বক্সার অভ্যুত্থানের প্রকৃতি নির্ধারণ করো । বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি ।
বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে সমকালীন পর্যবেক্ষক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতের মিল নেই। সমকালীন পর্যবেক্ষক লেনিন বক্সার বিদ্রোহীদের পশ্চিমি বিরোধিতার প্রশংসা করেছিলেন। প্রখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন লিখেছিলেন যে সভ্যতার স্বঘোষিত রক্ষাকর্তারা চিনের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার পটভূমি তৈরি করে দেন।
সমসাময়িক বহু উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মানুষ বক্সার বিদ্রোহকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখেছিলেন। জ্যাক গ্রে বলেছেন যে এই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল বিদেশিদের চিন থেকে বিতাড়িত করা, অপরদিকে ভিনাক জানাচ্ছেন যে এই বিদ্রোহ বিদেশিদের চেয়ে দেশি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল (The initial outbreaks were caused by and directed against native christians even more than foreigners) ফেয়ারব্যাঙ্ক মনে করেন চিনের জাতীয় জীবনে যে সামগ্রিক দুর্দশা ও অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হল বক্সার বিদ্রোহ।
জাঁ শোনো বক্সার বিদ্রোহের মধ্যে জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছেন। খ্রিস্টান মিশনারি ও ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রোশ ও আবেগ তৈরি হয়েছিল। এটি হল মূলত কৃষক বিদ্রোহ, বিদ্রোহীদের বেশিরভাগ ছিল কৃষক। পরিবারের অল্প বয়স্করা, গুপ্ত সমিতিগুলি এদের নেতৃত্ব দিয়েছিল। বিদ্রোহীদের ৭০ শতাংশ ছিল কৃষক, অন্যরা হল নৌকামাঝি, ফেরিওয়ালা, কুলি, শিল্পী, কারিগর, দোকানদার ও স্কুল শিক্ষক। বিদ্রোহীদের বেশিরভাগ ছিল তথাকথিত | নিম্নবর্গের লোক, দরিদ্র। রাজসভা বক্সারদের সমর্থন করলে রাজপুরুষ ও জেন্ট্রি শ্রেণীর মানুষরা এদের পক্ষ নিয়েছিল।
বক্সার বিদ্রোহে নারী সমাজের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল বলে জানা যায়। নারীদের চারভাগে ভাগ করে চারটি দল গঠন করা হয়েছিল—লাল লণ্ঠন, নীল লণ্ঠন, কালো লণ্ঠন ও সবুজ লণ্ঠন। অল্পবয়সী মেয়েরা ছিল লাল লণ্ঠনের সদস্যা, মাঝবয়সী গৃহবধূরা ছিল নীল লণ্ঠনের সদস্যা, বয়স্কা গৃহবধূরা ছিল কালো লণ্ঠনের সদস্যা আর বিধবা রমণীরা ছিল সবুজ লণ্ঠনের সঙ্গে যুক্ত। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে লাল লণ্ঠনের সদস্য সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি।
চিনে খ্রিস্টান ধর্মের ভূমিকা নিয়ে তিন ধরনের মূল্যায়ন পাওয়া যায়। কে. এস. লাটুরেটের মতো ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে চিনে খ্রিস্টান ধর্মের ভূমিকা ছিল গৌরবময় ও সৃজনশীল। খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে পশ্চিমি সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদের সঙ্গে চিনাদের পরিচয় ঘটেছে, পশ্চিমি সভ্যতার প্রসার ঘটায় জনগণ লাভবান হয়েছে, মঙ্গলজনক হয়েছে পশ্চিমি সভ্যতার প্রভাব। এর ঠিক বিপরীত মতামত ব্যক্ত করেছেন জোসেফ নিউহ্যাম। তাঁর মতে, চিনা সংস্কৃতি সংগঠিত খ্রিস্টান ধর্মকে চূড়ান্তভাবে বর্জন করেছে। চিনা সংস্কৃতি সুনীতিবোধ ও মানবতাবোধে সমৃদ্ধ, অপর দিকে খ্রিস্টান ধর্ম হল গোঁড়া ও রক্ষণশীল, অতিমাত্রায় ধর্ম-নির্ভর।
চিনাদের কাছে খ্রিস্টান ধর্ম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। পল. এম. ক্লিমেন্টস = মনে করেন যেসব দেশে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারিত হয়েছে সর্বত্রই তা আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান সমূহকে অগ্রাহ্য করেছে, প্রত্যেক ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করেছে, স্থানীয় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। অন্য কোনো ধর্মের সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্মের সহাবস্থান সম্ভব হয় না।
১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে চীন-জাপান যুদ্ধে জাপানের কাছে চীনের পরাজয় যে সামরিক দুর্বলতা প্রকাশ করেছিল তা চীনের মূল ভূখণ্ডে পাশ্চাত্য সম্রাজ্যবাদী লালসাকে বাড়িয়ে তুলেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ চীনা সাম্রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের জন্য (মুক্তদ্বার নীতি ঘোষণার দ্বারা) চীন বিখণ্ডিত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শক্তি যখন চীনের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব বিনাশে তৎপর তখন এই আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে দেশে ঝড় বয়েছিল। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের বিরুদ্ধে চীনের অসন্তোষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলশ্রুতি হিসেবে চীনে বক্সার আন্দোলন শুরু হয়।
বক্সার বিদ্রোহ ছিল একটি বিদেশী বিরোধী আন্দোলন। বক্সার নামক গুপ্ত সমিতি চীন থেকে বিদেশীদের হটানোর উদ্দেশ্যে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলন শুরু করে। বক্সার গুপ্ত সমিতির মূল চীনা নাম ছিল আই-হো-চুয়ান (I-ho-chuan ) বা মুষ্টি যোদ্ধাদের ন্যায়ভিত্তিক ভ্রাতৃ সঙ্ঘ ( Righteous fraternity of Fist Fighters)। আই-হো-চুয়ান গুপ্ত সমিতিটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্বের বিদ্রোহী অষ্ট-ত্রিগম সমাজ (Pa-Kua Chiao)-এর একটি শাখারূপে গড়ে উঠেছিল। এক শতাব্দী পূর্বের White Lotus Society নামক মাঞ্চুবিরোধী গুপ্ত সমিতি উত্তর চীনে ছড়িয়ে পড়লে তার থেকে যে গুপ্ত সমিতিগুলি গড়ে উঠেছিল অষ্ট ত্রিগম সমাজ তার মধ্যে অন্যতম।
আই-হো-চুয়ান গুপ্ত সমিতির পাশ্চাত্য নামে Righteous fraternity of Fist Fighters বা সংক্ষেপে ‘L’ ‘ও ‘S’ Boxers, অতি মোটা দাগের অনুবাদ হলেও বোঝা যায় ন্যায়পরায়ণতা (আই-হো) এবং মুষ্টিযুদ্ধ (চুয়ান) এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় ছিল। দেহ ও মনের সঠিক বিকাশ ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য তারা “মুষ্টি যুদ্ধ” (boxing) চর্চা করত। আত্মশক্তি বৃদ্ধির জন্য তারা যে অতিপ্রাকৃত (supernatural) শক্তি আয়ত্ত করতে চাইত তন্ত্রমন্ত্র, যাদুবিদ্যা সবই তার অঙ্গীভূত ছিল।
মূল্যায়ন :
বক্সার বিদ্রোহ চীনের প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রাচীন গণবিদ্রোহগুলির আদর্শে অনুপ্রাণিত। তাই গোড়াতে ক্ষমতাসীন মাঞ্চবংশের উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ১৮৯৮ সালে সংস্কার আন্দোলনের ব্যর্থতা ও পাশ্চাত্য আগ্রাসন চীনের জনমানসে যে বিদেশী বিরোধী বিদ্বেষ সঞ্চারিত করেছিল তাকে চালিকা শক্তি করে মাঞ্চু কর্মকর্তারা বক্সারদের বিদেশীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিল। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাই মাণ্ডুদের স্লোগান হয়: “Support Ching; destroy the foreigners”।