StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

বাংলার নবজাগরণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

 

বাংলার নবজাগরণের বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো । বাংলার নবজাগরণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর অবদান ।

ভূমিকা : 

উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী সংস্কারক হলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১১)। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর চরিত্রের মধ্যে দেখেছেন অখণ্ড পৌরুষ, তিনি কখনও অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি, অসত্যকে মেনে নেননি। ‘বিদ্যাসাগর চরিত্রে যাহা সর্বপ্রধান গুণ, যে গুণে তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগ প্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে, করুণার অশ্রুজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন।

বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবকাল হল রেনেসাঁসের সংকটকাল, চল্লিশের দশকে রামমোহন নেই, ডিরোজিও নেই, ধর্মসভা ও ইয়ং বেঙ্গলের মধ্যে বিরোধ চলেছে। পঞ্চাশের দশকে বিদ্যাসাগর তাঁর পড়াশোনা শেষ করে বাংলার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন (In the fifties we find him emerging as an undisputed leader of the reformers in Bengal)। তাঁর মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ গুণাবলির প্রকাশ ঘটেছিল, অনেকে তাঁর মধ্যে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান মানবতাবাদের প্রকাশ লক্ষ করেছিলেন। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, মানবতাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ( we see in him the ideal development of a renaissance personality, the emergence of the rugged ego and individual with promethean consciousness of doing good to humanity in one’s own way)।

মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান সংস্কৃত কলেজে লেখাপড়া শিখে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে একজন শিক্ষক হিসেবে কাউন্সিল অব এডুকেশনের কাছে শিক্ষা সংক্রান্ত যে প্রতিবেদনটি তিনি পেশ করেন তাতে তিনি নির্ভীকভাবে পাঠক্রম পরিবর্তনের সুপারিশ করে শিক্ষাকে বাস্তব প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী করে তুলতে বলেছিলেন। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি সংস্কৃত কলেজের দুয়ার অব্রাহ্মণদের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের জন্য তিনি ইংরাজি ও পশ্চিমি জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। বিদ্যাসাগর শুধু আদর্শবাদী নন, বাস্তববাদীও।

বাংলার নবজাগরণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর অবদান  : 

বাংলার নবজাগরণে (রেনেসাঁসে) বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বড়ো অবদান হল শিক্ষাগুরু হিসেবে। মানব ইতিহাসের বিধাতা তাঁকে বাঙালিকে মানুষ করার ভার দেন। বিদ্যাসাগর সঠিকভাবে বুঝেছিলেন দেশবাসীকে আধুনিক হতে হলে শিক্ষিত হতে হবে। টোল বা মক্তবের শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি জগৎসভায় আসন পাবে না। এজন্য তিনি প্রাথমিকস্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংকল্প করেন। নিজে লিখলেন বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ, বিদ্যাসাগরের হাতে বাঙালির বর্ণ পরিচয় হল নতুন করে।

মাতৃভাষায় শিক্ষা বিস্তার প্রকল্পের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন নারী শিক্ষা বিস্তারের কাজ ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন যখন বেথুন ফিমেল স্কুল স্থাপনের পরিকল্পনা করেন তিনি বিদ্যাসাগরকে তার সঙ্গে যুক্ত করেন ১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও নদিয়ার ৩৫টি নারী শিক্ষায়তন স্থাপন করেন, এতে শিক্ষা পেত ১,৩০০ ছাত্রী। এর আগে ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিভিন্ন জেলায় ২০টি মডেল ভার্নাকুলার স্কুল স্থাপন করেছিলেন। অনেক সময় এসব বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বিদ্যাসাগর নিজের অর্থ ব্যয় করতেন। সরকার উচ্চশিক্ষা সংকোচনের সিদ্ধান্ত নিলে বিদ্যাসাগর কলকাতায় মেট্রোপলিটন কলেজ স্থাপন করেন, শেষদিন পর্যন্ত তিনি এই কলেজ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলার সাধারণ মানুষ যাতে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য তিনি নিজের অর্থ ব্যয় করে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন।

বিদ্যাসাগরের গুণমুগ্ধ বন্ধু ছিলেন মাইকেল মধুসুদন দত্ত। তিনি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে লিখেছেন যে, তাঁর ছিল প্রাচীন ঋষির মতো প্রজ্ঞা, ইংরেজের মতো কর্মশক্তি আর বাঙালি মায়ের মতো কোমল হৃদয় (Vidyasagar had the genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengalee mother)। এই অসাধারণ মানবদরদি মানুষটি অন্যের দুঃখকষ্ট দেখে বিচলিত হয়ে পড়তেন। নারী জাতির দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি কাতর হয়ে পড়তেন। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে শিশু বিবাহের বিরোধিতা করে তিনি একটি পুস্তিকা লেখেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করার জন্য তিনি ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। তাঁকে সবচেয়ে যন্ত্রণা দিত বাঙালি হিন্দু মহিলার বৈধব্যজনিত দুঃখ-দুর্দশা। শৈশবে কয়েকজন অসাধারণ স্নেহশীলা মহিলার স্নেহ তিনি পেয়েছিলেন, এদের প্রতি তাঁর ঋণের কথা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন। ২ বিধবা-বিবাহ আন্দোলনকে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম বলে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে দুখানি পুস্তিকা লিখে তিনি বিধবা-বিবাহের সপক্ষে জনমত গঠন করেন। পরাশর সংহিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে নষ্টে মূতে প্রব্রজ্যিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চ স্বাপৎসু নারীনাং পতিরনো বিধিয়তে। তিনি দেখান যে বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ, অন্যায় বা অবৈধ নয়। উল্লেখ্য বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ প্রস্তাবের বিরোধিতা ছিল, ধর্মসভা ও রক্ষণশীল হিন্দুরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। বিদ্যাসাগর চরিত্রের এক মহৎ গুণ হল কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে কখনও সরে দাঁড়াতেন না। এই প্রথাকে তিনি অমানবিক বলে গণ্য করেন কারণ সমকালীন সমাজে বিধবাদের মধ্যে ব্যভিচার ও ভ্রূণ হত্যার ঘটনা ছিল খুব বেশি। এই সামাজিক কলঙ্ক থেকে জাতিকে উদ্ধারের অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। তবে সেযুগের সকলে তাঁর বিধবা-বিবাহ পরিকল্পনার বিরোধী ছিলেন না, ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী এবং ভারতের বিভিন্ন  অঞ্চলের উদারপন্থী প্রগতিশীলরা তাঁর প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিল। শান্তিপুরের তাঁতিরা কাপড়ে লিখলেন : ‘সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে’। বিধবা-বিবাহের সমর্থনে জনমত গঠনে সক্ষম হলেও তিনি জানতেন সরকারি সমর্থন ছাড়া বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন করা যাবে না। এজন্য তিনি বাংলার ছোটোলাট জে. পি. প্লান্টকে এই মর্মে একটি আইন পাশ করার অনুরোধ জানান। রাধাকান্ত দেব বিধবা-বিবাহ আইনের বিরোধিতা করে আবেদন করেছিলেন, তা সত্ত্বেও বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হয়ে যায় (১৮৫৬)। 

বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হলেও তাঁকে বাস্তবে প্রয়োগ করা সহজ কাজ ছিল না। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে কলকাতায় প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিদ্যাসাগর আর ফিরে তাকাননি, একের পর এক বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করেন। এই বিধবা-বিবাহ দিতে গিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়ে যান, সেযুগে প্রায় ষাট হাজার টাকা তিনি এজন্য ব্যয় করেছিলেন। অনেক দুঃস্থ মহিলাকে তিনি আর্থিক সাহায্য পাঠাতেন। যে যুগে বিদ্যাসাগরের মাসিক আয় ছিল চার হাজার টাকা, এই অর্থের বেশিরভাগ তিনি সেবামূলক কাজে ব্যয় করেছিলেন (He continued to arrange for widow remarriages staking his last resources, even at times his own life)।

বিধবা-বিবাহ আন্দোলন পরিচালনাকালে বিদ্যাসাগরকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল রক্ষণশীলরা। বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ আন্দোলন শুধু বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ভারতের বিভিন্ন স্থানেও এর প্রভাব পড়েছিল। বোম্বের প্রার্থনাসমাজ বিধবা-বিবাহের সমর্থনে জনমত গঠন করেছিল, বিধবাদের বিবাহ দানের কাজ শুরু করেছিল। বিধবা-বিবাহের সমর্থনে ইয়ং বেঙ্গল ও ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা এগিয়ে এসেছিলেন। বিদ্যাসাগরের আগে থেকে বিধবা-বিবাহ নিয়ে শিক্ষিত সমাজে বিতর্ক শুরু হয়েছিল, কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেনি। বিধবা-বিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগর এটি সামাজিক আন্দোলন তৈরি করতে সক্ষম হন। কিন্তু রক্ষণশীল মানুষজন এই আইন থাকা সত্ত্বেও বিধবা বিবাহে অনীহা দেখিয়েছিল। তবে এই আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখে মনে হয় বিদ্যাসাগর একেবারে ব্যর্থ হননি।

শুধু বিধবা-বিবাহ আন্দোলন করে বিদ্যাসাগর তাঁর কর্তব্য শেষ করেননি। সামাজিক সবরকম কুপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। বহুবিবাহ, শিশুবিবাহ, কুলীন প্রথা ইত্যাদি সম্পর্কে পুস্তিকা লিখে তিনি শিক্ষিত মানুষজনকে সচেতন করে তোলেন। কুলীন প্রথা সম্পর্কে তাঁর পুস্তিকায় প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর এসব পুস্তিকা লিখে জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এদের পেছনে শাস্ত্রের সমর্থন নেই। এসব কুপ্রথার জন্য হিন্দু সমাজের যে ক্ষতি হচ্ছে সেকথা তিনি জোরের সঙ্গে প্রচার করেন। ভারত সরকার বহুবিবাহ বিরোধী কোনো আইন পাশ করতে রাজি না হওয়ায় আন্দোলন অনেকখানি স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, তবে বিদ্যাসাগর আশা করেন যে শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ ও নারী উভয়ে এই কুপ্রথা থেকে মুক্তি পাবে। বিদ্যাসাগরের উদ্যোগের ফলে এইসব কুসংস্কার ও কুপ্রথার তীব্রতা হ্রাস পেয়েছিল।

বিদ্যাসাগর শুধু সমাজসংস্কার ও শিক্ষাবিস্তারের কাজ নিয়ে দিন কাটাননি। তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষ। সোমপ্রকাশ ও হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা পরিচালনার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় লিখলেন সংস্কৃত ব্যাকরণ, সীতার বনবাস, শকুন্তলা ও বেতাল পঞ্চবিংশতি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্য সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন। ভাষা যে কেবল ভাবের একটা আধারমাত্র নহে, তাঁহার মধ্যে যেনতেন প্রকারেন কতকগুলো বক্তব্য বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্তব্য সম্পন্ন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্ত দ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়াছিলেন। তিনি দেখাইয়াছিলেন যে যতটুকু বক্তব্য, তাহা সরল করিয়া, সুন্দর করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে’। সীতার বনবাসে গদ্যশিল্পী বিদ্যাসাগর এধরনের গদ্য লিখেছেন : ‘এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমার অলংকৃত, অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়, পাদদেশে প্রসন্ন সলিলা গোদাবরী তরঙ্গ বিস্তার করিয়া প্রবল বেগে গমন করিতেছে’। রেনেসাঁস পণ্ডিতদের মতো বিদ্যাসাগর শুধু লেখেনি, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনেক ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের সংকলন ও সম্পাদনা করে রেখে গেছেন।

রেনেসাস পণ্ডিতদের মতো বিদ্যাসাগর কখনও ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাননি। ঈশ্বর আছেন কি নেই এই প্রশ্ন নিয়ে তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণে নামেননি। তিনি বলতেন ‘ধর্ম যে কি মানুষের বর্তমান অবস্থায় তা জানার উপায় নেই, জানার কোনো দরকার নেই । তাঁর কাছে মানুষই সত্য, তাকে সেবা করাই তাঁর আদর্শ। সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্ক তাঁকে স্পর্শ করেনি। এক মুসলমান ফকিরের মরমিয়া গান শুনতে তিনি ভালোবাসতেন। বর্ধমানের রাস্তা থেকে এক মুসলমান কলেরা রোগীকে তুলে নিয়ে গিয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। মানবতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ এই মানুষটি ছিলেন আসলে করুণাসাগর। বন্ধু মাইকেল তাঁকে করুণাসাগর আখ্যা দেন (Not only Vidyasagar but Karunasagar also)। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে কবি যে সনেটটি লেখেন তার শুরু এরকম : “বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে, করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে, দীন যে, দীনের বন্ধু’। কবি মাইকেল শুধু নয়, দেশের বহু মানুষ তাঁর করুণা লাভ করেন। বাংলার বহু দুঃস্থ নরনারী, ছাত্র, বিধবা, তাঁর করুণার পাত্র ছিল। তিনি অনেক সময় ধার করে পরের উপকার করতেন। এসব করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর নিঃস্ব হয়ে যান তবু পরোপকার ব্রত থেকে তিনি কখনও সরে দাঁড়াননি। রাজনীতি নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে তাতে যোগ দেননি। তাঁর বিরুদ্ধে বড়ো অভিযোগ হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের তিনি বিরোধিতা করেননি। সেযুগের গণবিদ্রোহগুলি তাঁর সমর্থন লাভ করেনি, তিতুমির, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহ বা নীল বিদ্রোহের পক্ষ সমর্থন করে তিনি বক্তব্য রাখেননি। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার মায়াজাল ছিন্ন করে তিনি স্বাধীন, স্বতন্ত্র বিকাশের পথের কথা বলেননি।

বিদ্যাসাগর কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু ধর্মের সংস্কারের কথা বলেননি কারণ ধর্ম সম্পর্কে তিনি নিজেই অনেকখানি সংশয়ের মধ্যে ছিলেন। শিক্ষা ও সমাজসংস্কার নিয়ে তিনি যে আন্দোলন করেন তাতেও তিনি দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন পাননি, বরং বিরোধিতা পেয়েছেন, তিনি হলেন আধুনিক ঐতিহাসিকের চোখে ‘traditional moderniser । ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আধুনিকতা আনতে চেয়েছেন, শাস্ত্রকে নস্যাৎ করে নয়, শাস্ত্রের মধ্যে তিনি সংস্কারের পক্ষে যুক্তি খুঁজেছেন। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁকে বলেছেন নিঃসঙ্গ প্রমিথিয়ুস ( lonely Prometheus)। এই নিঃসঙ্গ প্রমিথিয়ুস মানুষের মঙ্গলের জন্য অশেষ কষ্ট ভোগ করেছেন, সর্বস্বপণ করে মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন বিদ্যাসাগর ছিলেন যুগোত্তীর্ণ মহাপুরুষ।

অতীত ঐতিহ্য, আধুনিক মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ ও উদারনীতির মধ্যে তিনি সমন্বয় সাধন করেন। কোনো দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত না হয়েও একক প্রচেষ্টায় তিনি কুসংস্কারাজরা জাতির পরিবর্তনের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেন। তাঁর মাতৃভক্তি বাঙালি জীবনে আদর্শ হয়ে আছে। কতভাবে না তিনি লোকশিক্ষা দিয়ে গেছেন। সদ্যোজাত শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের অহমিকাকে তিনি নির্মমভাবে আঘাত করেছেন। আবার মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি বর্ধমানের এক ভিখারি বালককে জীবনে স্বয়ম্ভর হবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বিদ্যাসাগর সর্বার্থে বাঙালি জাতির শিক্ষাগুরু। তিনি সব সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে পারেননি। বিধবা-বিবাহ শিক্ষিত মানুষের সমর্থন পেলেও সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তিনি সব পুরুষ বা সব মহিলাকে শিক্ষা দিতে পারেননি, তবে ঔপনিবেশিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে তিনি পথ করে দিয়েছিলেন, তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে জাতি এগিয়েছে। বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে বিদ্যাসাগর সমকালের বহু মানুষকে প্রভাবিত করেন।

এদের মধ্যে বিখ্যাত নামগুলি হল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রমুখ সেযুগের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা। তিনি আধ্যাত্মিক মার্গের লোক ছিলেন না, তবুও রামকৃষ্ণদেব তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।

মূল্যায়ন : 

রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের পণ্ডিতপ্রবর জনসনের সঙ্গে তাঁর তুলনা করেছেন : ‘আধুনিক ইংল্যান্ডে বিদ্যাসাগরের ঠিক উপমা পাওয়া যায় না। কেবল জনসনের সহিত কতকগুলি বিষয়ে তাহার অত্যন্ত সাদৃশ্য দেখিতে পাই। সে সাদৃশ্য বাহিরের কাজে ততটা নয়, কারণ কাজে বিদ্যাসাগর জনসন অপেক্ষা অনেক বড়ো ছিলেন, কিন্তু এই সাদৃশ্য অন্তরের সরল, প্রবল এবং অকৃত্রিম মনুষ্যত্বে। জনসনও বিদ্যাসাগরের ন্যায় বাহিরে রূঢ় ও অন্তরে সুকোমল ছিলেন। জনসনও পাণ্ডিত্যে অসামান্য, বাক্যালাপে সুরসিক, ক্রোধে উদ্দীপ্ত, স্নেহরসে আর্দ্র, মতে নির্ভীক, হৃদয়ভাব অকপট এবং পরহিতৈষায় আত্মবিস্মৃত ছিলেন। দুর্বিষহ দারিদ্র্যও মুহূর্তকালের জন্য তাঁদের আত্ম সম্মান আচ্ছন্ন করিতে পারে নাই’।” সুতরাং, তাঁর সমালোচকরা যাই বলুন না কেন বিদ্যাসাগর আজও বাঙালি জনমানসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। তাঁর ঋজু চরিত্র, বিচিত্র কর্মকাণ্ড এবং মানবতাবাদী করুণাময় রূপটি আজও বাঙালিকে অনুপ্রেরণা জোগায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো মহামানব নেই যাঁর কোনো ত্রুটি নেই, অপূর্ণতা নেই, ভ্রান্তি নেই। উপকথা বা লোককথায় এমন মহাপুরুষের সাক্ষাৎ মেলে, বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *