StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

বাদামির চালুক্যদের আমলে দাক্ষিণাত্যের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি

বাদামির চালুক্যদের আমলে দাক্ষিণাত্যের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি । 

ভূমিকা : 

বাদামির পশ্চিমী চালুক্যরা তুঙ্গভদ্রার অপরপারে অবস্থিত কাঞ্চীর পল্লবদের সঙ্গে অনবরত সংঘাতে যে লিপ্ত ছিলেন এবং পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য গ্রাস করে সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে ব্যস্ত ছিলেন তা আগের আলোচনা থেকে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার ঐ সমস্ত কাজে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও প্রায় দুশো বছরব্যাপী শাসনকালে চালুক্যরা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায় শিল্পকলা তথা স্থাপত্য ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে। আলোচ্য সময়ে দাক্ষিণাত্যে ধর্মীয় বিবর্তনও ছিল লক্ষণীয়। এই দুই বিষয় ছাড়াও ভাষা-সাহিত্যের কিছুটা উন্মেষ ঘটেছিল।

ভাষা-সাহিত্য : 

স্বাভাবিকভাবেই সংস্কৃত ভাষার কদর ছিল। চালুক্য লেখগুলি প্রধানত রচিত হয়েছিল সংস্কৃত ভাষাতেই। পরবর্তীকালের কিছু চালুক্য লেখতে প্রথম দিকের শাসক প্রথম পুলকেশী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তিনি ছিলেন মনুস্মৃতি, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের অনুরক্ত। মহাকূট শিলালেখয় যে অলংকৃত গদ্যের ব্যবহার ঘটেছে তার সঙ্গে বাণভট্টের লেখনীর অনেক সময় তুলনা করা হয়। আবার আইহোল প্রশস্তির রচয়িতা রবিকীর্তি নিজেকে ভারবি ও কালিদাসের সমতুল্য বলে দাবি করেছেন (“স বিজয়তাং রবিকীর্তি কবিতাহিত-কালিনাস — ভারবি-কীর্তি’)। এই সমস্ত দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে চালুক্যদের আমলে সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের যে চর্চা চলত এবং সাহিত্যিক অগ্রগতি যে একেবারে নগণ্য ছিল না তা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।

আইহোলে একটি ছোট্ট কবিতায় দ্বিতীয় পুলকেশীর কার্যকলাপের যে বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে বিচার করলে বলা যায় তাও একেবারে নগণ্য নয়। এই সমস্ত শিলালৈখিক বিবরণ চালুক্য যুগের সংস্কৃত সাহিত্যের প্রচলনের বিষয়টি প্রমাণ করে। আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলা যায় দ্বিতীয় পুলকেশীর এক পুত্র চন্দ্রাদিতার স্ত্রী বিজয় ভট্টারিকাকে সাধারণভাবে মহিলা কবি বিজয়ানকা বা বিজ্জিকার সঙ্গে শনাক্ত করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, রাজশেখর লেখার ভঙ্গিমা বা রীতির দিক থেকে বিচ্ছিকাকে কালিদাসের পরেই স্থান নিয়েছেন।

ধর্মভাবনা‌ : 

চালুক্য রাজারা ছিলেন ব্রাহ্মণ। স্বাভাবিকভাবেই বৈদিক ব্রাহ্মণ্য রীতি নীতির প্রচলন লক্ষ করা যায় চালুক্য আমলে। চালুক্যদের প্রথম দিকের উল্লেখযোগ্য শাসক প্রথম পুলকেশী বেশ কিছু বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বাজপেয়, অশ্বমেধ, অগ্নিস্তমো, অগ্নিচয়ন হিরণ্যগর্ভ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁর পুত্র প্রথম কীর্তিবর্মণও পিতার ন্যায় অগ্নিস্তমো, বহুসুবর্ণ বৈদিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পরবর্তীকালের চালুক্য শাসক বিজয়াদিত্যের আমলেও হিরণ্যগর্ভ দান অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল। 

চালুক্য রাজারা পৌরাণিক ধর্ম ও লৌকিক দেবদেবীর প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। এর প্রমাণ মেলে ঐ সময়ের বিভিন্ন লেখ থেকে। চালুক্য রাজ প্রথম কীর্তিকর্মণের সময়ের বাদামি স্তম্ভলেখ (৫৭৮ খ্রিঃ) থেকে অবহিত হওয়া সম্ভব হয় যে, তাঁর ছোটভাই মঙ্গলেশের তত্ত্বাবধানে বাদামিতে একটি সুন্দর বিষ্ণু মন্দির নির্মিত হয়েছিল। আদি পর্বের চালুক্যদের আমলেরই বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গেছে বাদামিতে। চালুক্য শাসকদের কেউ কেউ নিজেদের ‘পরম ভাগবত’ বলে ঘোষণা করতেন। চালুক্যদের পারিবারিক দেবতা ছিলেন বিষ্ণু। চালুক্য রাজারা নিজেদের বিষ্ণুর অবতার বলে দাবি করতেন। এমনকি ‘শ্রী-পৃথিবীবল্লভ’ অভিধা গ্রহণ করতেন, যা ইতিপূর্বে রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাদামির চালুক্যদের পারিবারিক দেবতা হিসাবে বিষ্ণু পরিগণিত হলেও শৈব ধর্মের প্রসার ঘটেছিল। শিব ও কার্তিক পূজিত হতেন। বেশ কিছু শৈব মন্দির নির্মাণের উল্লেখ আছে এই যুগের লেখমালায়। প্রসঙ্গত বলা যায় বাদামি, পদকল মহাকুট—এই অঞ্চলগুলিতেই প্রধানত শৈব মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছিল। প্রথম কীর্তিকর্মণ বিষ্ণুর উপাসক হলেও মকুটেশ্বরনাথ (শিবেরই একটি রূপ) মন্দিরের উদ্দেশ্যে একটি গ্রাম দান করেছিলেন। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর ভ্রাতুষ্পুত্র নাগবর্ধনের খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের একটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, নাসিক জেলার ইগাতপুরীর নিকটবর্তী একটি গ্রাম কপালেশ্বর শিবের পূজার ব্যয় হিসাবে বরাদ্দ ছিল।

চালুক্যরাজ বিজ্যাানিত্য বিজ্ঞাপুর জেলার পদকল-এ বিজয়েশ্বর (বর্তমানে সঙ্গমেশ্বর নামে পরিচিত) নামে এক বিশাল শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। বিজয়াদিত্যের পুত্র দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের প্রধান মহিষী মহাদেবী লোক-মহাদেবী পদেকলে লোকেশ্বর নামে বিশালাকার আর একটি মন্দির নির্মাণ করেন। এটি এখন বিরূপাক্ষ মন্দির নামেই প্রসিদ্ধ। এই মন্দিরের কাছেই তার অপর মহিষী রানী ত্রৈলোক্যমহাদেবী ত্রৈলোকেশ্বর নামে একটি সুন্দর শিব মন্দির নির্মাণ করেন। এছাড়া, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে চালুক্য শাসকগণের পৃষ্ঠপোষকতায় আইহোলে বিখ্যাত দুর্গা মন্দির নির্মিত হয়। উল্লেখ্য, এই মন্দিরের দেওয়ালে মহিষ নিধনরতা অষ্টভুজা দেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ হয়েছে।

বৈষ্ণব ও শৈব ধর্মের অনুরক্ত হলেও চালুক্য রাজারা জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। এর প্রমাণ মেলে সমকালীন সাহিত্যিক উপাদান বিশেষত হিউয়েন সাঙের বিবরণ ও লেখমালায়। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল প্রশস্তির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এর থেকে জানা যায় যে ঐ প্রশস্তির রচয়িতা জৈন ধর্মানুরাগী রবিকীর্তি আইহোল গ্রামে জিনেন্দ্রর একটি মন্দির নির্মাণ করেন, যা মেগুটি মন্দির নামে পরিচিত। এছাড়া, চালুক্য রাজগণ যথা— কিনয়াদিত্য, বিজয়াদিত্য ও দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য জৈন ধর্মগুরুদের দান এবং নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন—এমন ধারণা প্রচলিত আছে। সর্বোপরি, আদি চালুক্য রাজাদের সময়ের দুটি জৈন গুহার সন্ধান পাওয়া গেছে যথাক্রমে বাদামি ও আইহোলে। প্রসঙ্গত বলা যায় এই গুহা দুটিতে জৈন তীর্থঙ্করদের ছবি চিত্রিত হয়েছে। সুতরাং চালুক্যদের আমলে যে দাক্ষিণাত্যে কোন ধর্ম সুপরিচিত ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

চালুক্যদের সময়ে দাক্ষিণাত্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য অন্যতম প্রধান তথ্য হিসাবে হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণকে কাজে লাগানো হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, চীনা পর্যটক ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে মো-হ-ল-চ (মহারাষ্ট্র)-য় গিয়েছিলেন এবং সে সম্পর্কে এক মনোজ্ঞ বিবরণ লিপিবন্ধ করেছেন সি-ইউ-কি-তে, যা থেকে হর্ষ-পুলকেশী বিরোধ ছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থান সম্পর্কে বোঝা সম্ভব হয়। তিনি লিখেছেন, ………এখানের মানুষ বৌদ্ধ ও অন্য ধর্ম দুয়েরই চর্চা করে একশোটির কাছাকাছি সংঘারাম আছে এখানে। পাঁচ হাজারের মতো বৌদ্ধ ভিক্ষুও আছেন। মহাযান ও হীনযান উভয়কেই তাঁরা অনুসরণ করেন।” এছাড়া তিনি লিখেছেন যে রাজা অশোক কর্তৃক নির্মিত রাজধানীর ভিতরে ও বাহিরে বুদ্ধদেবের স্মৃতি বিজড়িত পাঁচটি স্থানে পাঁচটি বৌদ্ধ স্তূপ আছে। 

বৌদ্ধ ধর্ম তথা বুদ্ধমূর্তি সংক্রান্ত আরো তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে তার বিবরণে। তিনি লিখেছেন, “রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে একটি দুরারোহ পর্বতমালা আছে। এর মাঝে একটি অন্ধকার উপত্যকায় ১০০ ফুটের মতো উঁচু একটি বিহার আছে। এখানে প্রায় ৭০ ফুট লম্বা একটি বুদ্ধমূর্তি আছে।…. বিহারটির চারপাশে পাথরের দেওয়ালগুলিতে বুদ্ধের বোধিসত্ত্ব জীবনের নানান ঘটনা চিত্রিত রয়েছে….।” সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে চালুক্য শাসকরা বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও এর বিরোধিতা করেননি—সাধারণ মানুষ তাদের ইচ্ছানুযায়ী ধর্ম বা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতেন। এদিক থেকে বিচার করলে চালুক্য রাজাদের ধর্ম সহিষ্ণুতার বিষয়টি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *