাব ছিল না।

প্রাক-আধুনিক চিনের ওপর মিশনারিদের কিছু প্রভাব পড়েছিল। পর্তুগালের জেসুইট মিশনারিরা ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে আলসানড্রো ভালিগনানোর নেতৃত্বে ম্যাকাওতে আসেন। এঁরা স্থানীয় রীতি-নীতি, ভাষা, সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে ধর্মপ্রচারের কথা ভাবেন। ফ্রান্সিস জেভিয়ারের স্বপ্নকে তাঁরা এভাবে বাস্তবায়িত করার কথা ভাবেন (to sinicize themselves rather than to Portugalize the converts) । দুজন ইতালীয় যাজক মাইকেল রুগিয়েটর ও মাত্তিও রিক্কি (Ricci) এভাবে চিনে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের কথা বলেছিলেন। এঁরা চিনের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে আয়ত্ত করে চিনা সমাজের শিক্ষিত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, এদের মধ্যে অনেকে খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিতদের কয়েকজন দরবারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল জেসুইট ছাড়া ফ্রান্সিসকান ও ডোমিনিকান যাজকরাও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে চিনে এসেছিলেন এবং জেসুইটদের ধর্ম প্রচার নীতির তাঁরা বিরোধিতা করেন (The Europeanist orders, such as the Franciscan and Dominican looked upon non-Christian cultures as the work of the devil and tolerance of these cultures as betrayal of Christian principles)। 

পোপ রক্ষণশীলদের পক্ষ নিলে চিং শাসকরা চিনে ধর্ম প্রচার বন্ধ করে দেন। মিশনারিরা ধর্মপ্রচারে অসফল হলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল। কামান তৈরি, বর্ষপঞ্জি, ম্যাপ, অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, অ্যালজেবরা, জ্যামিতি, ভূগোল, শিল্প ও সংগীত ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা নতুন ধ্যান-ধারণার আমদানি করেছিল। এদের মাধ্যমে ইউরোপ চিনা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়। ইউরোপীয় পণ্ডিত স্পিনোজা, লিবনিজ, গ্যেটে, ভলতেয়ার, হলবাখ ও দিদেরো চিনা সংস্কৃতির ভক্ত হয়ে পড়েন। চিনের যুক্তিবাদী মানসিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসন তাদের মুগ্ধ করেছিল। চিনা শিল্প ও পোর্সেলেনের বাসনপত্র ইউরোপীয়রা পছন্দ করেছিল। তবে ইউরোপীয় সভ্যতা চিনের জীবন ও সংস্কৃতির ওপর তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। চিনা পণ্ডিতদের শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান এমন উচ্চপর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তারা বিদেশিদের কাছ থেকে কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য মনে করেনি (Chinese scholars and officials on the whole were too proud of their cultural heritage to admit of the need for foreign learning) ।

দক্ষিণ দিক থেকে পশ্চিমিরা যখন চিনের দুয়ারে এসে হাজির হয় উত্তর থেকে রাশিয়া সাইবেরিয়া পেরিয়ে উত্তর সীমান্তে এসে হাজির হয়। আমুর নদী পেরিয়ে তারা চিনের উত্তর দিকের প্রদেশ মাঞ্চুরিয়ায় প্রবেশ করতে চেয়েছিল। মাথু শাসকরা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করে (১৬৮১) উত্তরে রাশিয়ার আগ্রাসনে বাধা দিয়েছিল, গেরচিনস্কের সন্ধিতে (১৬৮৯) উভয় দেশের সীমান্ত চিহ্নিত হয়। এটা হল পশ্চিমি দেশের সঙ্গে চিনের প্রথম চুক্তি, উভয় দেশ সমতার ভিত্তিতে এই সমঝোতায় উপনীত হয়। রাশিয়া চিনে মিশন পাঠানোর অধিকার পেয়েছিল, আমুর নদী সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়।

১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত কিয়াখার চুক্তিতে উভয় দেশ মঙ্গোলিয়া রুশ সীমান্ত চিহ্নিত করে নিয়েছিল। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে দূত বিনিময় ও ঝণিজ্যিক কাজকর্ম চলতে থাকে (It was the only foreign country with which China maintained treaty relations, the only western state to which China sent diplomatic missions and the only foreign power granted religious, commercial and educational privileges in Peking)। চিনের নথিপত্রে রাশিয়াকে করদ রাজ্য বলে উল্লেখ করা হলেও চিনের সম্রাটরা রাশিয়াকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সমমর্যাদা দিয়েছিল (equal good neighbour) । এইভাবে নজরানা প্রথার উৎপত্তি ঘটে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top