বক্সার বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর । বক্সার বিদ্রোহের কারণ ।
ভূমিকা :
বক্সার বিদ্রোহ একাধিক কারণে সংঘটিত হয়েছিল। বক্সার বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট ছিল : খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে অসন্তোষ, পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনরোষ, চীনের আর্থিক দুরবস্থা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে অসন্তোষ:
বক্সার বিদ্রোহের কারণ ছিল বিদ্রোহীদের খ্রিস্টধর্ম বিরোধী মনোভাব যা বিদেশী বিরোধিতার নামান্তর ছিল। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে গোটা চীন জুড়ে যে বিদেশী বিরোধী অভ্যুত্থান দেখা দেয় তার মূল কারণ ছিল খ্রিস্টধর্মের প্রতি চীনাদের বিদ্বেষ। বিদেশীরা যেহেতু নিজেদের খ্রিস্টান বলত এবং চীনের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকগণ যেহেতু এই সম্পর্কের ওপর জোর দিত, তাই খ্রিস্টান বিরোধিতা বিদেশী বিরোধিতার পর্যায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কনফুসীয়বাদ, তাওবাদ ও বৌদ্ধধর্মের আদর্শে পুষ্ট চীন খ্রিস্টান মিশনারীদের খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারকে ভাল নজরে দেখেনি।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পিকিং কনভেনশনের মাধ্যমে যেদিন খ্রিস্টান মিশনারীদের চীনে বসবাস ও ধর্মপ্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়, সেদিন থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও মিশনারী কর্তৃক ধর্মান্তরিত চীনাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ একটি প্রাত্যহিক ঘটনায় পরিণত হয়। এই বিক্ষোভ প্রায়শই জেন্ট্রি বা সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত হত। চীনা জনগণের মধ্যে এই খ্রিস্টধর্ম বিরোধী মনোভাব বিভিন্ন কারণে গড়ে উঠেছিল। প্রথমতঃ খ্রিস্টান মিশনারীগণ নানা প্রলোভন দেখিয়ে দরিদ্র চীনা জনগণকে ধর্মান্তরিত করত। আর্থিক সাহায্যের বিনিময়ে বা সরকারী বা বেসরকারী হয়রানির হাত থেকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গরীব চীনাদের ধর্মান্তরিতকরণে উৎসাহিত করত। সাধারণ অথবা সম্ভ্রান্ত চীনারা ধর্মান্তরিত চীনাদের নীচু নজরে দেখত এবং তাদের ধর্ম বেচে খাওয়া (eat by religion) শ্রেণী বলত।
সম্ভ্রান্ত চীনারা খ্রিস্টধর্মকে সামাজিক সংহতি বিনাশক, অবাস্তব ও আদি ধর্ম বিরোধী (Socially disruptive delusive, heterodox) আখ্যা দেন। দ্বিতীয়ত নব্য ধর্মান্তরিতদের প্রতি চীনাদের ক্ষোভ জন্মে, কারণ তাদের অনেকই চীনের পবিত্র সামাজিক বন্ধনকে গ্রাহ্য করত না এবং স্থানীয় উৎসব ও দেবতাদের সমর্থন করতনা। বিবাদ বাধলেই তারা মিশনারীদের মধ্যস্থতার জন্য ডেকে আনত। ধর্মান্তরিত চীনারা দেবদেবীর সমানে কাউটাউ বা নতজানু হয়ে প্রণাম জানাত না এবং কনফুসিয়াস ও অন্যান্য পূর্বসূরীদের শ্রদ্ধা জানত না। এইভাবে গোঁড়া ধর্মবিরোধী ধর্ম হিসেবে খ্রিস্টধর্ম বিদেশী বিরোধিতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণরোষ :
চীনে বিদেশী বিরোধী মনোভাব পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রসন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে চীনের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবার উপক্রম হয়েছিল। চরম সংস্কারপন্থী নেতা কাং ইউ-ওয়েই ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল জাতীয় সুরক্ষা সমিতিতে (National Protection Society) এক ভাষণ দিতে গিয়ে চীনাবাসীকে সতর্ক করে দেন যে চীনে এই পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ চলতে থাকলে চীন অচিরেই বার্মা, আন্নাম, ভারত অথবা পোল্যান্ডের মত স্বাধীনতা হারাবে। দেশের প্রগতিবাদীরা চরম প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির পথ খুঁজলেও রক্ষণশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী | বিদেশী বিতাড়ন ও বিদেশী হত্যার পথকে বেছে নিয়েছিল।
চীনা জনগণের বিদেশী বিরোধিতার পাশাপাশি, মাঞ্চু বিরোধী মনোভাবও প্রকাশিত হয়। প্রথমতঃ মাঞ্জু একটি বিদেশী বংশ। দ্বিতীয়তঃ এই বংশের শাসনকালে প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতি এবং পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের কাছে চীনের সামরিক দুর্বলতা তথা হীনমন্যতা উন্মোচিত হয়। তবুও চীনা সম্রাজ্ঞী দোয়াগার জু-সি নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করে চীনা জনগণের বিদেশী বিরোধী মনোভাবকে মাঞ্চু বংশের অনুকূলে ব্যবহার করতে সক্ষম হন।
চীনের আর্থিক দুরবস্থা :
চীনা জনমানসে যখন বিদেশী বিরোধী মনোভাব ও বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে তখন চীনের চারিদিকে অর্থনৈতিক মন্দা বক্সার বিদ্রোহের পথকে প্রশস্ত করে। আফিম যুদ্ধোত্তর কালে চীনা বন্দরগুলি পরপর বিদেশী শক্তির কাছে উন্মুক্ত হলে গোটা চীন জুড়ে বিদেশী পণ্যে ছেয়ে যায়। চীনা অর্থনীতিতে এর প্রভাব ছিল মারাত্মক। পণ্য মূল্যের ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক চীনের দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে পারেনি। চীনের বাজারে বিদেশী বস্ত্র চীনা বস্ত্রের এক তৃতীয়াংশ দামে বিক্রি হওয়ায় চীনের তাঁতিরা এবং বস্ত্র উৎপাদকেরা এই অসম প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে পারেনি, তাদের চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। তাইপিং বিদ্রোহের যুগে চীনের বাজারে বৈদেশিক পণ্যের দাপট আরও বৃদ্ধি পায়।
১৮৬১ থেকে ১৮৯৫, আত্ম শক্তিবৃদ্ধির এই পর্বে বিদেশী ধাঁচের কিছু বৃহৎ শিল্পোদ্যোগ গড়ে ওঠে এবং বিদেশী পুঁজির বিনিয়োগ ঘটে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে চীনে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৬৯ মিলিয়ন টেইল (Tacl) এবং সরকারের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১২ মিলিয়ন টেইল। এই ঘাটতি পূরণের জন্য মাঞ্চু সরকার কর বৃদ্ধি করে এবং প্রাদেশিক আদায় বৃদ্ধির আবেদন করে। এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে জনগণ করভারে জর্জরিত হয়েছিল। সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, কারিগর শ্রেণী হতাশাময় জীবন থেকে মুক্তি পেতে দস্যুবৃত্তির আশ্রয় নেয় অথবা বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়। রেলপথ বিকাশের বিদেশী কৌশল চীনের প্রচলিত যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর কুপ্রভাব ফেলে। এর ফলে উত্তর ও দক্ষিণ চীনের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী গ্রান্ড ক্যানাল (Grand canal) এবং হানকাও থেকে পিকিং পর্যন্ত সড়ক পথ মার খায় এবং এর সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার মানুষের কাজ চলে যায়।
ঊনবিংশ শতকের শেষে চীনের হস্তশিল্প ভেঙ্গে পড়ে। দেশীয় বাণিজ্যের পতন ঘটে, বেকারত্ব বাড়ে এবং মানুষের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। চীনের এই আর্থিক দুর্দশার জন্য অনেকেই চীনের অর্থনীতিতে বিদেশী কুপ্রভাবকে দায়ী করেন। ফেয়ারব্যাঙ্কের মতে, সংক্ষেপে বক্সার আন্দোলন ছিল সমগ্র চীনাবাসীর জীবনে ঘনীভূত সঙ্কটের প্রত্যক্ষ উত্তর (In sum, the Boxer movement emerged as a direct response to a deepening crisis in the lives of the whole Chinese people)।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ :
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অর্থনৈতিক মন্দা, দেশীয় হস্তশিল্পের বিপর্যয় এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে আর্থিক শূন্যতা যখন চীনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল তখন তার সঙ্গে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যুক্ত হয়ে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। বিদ্রোহকেই তারা মুক্তির পথ হিসেবে বেছে নেয়। ইয়েলো (Yellow) নদীর বন্যায় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে শানটুং প্রদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শানটুং-এর শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হ’লে ১ মিলিয়নেরও বেশি লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রায় একই ধরনের বন্যায়, জেচুয়ান, কিয়াংসি কিয়াংসু, আনহয়েই অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। উত্তর চীনে খরার দরুণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। নিঃস্ব মানুষ ভবঘুরের জীবন যাপন শুরু করে। চীনের সাধারণ মানুষ থেকে সম্ভ্রান্ত জেন্ট্রিশ্রেণী সবাই তাদের এই দুর্গতির জন্য বিদেশী ও খ্রিস্টধর্মের কুপ্রভাবকে দায়ী করে। বস্তুত বক্সার বিদ্রোহের পূর্বে সহায় সম্বলহীন হতাশাগ্রস্ত মানুষের প্রবাহই বিদ্রোহের পথ উন্মুক্ত করেছিল। বক্সার বিদ্রোহীরা নিজেরাই কৃষক সমাজ থেকে এসেছিল; কিন্তু তাদের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বঞ্চিত এবং হতাশাগ্রস্তদের মধ্যবর্তী স্তর থেকে এসেছিল। তাদের মধ্যে ছিল সন্ন্যাসী, ছোট ব্যবসায়ী, জ্যোতিষী ইত্যাদি শ্রেণীর লোক।
মূল্যায়ন :
বক্সার বিদ্রোহ শুরু হলে মাঞ্চু ও চীনা রাজকর্মচারীরা বিদ্রোহীদের সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন। মাঞ্চু সরকার বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়ে ছিল কারণ সম্রাজ্ঞী দোয়াগার এর দ্বারা বিদেশী আগ্রাসন এবং স্থানীয় বিদ্রোহ এই দুই ভীতি দূর করতে চেয়েছিলেন। কেননা তিনি জানতেন এই ভীতির যে কোন একটি অপরটিকে উসকে দিয়ে বিপর্যয় ঘটাতে পারে। ১৮৯৮-এর সেপ্টেম্বরে সম্রাটের প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা নিয়ে জু-সি ঘোষণা করেন যে বিদেশী শক্তিবর্গকে আর কোন ‘কনসেসন’ দেওয়া হবে না। মাঞ্চু সরকার প্রাদেশিক শাসন কর্তাদের নির্দেশ দেন, যে কোনভাবে, প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে বিদেশী আগ্রাসনকে রুখতে হবে। এইভাবে মাঞ্চু সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে বক্সার বিদ্রোহ শুর হয়।