StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

বাদামির চালুক্য বংশের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর

বাদামির চালুক্য বংশের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর । Or, বাদামির চালুক্য বংশের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিতর্ক।

ভূমিকা : 

প্রাচীন ও আদি মধ্যভারতের ইতিহাসে আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ও বিকাশ নিশ্চিতভাবে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দক্ষিণাত্যে প্রথম আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে সাতবাহনের অভ্যুত্থান ঘটেছিল, যা ইতিপূর্বে ষোড়শ অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। সাতবাহনদের শাসনের অবসানের পর সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাকাটক রাজবংশ। বাকাটকরা ছিলেন গুপ্তদের সমসাময়িক। বাকাটকদের পর দক্ষিণাত্যের পশ্চিমাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়ে ওঠেন আদি বা পশ্চিমী চালুক্য বা সাম্রাজ্যবাদী চালুক্যরা। উত্তর কর্ণাটকের বিজাপুর জেলার বাতাপি বা বাদামি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এই রাজবংশ গড়ে উঠেছিল বলে এটি সাধারণভাবে বাতাপি বা বাদামির চালুক্য বংশ নামে পরিচিত।` খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ থেকে প্রায় খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কালে বাদামির চালুক্য বংশের শাসন বজায় ছিল।

বাদামির চালুক্য বংশের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য তথ্যের প্রাচুর্যতা রয়েছে। বেশিরভাগ তথ্যই শিলালেখ/ তাম্রশাসন নির্ভর। এই প্রসঙ্গে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ শিলালেখ/তাম্রশাসনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এগুলি হল যথাক্রমে প্রথম পুলকেশী (বল্লভেশ্বর)-র বাদামি লেখ (শকবর্ষ, ৪৬৫ বা ৫৪৩ খ্রিঃ), প্রথম কীর্তিকর্মণের ৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের বাদামি স্তম্ভলেখ, মঙ্গলেশের মহাকূট লেখ (৬০২ খ্রিঃ), দ্বিতীয় পুলকেশীর হায়দরাবাদ তাম্রশাসন (৬১২ খ্রিঃ), তাঁর ষষ্ঠ রাজ্যাঙ্ক বর্ষের একেরি শিলালেখ, লোহার তাম্রশাসন (৬৩০ খ্রিঃ) এবং আইহোল প্রশস্তি (৬৩৪ খ্রিঃ)। এছাড়া দ্বিতীয় পুলকেশীর পরবর্তীকালের শাসকদের নিরপান, করনুল, তোগরচেদু, নেরুর ও হোন্নুর তাম্রশাসন এই বংশের ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লেখগুলি প্রধানত সংস্কৃত ভাষায় লেখা। উল্লেখ্য, চালুক্যদের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রধানত পল্লবদের সঙ্গে সংঘর্ষের ইতিহাস।

স্বাভাবিকভাবেই পল্লব শাসকদের কিছু লেখও চালুক্যদের ইতিহাস বুঝতে সাহায্য করে থাকে, যেগুলি পরবর্তী অধ্যানে পল্লব রাজবংশ প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। সাহিত্যিক উপাদানের মধ্যে চীনা পর্যটক হিউয়েন সান্ধের বিবরণমূলক গ্রন্থ সি-ইউ কি, বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়াও সাংস্কৃতিক ইতিহাস বুঝতে সমকালীন স্থাপত্য ভাস্কর্যের নিদর্শনসমূহ কাজে লাগে।

বাদামির চালুক্য বংশের উৎপত্তি ও বিকাশ

উৎপত্তি সংক্রান্ত ইতিহাস আলোচনার শুরুতেই জেনে রাখা ভালো যে বাদামির চালুক্য বংশের লেখসমূহে ‘চালুক্য’ শব্দটি খুব অল্প ব্যবহৃত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চচ্চা, চালিকা, চলুকা, প্রভৃতি শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে, যদিও এই বংশের মৌলিক রূপ চালুক্য। যাই হোক না কেন, বাদামির চালুক্য বংশের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে এক সময় যথেষ্ট বিতর্ক ছিল, যদিও সাম্প্রতিককালে তা অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছে। এক শ্রেণীর ঐতিহাসিকের ধারণা প্রাচীন ভারতের কিছু রাজবংশের ন্যায় চালুক্যরা বিদেশ থেকে ভারতবর্ষে এসেছেন। এই শ্রেণীর পণ্ডিতদের মধ্যে অন্যতম হলেন বি. এল. রাইস, ভিনসেন্ট স্মিথ এবং ডি. আর. ভাণ্ডারকার।

রাইসের কাছে মনে হয়েছে যে চালুক্য ও পল্লবরা পার্থিয়া থেকে এদেশে এসেছেন। স্মিথ এবং ভাণ্ডারকার মনে করেন যে, চালুক্যরা ছিল গুর্জরদের একটি শাখা ৷ কিন্তু চালুক্যদের উৎপত্তি সংক্রান্ত বহিরাগত তত্ত্বটি তথ্যনিষ্ঠ না হওয়ায় এই মত যথেষ্ট দুর্বল। এখন মনে করা হচ্ছে চালুক্যরা ছিলেন দক্ষিণ ভারতেরই স্থানীয় অধিবাসী। দীনেশচন্দ্র সরকার, এ. এস. আলতেকার এই মতের সমর্থক।

৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের বাদামি লেখ থেকে জানা যায় যে চালুক্যরা মধ্য গোত্রভুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন তথ্যের সমন্বয়ে এ. এস. আলতেকার দেখিয়েছেন চালুক্যরা ছিলেন দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ বংশের মানুষ এবং কর্ণাটকের কদম্ব বংশের সঙ্গে কোনোভাবে তারা সংযুক্ত ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ চালুক্য বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক দ্বিতীয় পুলকেশীকে ক্ষত্রিয়া বলে উল্লেখ করেছেন। বিলহনের বিক্রমাম্বদেবচরিতের ওপর নির্ভর করে দীনেশচন্দ্র সরকার দেখিয়েছেন যে ‘চুলুক’ থেকে চালুক্য নামের উৎপত্তি হয় এবং সিদ্ধান্তে এসেছেন যে তাঁরা ছিলেন দক্ষিণ ভারতেরই স্থানীয় বাসিন্দা। এছাড়া, চালুক্যদের আরাধ্য দেবতা ছিলেন বিষ্ণু এবং কার্তিক। তাই এই সিদ্ধান্তে আসাই স্বাভাবিক হবে যে, তাদের আদি নিবাস ছিল কহল দেশ বা কর্ণাটক।

বাদামির চালুক্য বংশের একেবারে আদিপর্বের যে দুজন ব্যক্তির নাম জানা যায়। কয়েকটি চালুক্য লেখ-তে তাঁরা হলেন যথাক্রমে জয়সিংহ এবং তাঁর পুত্র রণরাগ। বিজাপুর জেলার বাদামি অঞ্চলে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের প্রথমভাগে এঁদের আবির্ভাব ঘটেছিল। জয়সিংহ বল্লভ বা বল্লভেন্দ্র অভিধা গ্রহণ করেছিলেন-মহারাজ বা ঐ জাতীয় কোনো অভিধা জ্যাসিংহ বা রণরাগের সঙ্গে সংযুক্ত হ্যানি। সমসাময়িক কোনো চালুক্য লেখতে এই দুই ব্যক্তির কোনো গৌরবজনক বা স্মরণীয় কোনো কর্মকাণ্ড লিপিবদ্ধ হয়নি। অনেক পরবর্তীকালের চালুক্য শাসক পঞ্চম বিক্রমাদিত্যের আমলের ১০০৯ খ্রিস্টাব্দের কৌথেম তাম্রশাসনে যদিও বলা হয়েছে যে জয়সিংহ রাষ্ট্রকূট শাসক কৃষ্ণের পুত্র ইন্দ্রকে অপসারিত করে চালুক্য বংশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তথাপি এই মত ইতিহাসসম্মত নয়। কেননা, কৃষ্ণ ও ইন্দ্র— এই দুই রাষ্ট্রকূট শাসকের আবির্ভাব ঘটেছিল জয়সিংহের আবির্ভাবের কয়েক শতক পরে।

চালুক্য বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রণরাগের প্রিয় পুত্র প্রথম পুলকেশী (আঃ ৫৩৫-৫৬৬ খ্রিঃ)। এই বংশের তিনিই প্রথম শাসক যিনি ‘মহারাজ’ অভিধা গ্রহণ করেন। ‘পুলকেশী’ নামটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘পরাক্রম সিংহ’। (সংস্কৃত ‘পুল’ শব্দের অর্থ হল ‘মহান’ বা পরাক্রম এবং ‘বেশী’ শব্দের অর্থ ‘সিংহ”)। প্রথম পুলকেশী বল্লভেশ্বর নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ‘সত্যাশ্রয়’ ও ‘রুবিক্রম’ অভিধাও গ্রহণ করেন। তার ৫৪৩ খ্রিস্টাব্দের (শক বর্ষ ৪৬৫) বাদামি লেখ থেকে জানা সম্ভব হয় যে তিনি বাতাপি (বর্তমান বিজাপুর জেলার বদামি )-তে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। এর থেকে অনুমান করা সম্ভব হয় যে বিজাপুর জেলার সংলগ্ন অঞ্চলে তিনি শাসন করতেন এবং তাঁর রাজধানী ছিল বাদামি। তিনি যে একজন যোদ্ধা ছিলেন তা পূর্বে উল্লেখিত তাঁর ‘রণবিক্রম’ অভিধা থেকে প্রমাণিত হয়।

বাতাপি (বাদামি)-তে দুর্গ নির্মাণ তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হলেও এটাই একমাত্র কৃতিত্ব নয়। তিনি বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুরাগী ছিলেন এবং বেশ কিছু বৈদিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তাঁর বাদামি লেখ থেকে জানা যায় যে, তিনি হিরণ্যগর্ভ ও অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান করেন। তাঁর অন্যতম পুত্র মঙ্গলশের মহাকূট লেখ থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে প্রথম পুলকেশী বাজপেয়, অগ্নিচয়ন প্রভৃতি যজ্ঞানুষ্ঠানও করেছিলেন। দক্ষিণ কোষনের বটপুর পরিবারের কন্যা দুর্লভমহাদেবীকে বিবাহ করে তিনি ঐ বংশের সঙ্গে আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর সময়েই চালুক্যদের রাজধানী আইহোল থেকে বাদামিতে স্থানান্তরিত হয়।

৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পুলকেশীর মৃত্যুর পর তার প্রথম পুত্র কীর্তিকর্মণ চালুক সিংহাসনে বসেন এবং ৫৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সগৌরবে রাজত্ব করেন। কীর্তিকর্মণ কীর্তিরাজ নামেও পরিচিত ছিলেন। পিতার ন্যায় তাঁর নামের আগেও মহারাজ অভিধা যুক্ত ছিল। চালুক্যদের শক্তি বৃদ্ধি ও শাসনাধীন এলাকার বিস্তৃতিতে তিনি মনোযোগী হয়েছিলেন। কীর্তিবর্মণের পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল প্রশস্তিতে নল, মৌর্য ও কদম্বদের বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্যের কথা উল্লেখিত হয়েছে।

বেল্লারি ও করনুলের নিকটস্থ নলবাড়ির নলদের কথা এখানে উল্লেখিত হয়েছে। মৌর্য বলতে এখানে ঐ সময়ে শাসনরত উত্তর কোঙ্কনের মৌর্যদের এবং কদম্ব বলতে উত্তর কানাড়া জেলার বর্তমান বনবাসী অঞ্চলে শাসনরত কদম্বদের কথা বলা হয়েছে। কদম্ব রাজাদের সংগঠনের ওপর তিনি আঘাত হেনেছিলেন, এমন কথাও বলা হয়েছে ঐ প্রশস্তিতে। ঐ তিনটি রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে কীর্তিবর্মণ যে চালুক্য বংশের এলাকা ও মান-মর্যদার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কীর্তিবর্মণের ভাই মঙ্গলেশের মহাকুট স্তম্ভলেখয় বাংলা থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত কীর্তিকর্মণের সাম্রাজ্য বিস্তৃতির যে কথা সগৌরবে উচ্চারিত হয়েছে তা অতিরঞ্জন ছাড়া আর কিছুই নয়।

৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কীর্তিকর্মণের মৃত্যুর সময় তাঁর পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশী একেবারেই নাবালক থাকায় তাঁর ভাই মঙ্গলেশ সিংহাসনে বসেন। তাঁর শাসন কাল ৫৯৮ থেকে ৬০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। তিনি মঙ্গলরাজ ও মঙ্গলীশ্বর নামেও পরিচিত ছিলেন। মঙ্গলেশ যে চালুক্য রাজ্যের বিস্তারে অগ্রণী হয়েছিলেন সে বিষয়ে অবহিত হওয়া সম্ভব হয় তাঁর নেরুর তাম্রশাসন এবং মহাকূট স্তম্ভ লেখ থেকে। এই লেখগুলি থেকে জানা যায় যে, গুজরাটের দক্ষিণাংশে এবং মালবের একাংশে শাসনরত কলচুরিরাজ সম্বরগণের পুত্র বুদ্ধরাজের বিরুদ্ধে তিনি একটি অভিযান প্রেরণ করেন এবং তাঁকে পরাজিত করেন।

৬০২ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিলের অল্পকাল আগে এই ঘটনা ঘটেছিল। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল ছয় বৎসর (৬০২-৬০৮ খ্রিঃ)। শেষপর্যন্ত অবশ্য কলচুরিদের শাসনাধীন সমস্ত এলাকা চালুক্য রাজের অধীনে আসেনি। সম্ভবত এই জয়লাভের ফলস্বরূপ নাসিক অঞ্চল চালুক্যদের অধিকারে এসেছিল। এছাড়া, পশ্চিম উপকূলে রেবতীদ্বীপ (রত্নগিরি জেলা), যা কীর্তিকর্মণের আমলে আংশিক অধিকারে এসেছিল মঙ্গলেশ তা সম্পূর্ণরূপে চালুক্যদের অধিকারে আনেন।

মঙ্গলেশের রাজত্বকালের শেষ দিক শান্তিতে কাটেনি। এই অশান্তির সৃষ্টি হয়েছিল প্রধানত মঙ্গলেশ ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশীর মধ্যে এক গৃহযুদ্ধের দরুন। এই গৃহযুদ্ধের উল্লেখ আছে ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে আইহোল প্রশস্তিতে। এতে বলা হয়েছে যে, মঙ্গলেশ কর্তৃক তাঁর পুত্রের জন্য সিংহাসনের উত্তরাধিকার সুরক্ষা করতে গিয়েই এই সংঘাত বেধেছিল। এই সংঘাতের ফলস্বরূপ দ্বিতীয় পুলকেশী কর্তৃক তার পিতৃক প্রাণ হারান এবং এরপর বাদামির সিংহাসনে বসেন দ্বিতীয় পুলকেশী। চালুক্য লেখসমূহে মঙ্গলেশকে ‘পরম-ভাগবত’ বা বিষ্ণুর উপাসক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *