বিধবা বিবাহ আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা । বিধবা বিবাহ আন্দোলনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান।
ভূমিকা :
উনিশ শতকের মধ্যভাগে ভারতীয় সংস্কারকরা বিধবাবিবাহ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়েছিল তবে খুব বেশি বিধবাবিবাহ এই আইন অনুসারে হয়নি। সমাজে রক্ষণশীল শক্তি এত প্রভাবশালী ছিল যে এই আন্দোলন আশানুরূপ সাফল্য লাভ করতে পারেনি। ভারতে নারী জাতির মধ্যে এই আন্দোলন প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, শিক্ষিতা মহিলারা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। ভারতের নারীমুক্তি আন্দোলনে বিধবাবিবাহ আন্দোলন একটি বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
বিধবা বিবাহ আন্দোলন :
সংস্কারকরা এই আন্দোলনের পরিপূরক হিসেবে নারীশিক্ষার বিস্তার, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিশুবিবাহ ও বহুবিবাহের উচ্ছেদ ইত্যাদি দাবি করেছিল। ভারতের সদ্যোজাত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এই দাবিগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। কালক্রমে বিধবাবিবাহ আন্দোলন বৃহত্তর নারীমুক্তি আন্দোলনে পরিণতি লাভ করেছিল। সামাজিক এই সংস্কার আন্দোলনের তাৎক্ষণিক সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল শুধু রক্ষণশীলদের বিরোধিতা নয়, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর সরকারি উদাসীনতা। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর সরকার নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করতে থাকে। বিধবাবিবাহ আইনটি বিদ্রোহীদের অসন্তোষের একটি কারণ ছিল, এরপর সরকার শিশুবিবাহ ও বহুবিবাহ নিরোধক আইনের ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। তবে ভারতীয় সংস্কারকরা এতে পিছু হটেননি। নারী জাতির মুক্তির আন্দোলন চলতে থাকে, প্রথম মহাযুদ্ধের সময় থেকে গান্ধিজি এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
সমাজসংস্কারের প্রচেষ্টা :
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের ওপর পশ্চিমি শিক্ষা, যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের গভীর প্রভাব পড়েছিল। পশ্চিমি শিক্ষার আলোকে আলোকিত ভারতীয়দের কাছে এদেশের সমাজের দুর্বলতাগুলি ধরা পড়েছিল। এরা মনে করেন সমাজের সংস্কার না হলে ভারত কখনও আধুনিক ও প্রগতিশীল হতে পারবে না। এদেশ চিরকাল অনগ্রসর রয়ে যাবে। যেসব ভারতীয় মনীষী সমাজসংস্কারের কথা ভেবেছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিষ্ণু শাস্ত্রী, জ্যোতিরাও ফুলে, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, ডি. কে. কার্ডে এবং বীরসালিঙ্গম পাঞ্চল। এদের মনে হয়েছিল ভারতের অনগ্রসরতার একটি কারণ হল নারী জাতির অশিক্ষা, দুরবস্থা এবং পুরুষশাসিত সমাজে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। কতকগুলি সামাজিক কুপ্রথা ছিল যেগুলি ভয়ংকরভাবে অমানবিক এবং প্রগতি বিরোধী। এমন একটি কুপ্রথা হল সহমরণ। রাজা রামমোহন রায়ের চেষ্টায় সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আইন পাশ করে এই সামাজিক কুপ্রথার অবসান ঘটিয়েছিলেন যদিও হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করেছিল।
উনিশ শতকের ভারতীয় সংস্কারকরা নারী জাতির অবস্থার উন্নতির দিকে নজর দেন। তারা মনে করেন নারী জাতির দুরবস্থা হল জাতির অধঃপতনের কারণ। এদেশে শিশুবিবাহ, বহুবিবাহ, কুলীন প্রথা, শিশুকন্যা হত্যা প্রভৃতি বহু কুপ্রথা ছিল। বিধবা নারীর পুনর্বিবাহের অধিকার ছিল না। ভারতীয় সংস্কারকরা নারী জাতির দুরবস্থার প্রতিকারকল্পে দ্বিমুখী অভিযান চালিয়েছিলেন। একটি হল নারী শিক্ষার বিস্তার, অপরটি হল সংস্কারের মাধ্যমে নারী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ছিল না। সমাজসংস্কারের কাজে তাঁরা শাস্ত্রের সাহায্য নেন, ঐতিহ্যবাহী সমাজের ঐতিহ্যকে তাঁরা আক্রমণ করেননি। রামমোহন মনুস্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সতীপ্রথার বিরোধিতা করেন, বিদ্যাসাগর পরাশর সংহিতার মধ্যে বিধবাবিবাহের সমর্থন পেয়েছিলেন।
সমর্থকগন :
ভারতে বিধবাবিবাহ আন্দোলন মোটেই নতুন নয়। আঠারো শতকে ঢাকার রাজা রাজবল্লভ তাঁর বিধবা শিশুকন্যার পুনর্বিবাহের জন্য পণ্ডিত ও শাস্ত্রকারদের মতামত চেয়েছিলেন। অনেকে তাকে সমর্থন করেছিলেন কিন্তু নদিয়ার পণ্ডিতদের বাধাদানের ফলে তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। জয়পুরের মহারাজা, কোটার শাসক, রামমোহনের আত্মীয়সভা, ইয়ং বেঙ্গলের সংগঠন, তত্ত্ববোধিনী সভা, কিশোরীচাঁদ মিত্রের সুহৃদ সভা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, জ্যোতিরাও ফুলের সত্যশোধক সমাজ এবং মহারাষ্ট্রের প্রার্থনাসমাজ বিধবাবিবাহকে সমর্থন করেছিল। তিরিশের দশকে সংবাদপত্র তত্ত্ববোধিনী, সংবাদ ভাস্কর ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকা বিধবাবিবাহ সমর্থন করে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। পশ্চিম ভারতে বিষ্ণুশাস্ত্রী, জ্যোতিরাও ফুলে এবং রানাডে বিধবাবিবাহের সমর্থনে জনমত গঠন করেন। এই উদ্দেশ্যে প্রচার পুস্তিকা জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তিরিশের দশকের শেষদিকে বোম্বে সরকার এসম্পর্কে সরকারি অফিসার ও পণ্ডিতদের মতামত নেন। মাদ্রাজে বীরসালিঙ্গম বিধবাবিবাহ জনপ্রিয় করার জন্য প্রচার চালিয়েছিলেন।
বিধবাবিবাহের চলন :
বিদ্যাসাগর নিজেই লিখেছেন যে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বিধবাবিবাহের প্রচলন। বাংলাদেশে বহু অর্থ ব্যয় করে এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি বিধবাবিবাহ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ইঞ্জ মিত্র রচিত বিদ্যাসাগরের জীবনীতে দেখা যায় তিনি ভারতীয়দের সম্বোধন করে লিখেছেন: ‘তোমাদের পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণ হত্যা পাপের স্রোতে উচ্ছলিত হইয়া যাইতেছে। সতীপ্রথা নিষিদ্ধ হবার পর ভারতে বিধবাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় অথচ তাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
বিধবাদের অর্থনৈতিক কোনো নিরাপত্তা ছিল না, ছিল না শিক্ষা বা মানবিক অধিকার। বিদ্যাসাগর এই দুরবস্থা থেকে নারীজাতিকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। পরাশর সংহিতা থেকে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে তিনি দেখালেন যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। ভারতের নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে বিধবাবিবাহের চলন ছিল। পরাশর স্মৃতির শ্লোকটি ব্যাখ্যা করে তিনি লেখেন ‘স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব স্থির হইলে, সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করিলে অথবা পতিত হইলে এই পাঁচ অবস্থায় নারীদের পুনর্বিবাহ শাস্ত্রসম্মত’। বৌধায়ন ও নারদ এই শ্লোকটির উল্লেখ করেছেন, পুরাণেও বিধবাবিবাহকে স্বীকার করা হয়েছে।
জনমত গঠন :
বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে জনমত গঠন করতে থাকেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ সম্পর্কিত দুখানি পুস্তিকা লিখে তিনি প্রচার করেন। মারাঠা ভাষায় এই পুস্তিকা দুখানির অনুবাদ করেন বিষ্ণুশাস্ত্রী। মহারাষ্ট্রে ‘উইডো ম্যারেজ অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করা হয়। বিদ্যাসাগর সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখে বিধবাবিবাহের পক্ষে জনমত গঠনের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। এসব পুস্তিকা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে রক্ষণশীল সমাজে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। অনেকে পালটা প্রবন্ধ লিখে বিদ্যাসাগরের মতের বিরোধিতা করেন। বিদ্যাসাগর তাঁর সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার জন্য সরকারের সাহায্য নেন।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে এক হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে একটি আবেদনপত্র পেশ করা হয়। বাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে এই আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করেন। বর্ধমান, ঢাকা, নবদ্বীপ ও ময়মনসিংহের জমিদাররা বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করে সরকারকে জানিয়েছিলেন। শুধু বাংলা থেকে নয়, বাংলার বাইরে পুনে, সেকেন্দ্রাবাদ, বোম্বে, সুরাট, আমেদাবাদ প্রভৃতি শহর থেকেও বিধবাবিবাহের পক্ষে প্রতিবেদন এসেছিল। রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে রক্ষণশীল গোষ্ঠী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। বিরোধিতা সত্ত্বেও কোম্পানির সরকার ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই পঞ্চদশ আইন পাশ করে বিধবাবিবাহকে আইনসংগত বলে ঘোষণা করেছিল।
উপসংহার :
বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে সফল করার জন্য বিদ্যাসাগর তাঁর সর্বস্ব পণ করেন। তিনি নিজে বহু বিধবার বিবাহের আয়োজন করেছিলেন এবং নিজপুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে এক বিধবার বিবাহ দেন। বিদ্যাসাগরের আন্তরিকতার অভাব ছিল না। বিধবাবিবাহ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বোম্বেতে প্রার্থনাসমাজ এবিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। মাদ্রাজে বিধবাবিবাহের জন্য সভা স্থাপন করা হয়। বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবাদের জন্য একটি তহবিল গঠন করেছিলেন। মহারাষ্ট্র ও মাদ্রাজে ‘উইডো হোম’ স্থাপন করেন ডি. কে. কার্ভে ও বীরসালিঙ্গম। বাংলায় শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় এরকম আশ্রম খুলেছিলেন। বাংলা ও ভারতের অন্যত্র ব্রাহ্মসমাজ বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। বাংলায় বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে ব্রাহ্মরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন।