StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

বাংলার নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো

 

বাংলার নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো । 

বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেকে নবজাগরণের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন যে, ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রচণ্ড গতিবেগ ও প্রাণশক্তির অভাব ছিল বাংলার নবজাগরণের মধ্যে (The renaissance in Bengal lacked the tremendous sweep and vital energy of the many sided upsurge in the midst of which was shaped its European prototype)।

গোপাল হালদার উনিশ শতকের নবজাগরণকে রেনেসাঁস বলতে চান না কারণ ভারত ছিল পরাধীন, ইতালির নগর-রাষ্ট্রগুলির মতো স্বাধীন নয়। ঔপনিবেশিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় যে রেনেসাঁস হয় তা পুরোপুরি মানসিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, নতুন শক্তির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়নি। সাধারণত দুভাবে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বিচার করা হয়। প্রথম বিচার হল এটি একটি সার্থক সাংস্কৃতিক বিপ্লব, অপরটি হল এটি একটি আরোপিত ঘটনা। এদেশের সমাজ বাস্তবতা, সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বা আলো-জল-হাওয়া থেকে এই রেনেসাঁসের উৎপত্তি হয়নি। 

অশোক মিত্র লিখেছেন যে, অনেকসময় ভুল করে নবজাগরণকে রেনেসাঁস নামে অভিহিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে কয়েকটি শহরের বাইরে বিশাল বঙ্গদেশে কোনো অস্তিত্ব ছিল না এই তথাকথিত রেনেসাঁসের। এদেশে শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেনি, এদেশের পুঁজিপতি শ্রেণি জমিতে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল। রেনেসাঁসের প্রকৃত আর্থ-সামাজিক ভিত্তি তৈরি হয়নি। বাণিজ্যিক শহর কলকাতা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী, কলকাতার উচ্চ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, দালাল বা মুৎসুদ্দি যারা ছিলেন রেনেসাঁসের ধারক ও বাহক তাঁরা ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে লালিত পালিত হন। এর সীমা অতিক্রম করে তারা তাদের প্রতিভার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে পারেননি। 

ঔপনিবেশিক সরকার শাসনের প্রয়োজনে ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা ইত্যাদি সীমিতক্ষেত্রে পরিবর্তন চেয়েছিল। এগুলির সংস্কারে তাদের আপত্তি ছিল না, বরং অনেকক্ষেত্রে তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলার নবজাগরণের প্রথম দুর্বলতা হল এর স্রষ্টারা অধিকাংশই ব্রিটিশ শাসনকে প্রগতির সমার্থক বলে ধরে নেন। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী যে ভারতবর্ষকে সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলেছিল সে ধারণা তাঁদের ছিল না। নবজাগরণের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের এক কাল্পনিক জগৎ তৈরি করে তাতে বাস করতেন।

দ্বিতীয়ত, এটি ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক, এদেশের কৃষক, শ্রমিক বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না (The elite in our renaissance were gulf apart from the common masses of our people and lived in a world of their own)।

তৃতীয়ত, এটি ছিল প্রধানত হিন্দু ভদ্রলোকদের আন্দোলন, বাংলার মুসলমান সমাজ এই আন্দোলনের বাইরে ছিল। এই রেনেসাঁসের পথ ধরে মাথা তুলেছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ, এই জাতীয়তাবাদ বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ভারতের জাতীয় জীবনের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছিল (The Hindu bias usually prevalent in the awakened gentlemen of our movement could not but alienate the Muslim consciousness which has unfortunate consequences, much to the gratification of our alien British rulers)। বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর এতে অবশ্যই সুবিধা হয়েছিল। এর পরিণতি হল উনিশ শতকের শেষদিকে বাংলায় হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রবল হয়ে উঠেছিল। নবজাগরণের আরও অনেক দুর্বলতা ছিল।

চতুর্থত, নবজাগরণের নেতারা কোনো দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন বা নতুন আদর্শবাদ গড়ে তুলতে পারেননি। বাংলার সমাজ কাঠামো, জাতিভেদ-বর্ণভেদ, বিবাহ প্রথা, ধর্মীয় বিভেদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটেনি। বলা যায় এদের প্রয়াস সত্ত্বেও পুরোনো কাঠামো অটুট রয়ে যায়। নবজাগরণের মনীষীরা ছিলেন সংগ্রাম বিমুখ, বিদেশি শাসন, সামন্ততান্ত্রিক শোষণ বা জনগণের নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশার প্রতিকারকল্পে তাঁরা কোনো সংগ্রাম করেননি। অনেক সময় শোষণের উৎস বা পরিণতি সম্পর্কে তাদের কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিল না। অনেক সময় কৃষক বিদ্রোহ বা গণ-অভ্যুত্থানগুলির তাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন। তিতুমিরের বিদ্রোহ বা সাঁওতাল বিদ্রোহ তাদের সমর্থন লাভ করেনি। নীল বিদ্রোহের সময় বাংলার বুদ্ধিজীবীরা কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন।

বাংলার নবজাগরণ এদেশে বলিষ্ঠ যুক্তিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। প্রাচ্য ও পশ্চিমি সভ্যতার সমন্বয়ে সীমিতক্ষেত্রে নবজাগরণ  ঘটানোর প্রয়াস চালানো হয়েছিল। বেশিরভাগ মানুষ এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিধির বাইরে ছিল। এই নবজাগরণের বাস্তব ভিত্তি ছিল দুর্বল, দেশে শিল্প বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেনি, শক্তিশালী শিক্ষিত পরিবর্তনকামী বুর্জোয়া শ্রেণি এর নেতৃত্ব দেয়নি। ভূমি-নির্ভর, চাকরিজীবী, পেশাদার শ্রেণি ছিল এর নেতৃত্বে। কৃষক, শ্রমিক ও মুসলমান সমাজের ওপর এর প্রভাব পড়েনি।

নবজাগরণের স্রষ্টারা ব্রিটিশ শাসনকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করেন, ঔপনিবেশিক শাসনের শোষণমূলক দিকটির সঙ্গে তাদের পরিচয় গড়ে ওঠেনি। অবাধ বাণিজ্যের ক্ষতিকারক দিক বা শিল্পবিপ্লবের অভিঘাত নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেননি। এসব কারণে একে সার্থক সাংস্কৃতিক বিপ্লব হিসেবে মেনে নিতে অনেকে রাজি নন। খুব অল্পসংখ্যক মানুষ নবজাগরণের বৃহত্তর ইতিবাচক ভূমিকায় বিশ্বাসী। এসব সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও বলা যায় নবজাগরণ অন্তত সীমিতক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছিল। ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার ইঙ্গিত মিলেছিল। ভারতের ঐতিহ্য-নির্ভর অচলায়তনে তাঁরা পরিবর্তনের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে বলা যায় নবজাগরণ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *