নজরানা প্রথার বৈশিষ্ট্য । চীনে নজরানা প্রথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
নজরানা প্রথা বিশ্লেষণ করলে এর কতগুলি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। এগুলি হল :
(১) স্বর্গপুত্র (Son of Heaven ) চীনা সম্রাট হলেন পদমর্যাদায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শাসক। রাজনৈতিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক মানদণ্ডে তাঁর সমতুল্য আর কেউ নেই। তাই অন্য সব শাসক তাঁর তুলনায় পদমর্যাদায় ছোট। জাতি সমূহের পরিবারে (family of nations) যেমন চীন শ্রেষ্ঠ তেমনি কোন বিদেশী রাষ্ট্রও এর সমপর্যায়ের নয়। পাশ্চাত্য বিদেশী রাষ্ট্রকেও চীনা সম্রাটের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে হত।
(২) তাই পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসহ সকল বিদেশী রাষ্ট্রই চীনের করদ রাজ্য রূপে গণ্য হত। পশ্চিমী দেশগুলির রাষ্ট্রদূত করদ রাজ্যের রাষ্ট্রদূতের সম্মান পেতেন।
(৩) যেহেতু অন্যান্য সব রাষ্ট্রকে করদ রাজ্য ভাবা হত তাই চীনা সম্রাট বিদেশে কোন রাষ্ট্রদূত পাঠাতেন না। প্রাচীন চীনের আদর্শ অনুয়ায়ী স্বর্গপুত্র চীনা সম্রাট স্বর্গের তলার সব মানুষের সর্বময় প্রভু এবং চীন হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সেই সর্বপ্রভাবময় কেন্দ্র-বিন্দু। তাই পৃথিবীর অন্য সব মানুষ হল বর্বর। বিদেশী রাষ্ট্রদূতেরা তাই করদ রাজ্যের বেশী মর্যাদা পেতে পারে না।
(৪) চীন সম্রাটের স্বাক্ষাৎপ্রার্থী সব রাষ্ট্রদূতকেই তাঁদের শাসকদের নীচু মর্যাদা তথা অপকৃষ্টতাকে মেনে নিয়ে অসম্মানজনক কাউতাও (Kowtow) প্রথা পালন করতে হত। এই কাউতাও প্রথা হল নতজানু হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকানো এবং সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত। যে কোন বিদেশী সীমান্ত পেরিয়ে চীনা সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলেই তাকে তিনবার এই নীতি পালন করতে হত। আবার একই জিনিস সম্রাটের দরবারে উপস্থিত সভ্যদের সামনে করতে হত। এই কাউতাও প্রথাই পরবর্তীকালে চীনের সঙ্গে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলির কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান অন্তরায় এবং উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
(৫)নজরানা প্রথায় পাশ্চাত্যের সমমর্যাদার ভিত্তিতে গঠিত আন্তজার্তিক সম্পর্কের আদর্শের পরিবর্তে চীনাজাতি সমূহের পরিবারের (family of nations) আদর্শ গার্হস্থ্য জীবনে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের মত পারস্পরিক রাষ্ট্রের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এই সম্পর্ক পরিবারের সদস্যদের মত বড় ছোট-র সম্পর্ক। তাই চীনের সঙ্গে কোরিয়ার সম্পর্ক ছিল “মহানের সেবা” (Sadae), কিন্তু জাপানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিল প্রতিবেশী সুলভ (Kyorin)।
(৬) জমিদার ও সামন্ত প্রভুর সঙ্গে সম্রাটের সম্পর্ক শুধু নজরানা প্রদানের মধ্যেই সীমিত ছিল না) বিনিময়ে সম্রাটও তাদের মূল্যবান উপহার দিতেন এবং বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা করে দিতেন। তাছাড়া শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্ররূপে চীনেরও দায়িত্ব ছিল পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার। করদ রাজাদের বৈধ স্বীকৃতি দানও চীনা সম্রাটের অন্যতম কর্তব্য ছিল। বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করা এবং দুর্দিনে সাহায্য প্রদানও তাঁর অন্যতম কর্তব্য ছিল। বিনিময়ে করদ রাজ্যগুলি চীনকে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের মর্যাদা দিত এবং চীনা ক্যালেন্ডার গ্রহণ করত।
(৭) করদ মিশনের আকৃতি কেমন হবে, কতবার আসবে এবং কোন পথে আসবে তা সব ঠিক করতেন চীনা সম্রাট। সাধারণত চীনের সঙ্গে যার যত ঘনিষ্ট সম্পর্ক তাকে তত বেশি নজরানা এবং বেশীবার মিশন পাঠাতে হত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কোরিয়া বছরে চারবার নজরানা দিত। লিউ চিউ তিন বছরে দুবার, আল্লাম দু বছরে একবার, শ্যামদেশ (Siam) তিন বছরে একবার এবং বার্মা ও লাওস দশ বছরে একবার নজরানা দিত।
(৮) নজরানা মিশনের সঙ্গে বিশাল সংখ্যক বণিক দল এবং তাদের মাশুল-মুক্ত পণ্য সামগ্রী চীনে যেত। যাতায়াত ও ব্যবস্থাপনার যাবতীয় খরচ চীনা সরকার বহন করত এবং যখন তারা পিকিং-এ পৌঁছাত তখন তাদের করদ দূতের সাধারণ বাসস্থান (Common Residence for Tributory Envoys)-এ থাকতে দেওয়া হত। তারপর একটি শুভ উৎসবের দিন দেখে নজরানা প্রদানের অনুষ্ঠান পালন করা হত।
(৯) কাউতাও রীতি অনুসারে তাদের তিনবার নতজানু হয়ে মোট ন’বার মাটিতে মাথা ঠেকাতে হত। এরপর করদ মিশনের দূত ও বণিকদের হস্টেলের সামনে তাদের পণ্যের বাজার বসাতে দেওয়া হত। এই বাজার তিন থেকে পাঁচ দিন চলত। করদ মিশনের এই বাণিজ্যিক আদান-প্রদান খুব লাভজনক ছিল। এছাড়া চীনা সম্রাট তার প্রতিবেশী করদ রাজাদের ও তাদের প্রতিনিধিদের দামী উপহার প্রদানের মাধ্যমে বদান্যতা প্রদর্শন করতেন। তবে সম্রাটের দেওয়া উপহার তাঁর প্রাপ্য নজরানা ও উপহারের চেয়ে অনেক কম ছিল।
(১০) নজরানা প্রথার আওতায় বাণিজ্যে আগ্রহী পাশ্চাত্য দেশগুলিও পড়ত। চীনাদের কাউতাও (Kowtow) প্রথা তাদেরকেও মানতে হত। পর্তুগাল, হল্যান্ড, রাশিয়া এবং ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতকেও কাউতাও প্রথা মানতে হয়েছিল এবং নজরানা দিতে হয়েছিল। ১৬৫৫ থেকে ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাশ্চাত্য দেশের প্রেরিত ১৭টি মিশনের মধ্যে মাত্র একবার ছাড়া সব বারই চীনাদের এই প্রথা মানতে হয়েছিল।