পিন্ডারিদের অভিযান সংক্ষেপে আলোচনা কর।
পিন্ডারি কারা , পিন্ডারি হল এক দস্যু দলের নাম। পিণ্ড হল এক ধরনের কড়া দেশি মদ। আঠারো শতকে পিন্ডারিদের উল্লেখ পাওয়া যায়, মারাঠা সৈন্যবাহিনীর অনিয়মিত সৈনিক হিসাবে এদের কথা জানা যায়। এরা নিয়মিত বেতন পেত না, সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে এরা বিভিন্ন সামরিক অভিযানে অংশ নিত এবং লুণ্ঠিত দ্রব্যের একাংশ পেত। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পর পিন্ডারিদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, এরা মালব অঞ্চলে বসবাস করত, মারাঠা দলপতি সিন্ধিয়া, হোলকার ও নিজামের সহযোগী বাহিনী হিসেবে এরা কাজ করত। মলহর রাও হোলকার এদের নর্মদা উপত্যকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য জমি দেন। এই অঞ্চলে বসবাসকারী পিন্ডারিরা তাদের বাসস্থানের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল কর্মচ্যুত সৈনিক, কৃষক, ভবঘুরে, দস্যু ও তস্কর শ্রেণির মানুষ।
মারাঠা রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের সময় এই পিন্ডারিরা একটি নতুন সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে দেখা দেয়। জীবিকাহীন কিছু মানুষের প্রতিবাদী আন্দোলন হিসেবে পিন্ডারিদের অভিযানকে গণ্য করা যায়। যখন সমাজের একটি বড়ো অংশ আইনানুগ পথে জীবিকার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়, তখন তারা বেআইনি পথে বিকল্প পথের সন্ধান করে। একেই এরিক হবসবম ‘সামাজিক দস্যুতা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এরা দস্যু কিন্তু সমাজই এদের দস্যুতার দিকে ঠেলে দেয়।
মোগল কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা, দেশীয় রাজ্যগুলির সামাজিক সম্পদ সৃষ্টিতে এবং বণ্টনে ব্যর্থতা এবং মারাঠা রাষ্ট্রগুলির লুণ্ঠন প্রবণতা পিন্ডারিদের উত্থানকে সম্ভব করেছিল। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে ছিল নৈরাজ্য ও অরাজকতা, শান্তিপূর্ণভাবে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা ছিল না, পরিশ্রমসাধ্য জীবিকার চেয়ে লুটপাট অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল। বড়োলাট ওয়েলেসলি অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রবর্তন করলে দেশীয় রাজারা তাদের সৈন্যবাহিনী ভেঙে দিতে বাধ্য হন। এরফলে কর্মচ্যুত সৈনিকরা দলে দলে পিন্ডারিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।
পিন্ডারিরা সর্বত্র লুটপাট চালাত, নির্বিচারে নরহত্যা করত, কৃষকদের তাদের সঙ্গে যোগ দিতে বাধ্য করত। এভাবে ধীরে ধীরে মধ্যভারতে পিন্ডারি দস্যুদলের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। পিণ্ডারিরা কোনো বিশেষ ধর্ম ও অঞ্চলের লোক ছিল না। (They were men from all lands and all religions)। বিচিত্র সামাজিক গোষ্ঠীর মানুষজন শুধু লুটপাটের আশায় জোট বেঁধেছিল। কর্মচ্যুত সৈনিক, অপরাধী, ভবঘুরে, কৃষক সকলে পিন্ডারি দলে যোগ দিয়েছিল। পিন্ডারিরা কখনও সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সামনাসামনি লড়াই করত না, এরা কোনো সরঞ্জাম নিয়ো অভিযানে বের হত না। শুধু অশ্বপৃষ্ঠে সশস্ত্র হয়ে এরা অভিযানে যেত। এদের প্রধান অস্ত্র ছিল লম্বা বর্শা ও কিছু আগ্নেয়াস্ত্র। এরা যে অঞ্চলে লুটপাট চালাত সেখান থেকে খাদ্য সংগ্রহ করত।
পিন্ডারিদের বৈশিষ্ট্য হল তীব্রগতি, গতিতে তারা শত্রুকে পরাস্ত করত। খাদ্যশস্য, টাকাপয়সা, সোনা-রূপো সব কিছু তারা লুটপাট করত। অভিযানের পরিকল্পনা করা হত খুব গোপনে, শত্রু শত চেষ্টা করেও আগেই তাদের অভিযানের খবর জোগাড় করতে পারত না। পঙ্গপালের মতো তারা দলে দলে এসে হাজির হত এবং নিমিষে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে পালিয়ে যেত। ব্রিটিশ লেখক ম্যালকম, প্রিন্সেপ, ডাফ, টড ও ঘনটন পিন্ডারি দস্যুদের কার্যকলাপের বর্ণনা রেখে গেছেন।
উনিশ শতকের গোড়ারদিকে পিণ্ডারি দস্যুদের ভয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল মধ্য ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। বিখ্যাত পিন্ডারি নেতারা হলেন হিরু, বুরান, চিতু করিম খান ও ওয়াসিল মহম্মদ। পিন্ডারিরা কোম্পানির রাজ্য, নিজামের রাজ্য, উত্তর সরকার ও বিভিন্নন্ন অঞ্চলে লুটপাটের অভিযান পরিচালনা করত, মারাঠা বা রাজপুত রাজ্যও বাদ যেত না। লর্ড হেস্টিংস পিন্ডারিদের দমন করার সিদ্ধান্ত নেন। এদের কার্যকলাপের ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কোম্পানির বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উত্তর ও মধ্যভারতে কোম্পানির বাণিজ্যিক অগ্রগতি ব্যাহত হবার খবর পেয়ে ডিরেক্টর সভা লর্ড হেস্টিংসকে পিন্ডারি দস্যুদের দমন করার নির্দেশ দিয়েছিল। হেস্টিংস মারাঠা সর্দার, রাজপুত রাজা ও ভূপালের নবাবের সঙ্গে চুক্তি করে পিন্ডারিদের বিরুদ্ধে এদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।
ইংরেজ লেখক পি. ই. রবার্টস ও এস. এম. এডওয়ার্ডস লিখেছেন যে, পিন্ডারিদের সঙ্গে আফগান সর্দার, মারাঠা দলপত্তি ও রাজপুত অভিজাতদের গোপন যোগাযোগ ছিল। ব্রিটিশ রাজপুরুষরা এধরনের সন্দেহ পোষণ করতেন। এমন কথাও বলা হত যে পিন্ডারি দস্যুদের আসল প্রভু হলেন দৌলতরাও সিন্ধিয়া। সুতরাং, হেস্টিংস যখন পিন্ডারিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন এমন ব্যবস্থা করেন যাতে মারাঠা দলপতিরা এদের কোনোরকম সাহায্য না দিতে পারেন।
গভর্নর জেনারেলের সিদ্ধান্ত খুব অমূলক ছিল না, পিন্ডারিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হতেই তৃতীয় মারাঠা যুদ্ধও শুরু হয়ে যায় (১৮১৭-১৮) (The hunt of the Pindaris became merged in the third Maratha war) I আধুনিক গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ইংরেজ রাজপুরুষদের সন্দেহ সব সময় সঠিক ছিল না। পিন্ডারিরা মারাঠা রাজ্যেও লুটপাট চালাত, সিন্ধিয়া নিজেই এদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ইংরেজ উচ্চ রাজপুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন সিন্ধিয়া পিন্ডারিদের সংস্রব ত্যাগ করেন এবং তাদের দমনের ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন। হেস্টিংস পিন্ডারি দমনকে অজুহাত করে সিন্ধিয়াকে আক্রমণ করার কথা ভেবেছিলেন।
হেস্টিংস পিন্ডারি ও মারাঠা শক্তিকে একসঙ্গে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। বড়োলাট ১,১৩,০০০ সৈন্য ও ৩০০ কামান নিয়ে বিশাল বাহিনীর সমাবেশ করলেন। উত্তরে তিনি স্বয়ং সৈন্যবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব নেন, দক্ষিণে স্যার টমাস হিসলাপ ছিলেন সৈন্যবাহিনীর প্রধান। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিক থেকে অভিযান শুরু করে চম্বল উপত্যকা থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়, তাদের সংগঠন ভেঙে যায়। করিম গান আত্মসমর্পণ করেন, ওয়াসিল মহম্মদকে সিন্ধিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দেন, চিতু অরণ্যে পালিয়ে যান। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যালকম লিখছেন : ‘পিন্ডারিদের ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে, তাদের নাম আর শোনা যায় না (The Pindaris are so effectually destroyed that their name is almost forgotten) | GRPG এধরনের বক্তব্য রেখেছেন, মারাঠা যুদ্ধের শেষ অবধি দু’একটি বিক্ষিপ্ত দলকে দেখা যেত, তবে তারা ছিল বিচ্ছিন্ন ও নেতৃত্বহীন। সংগঠিতভাবে লুটপাট চালানোর ক্ষমতা আর তাদের ছিল না।