StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাস


ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাস

ভারতীয় শিল্পকলা সম্পর্কে নানা গ্রন্থে যেমন আলোচনা রয়েছে তেমনি পৌরাণিক কাহিনীগুলিতেও নানা কাহিনীর উল্লেখ আছে। “চিত্রলক্ষণ’ নামে একটি সংস্কৃত গ্রন্থে বলা হয়েছে, ব্রহ্মার আদেশে নৃপতি ভয়জিৎ পৃথিবীতে প্রথম প্রতিকৃতি অঙ্কন করেন। এই কারণে তিনিই আদি চিত্রশিল্পীরূপে বিখ্যাত। ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর’ গ্রন্থে আবার বলা হয়েছে, আবার বলা হয়েছে বিষ্ণুর অবতাররূপী নরনারায়ণ মুনিই আদি চিত্রশিল্পী। আবার জৈন শাস্ত্রকার বলেন, সম্রাট ঋষভদেব বা প্রথম তীর্থঙ্কর আদিনাথ মানবসমাজে চিত্র, স্থাপত্য ও বয়নবিদ্যার প্রচার করেন এবং তিনিই নানাবিধ বল্যাবিদ্যার আদিগুরু।

হর্ষবর্ধন রচিত ‘নাগানন্দ’ নাটকে বলা হয়েছে, রাজবংশজাত জীমূতবাহন একজন দক্ষ প্রতিকৃতি অঙ্কনকারী ছিলেন। কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম’ নাটকে রাজা অগ্নিমিত্র কর্তৃক চিত্রগৃহে মালবিকার চিত্র দর্শন করে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কাহিনীর উল্লেখ আছে। “শকুন্তলা’ নাটকে রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলার যে চিত্র নিয়ে নিজ বিরহকাতর চিত্তকে সান্ত্বনা প্রদান করেন তার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন—তৈলাক্ত বর্ণে চিত্রখানি সুচিত্রিত হওয়ায় শকুন্তলার দেহের কমনীয়তা ও শ্রী বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। 

পৌরাণিক কাহিনীগুলি পর্যালোচনা করলে অবশ্য মনে হয়, একমাত্র ধর্মবোধ থেকেই চিত্রশিল্পের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বের শিল্পকথার ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে, একমাত্র ধর্মবোধ শিল্পসৃষ্টির উৎস হতে পারে না। পৌরাণিক যুগে চিত্রবিদ্যার অনুশীলন রাজপুত্র, রাজকন্যা বা বিশেষ অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ঐতিহাসিক লাউফার (Laufer) বলেন, ‘রাজদরবারেই প্রথম ভারতীয় চিত্রশিল্পের জন্ম হয়েছিল’। এতে ধর্মনায়কদের নির্দেশনা থাকলেও প্রভুত্ব ছিল না।

বৌদ্ধযুগের অগে মূলত দেওয়ালে নানা আকৃতির চিত্র অঙ্কন করার প্রথা ছিল—বৌদ্ধ-পূর্ব ব্রাহ্মণ্য রাজাদের যুগে কোনো খন্ডচিত্রের বিবরণ পাওয়া যায় না। বৌদ্ধযুগের সূচনায় ধর্মপ্রচারের জন্য ভিক্ষুদের সহজ বহণযোগ্য খন্ডচিত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এগুলিতে শুধু বৌদ্ধ জাতক কাহিনী নয়, বুদ্ধের জীবনের বহু মহৎ ঘটনাও চিত্রিত হত। খ্রিস্টীয় তৃতীয় বা চতুর্থ শতকের ‘বিনয়পিটক’ নামক পালিগ্রন্থে রাজা প্যাসেন্ডার (Pasenader) অনেকগুলি চিত্র সংগ্রহালয়ের উল্লেখ করেছেন। ঐ চিত্রশালাগুলিতে বিভিন্ন ভাবের ঘটনাচিত্র সংগৃহীত ছিল। তবে রামায়ণ বর্ণিত ঘটনাচিত্রই ছিল তখনও সর্বাধিক অঙ্কিত। আবার ভারতের বৌদ্ধধর্ম আক্ষরিক বাধা অতিক্রম করে চিত্রের বিশ্বজনীন ভাষার মাধ্যমে বহির্ভারতে প্রচারিত হয়েছিল।

ভারতীয় শিল্পগ্রন্থগুলি মূলত হিন্দু-বৌদ্ধযুগের পরবর্তীকালে রচিত হলেও কর্মপদ্ধতির ধারা, পূর্বে যা মৌখিক উপদেশের মধ্যে নিবদ্ধ ছিল, সেগুলিই পরবর্তীযুগে পুঁথি-মধ্যে সংকলিত হয়েছিল। সুদুর অতীতে উত্তর ভারতীয় ঋগ্বেদের ঋযি অগস্ত্যের বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম ও বিজয় বৈদিক সভ্যতারই বিজয় কাহিনী। প্রচার কাজের জন্য এই ঋষিপ্রবর দক্ষিণ ভারতের বহুস্থানে স্থায়ী ও অস্থায়ী আশ্রম নির্মাণ করে তাঁর অনুগামীদের উপর এগুলির পরিচালনার ভার ন্যস্ত করেন। দ্রাবিড় ভাষা সংস্কারের পর তিনি শৈব ধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে শৈব মন্দির নির্মাণ করেন। এহেন বহু প্রতিভাসম্পন্ন ঋষি অগস্ত্যের একটি মহান কীর্তি—শিল্পশাস্ত্রের পুনরুদ্ধার, সংকলন ও প্রণয়ন। আর্যাবর্তের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হলেও দক্ষিণ ভারতের শিল্পকলার নিদর্শনসমূহ আজও অক্ষত আছে, যা আর্যাবর্তের চিত্রকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কার্যেরই উত্তরাধিকার।

শিল্পবিদ্যার অন্তর্গত ভাস্কর্য ও চিত্র—এই দুটি শাখার যেসব শাস্ত্রগ্রন্থ আছে তার মধ্যে স্থাপত্যবিদ্যার বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে ‘মানসার’, ‘ময়মত’ ও ‘শিল্পরত্ন” বিশেষ উল্লেখযোগ্য। চিত্রবিদ্যা সম্পর্কে অত্রি ঋষিকৃত “চিত্রাণব’ছাড়াও ‘মূলস্তম্ভ নির্ণয়’ ‘সারস্বতীয়ম্’ এবং ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর’ বিশেষ প্রামাণ্য গ্রন্থ। আজও দক্ষিণ ভারতের শিল্পীরা এগুলিকে ‘বেদ’ বলেন এবং বেদচর্চাকারী শিল্পীরা নিজেদের ‘দ্বিজ’ বলে থাকেন। 

“বিষ্ণুধর্মোত্তর’, ‘চিত্রসূত্র’, ‘অভিলাষিতার্থ চিন্তামনি’, ‘শিবতত্ত্বরত্নাকর’, ‘নারদ-শিল্প’, ‘শিল্পরত্ন’, ‘সরস্বতী-শিল্প’, ‘প্রজাপতি-শিল্প’ প্রভৃতি গ্রন্থ ব্যতীত বহু সংস্কৃত গ্রন্থেও শিল্পীদের প্রতি বহু উপদেশ ও নির্দেশ পাওয়া যায়। ভাস্কর্যবিদ্যার জন্য রচিত সংস্কৃত গ্রন্থাদি এখনও দক্ষিণ ভারতে পাওয়া যায়। ‘বৃহৎসংহিতা’ ও ‘সুপ্রভেদাগম্ গ্রন্থ দুটি ভাস্কর্যবিদ্যার বিশেষ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এগুলিতে যেসব নিয়ম বর্ণিত রয়েছে সেসব নিয়ম শুধু মন্দিরে স্থাপিত বিগ্রহের জন্য প্রযুক্ত হবে বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। লক্ষ্যণীয়, বিগ্রহ ব্যতীত অন্য মূর্তি নির্মাণের সময় ভাস্করকে অনুশাসনে আবদ্ধ করা হয়নি।

রাজা তিরুমলের সভাপন্ডিত রচিত ‘শিবলীনার্ণব’ গ্রন্থ-বর্ণিত শিবলীলার ভাস্কর্যাবলীর মধ্যে ভাস্করবৃন্দ যে অপূর্ব শিল্পমহিমা রেখে গেছেন তাতে দক্ষিণ ভারতের ভাস্কররা শুধু দ্বিজত্ব নয়, দেবত্ব লাভ করেছেন। ‘চিত্রসূত্র’ গ্রন্থটি সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পগ্রন্থ। ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর’  গ্রন্থের সঙ্গে এটিও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করা হয়। যদিও দু’খানি গ্রন্থে একই ধরনের বিষয় আলোচিত হয়েছে। দামোদর গুপ্ত তাঁর ‘কুট্টনীমত্তম্’ গ্রন্থে লিখেছেন, উভয় গ্রন্থ একই ব্যক্তির রচনা। ঐতিহাসিকরা গ্রন্থটিকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর রচনা বলে মনে করেন। ‘কুট্টনীমত্তম্’ গ্রন্থটিও চিত্রসমালোচক, শিল্পী ও কলারসিকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এছাড়াও অন্যান্য শিল্পশাস্ত্র গ্রন্থগুলি হল—শুক্রাচার্যের ‘শুক্রনীতিসার’, ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র’, মন্দিকেশ্বরের ‘অভিনয় দর্পন’, ধনঞ্জয়ের ‘দশরূপ’, ‘সাধনমালা’ ইত্যাদি গ্রন্থ।

 অন্যান্য শিল্পশাস্ত্র সমূহ

‘কামসূত্র’ ব্যতীত ভারতীয় শিল্পকলার জন্য আরো বহু শাস্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে ‘চিত্রলক্ষণ’ নামে একটি প্রাচীন গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে চিত্রকর্মকে শুধু ধর্ম অনুষ্ঠানে প্রয়োগ করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং শিল্পীকে খেয়ালখুশি মতো চিত্র রচনা না করার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। এই গ্রন্থটির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গুপ্তযুগে ‘শিল্পশাস্ত্র’ নামক আরেকটি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে ভারতীয় প্রাচীন চিত্রের কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। নিচে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিত্র শিল্পশাস্ত্রের উল্লেখ করা হল।

বিষ্ণুধর্মোত্তর 

‘বিষ্ণুধর্মোত্তর’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু নৃত্য, গীত, ছন্দ, ব্যাকরণ, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্র। সঙ্গীত, নৃত্য ও চিত্রকলার সম্পর্ক এতে আলোচিত হয়েছে। এই গ্রন্থে চিত্রসূত্র, চিত্রের বিন্যাস, চিত্ররচনার যন্ত্রপাতি ও উপকরণ, চিত্রের অপকর্ষ-উৎকর্ষ বিষয়ক আলোচনা রয়েছে। গ্রন্থটির রচয়িতা পুরুষকে—হংস, ভদ্র, মালভ্য, রুচীক, শশক—এই পাঁচটি ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন এবং নারীকে কেশদামের আকৃতি ও প্রকৃতি অনুযায়ী পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছেন—১। কুন্তল—দীর্ঘ ও সূক্ষ্মবেশী রমণী; ২। দক্ষিণাবত—ডানদিকে কুঞ্চিত কেশবিশিষ্টা; ৩। তরঙ্গ—বামদিকে কুঞ্চিত কেশবিশিষ্টা বা তরঙ্গায়িত কেশযুক্তা রমণী; ৪। বারিধারা—প্রচুর ও সরল কেশযুক্তা নারী; ৫। যুততাসারা—কুঞ্চিত প্রচুর কেশযুক্তা রমণী। চোখের বর্ণনার ক্ষেত্রেও পাঁচটি ভাগ করা হয়েছে—১। চপকরীতি—ধনুক সদৃশ: ২। উৎপলা পত্রভা—নীলবর্ণ পদ্মের আভাযুক্ত; ৩। মৎস্যদারা—মৎসের আকৃতিযুক্ত; ৪। পদ্মপত্রনিভ—পদ্মের পাপড়ি সদৃশ; ৫। সনকরীতি—গোলাকার চক্ষুবিশিষ্ট।

“বিষ্ণুধর্মোত্তর’গ্রন্থে শাস্ত্রকার দেবতাদের ভঙ্গ (‘স্থানস’) সম্পর্কে নয় প্রকার ভঙ্গের উল্লেখ করেছেন—বিশ্বগতা, আনঋজু, সচীকথা, সাম্য, অধবিলোচন, পার্শ্বগতা, পরাভবিতা, পৃষ্ঠাগতা এবং সমানতা। অন্যান্য শিল্পগ্রন্থে একে অন্যের অনুপূরক বা সমর্থকরূপে ভঙ্গ বা স্থানসের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে মাত্র; মূল বক্তব্যের সাথে কোনো পার্থক্য নেই।

ইউরোপীয় পরিপ্রেক্ষিতের অন্তর্গত ‘ফোবশটনিং’-কে ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর’ গ্রন্থে বলা হয়েছে ‘ক্ষয়বুদ্ধি’। এসম্বন্ধে প্রত্যক্ষ বা ফটোগ্রাফিক চিত্র পদ্ধতির আলোচনা করা হয়েছে। ‘ফ্রেস্কো’ চিত্রের অঙ্কন পদ্ধতির আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–কোড়া প্রাচীরকে প্রথম সংস্কার করে তারপর চিত্রকর্ম আরম্ভ করতে হবে। এই সংস্কারকার্যকে বলা হয়েছে ভিত্তিসংস্কারা”। বলা হয়েছে, ভিত প্রস্তুতির পর প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচর্যায়ে চিত্র সমাপ্ত করতে হয়। রঙ প্রস্তুতের প্রণালী ও রঙ প্রয়োগের পদ্ধতিও ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর’ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। 

‘বিষ্ণুধর্মোত্তর’ গ্রন্থের রচয়িতা চিত্রকে চারভাগে বিভক্ত করেছেন—১। সত্য চিত্র (ফটোগ্রাফিক বা প্রকৃতির অনুরূপ); ২। ভৈনিক চিত্র (ছান্দিক); ৩। নাগর (সরল কিন্তু স্বাভাবিক নয়); ৪। মিশ্র (বিবিধ রীতিযুক্ত চিত্র)। গ্রন্থটিতে তিনটি অধ্যায়ে ‘ভন’ বা ছায়াপাত (Shading) সম্পর্কে আলোচনায় তিন শ্রেণির ‘Shading’-র কথা রয়েছে–১। পাতরাজ—শুধু রেখার উপর রেখা সাজিয়ে ছায়াপাত করা; ২। রৈখিক–ক্রস লাইন দ্বারা ছায়া উৎপন্ন করা এবং ৩। বিন্দুজ—স্টিপিলিং বা বহুবিন্দু বর্ণ স্থাপন দ্বারা ছায়া উৎপন্ন করা। গ্রন্থটিতে চিত্র সমালোচনার রীতিও বর্ণিত হয়েছে। সবশেষে বর্ণিত হয়েছে চিত্রের দার্শনিক গতিপ্রকৃতি, বিভিন্ন যোগ্যতা, ভাব ও রহস্য। এগুলি সম্পর্কিত ব্যাখ্যাকে = চিত্রের অলঙ্কার রূপে অভিহিত করা হয়।

সমরঙ্গন সূত্রধর

রাজা ভোজ রচিত একটি উল্লেখযোগ্য শিল্পগ্রন্থ ‘সমরঙ্গন সূত্রধর। গ্রন্থটিতে মূলত স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হলেও শেষদিকে চিত্রশিল্প সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। তবে এর প্রতিপাদ্য বিষয় ভাবরহস্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

অভিলাষিতার্থ চিন্তামণি

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে চালুক্য বংশের রাজা সোমেশ্বর এই গ্রন্থখানি রচনা করেন। গ্রন্থটিতে চিত্রকলা সম্পর্কে মনোজ্ঞ আলোচনা থাকলেও মূলত নাট্যমঞ্চের প্রাচীর (সীন) নির্মাণ ও এর সাজসজ্জার উপর অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

‘অভিলাষিতাৰ্থ চিন্তামণি’ গ্রন্থে বর্ণ-মিশ্রণ এবং মূল বর্ণ থেকে বিভাজিত বর্ণ প্রস্তুত পদ্ধতি ও তার বর্ণনা রয়েছে। নানাধরনের তুলি  ও কলম নির্মাণ পদ্ধতি এবং এগুলির প্রয়োগ সম্পর্কেও গ্রন্থটিতে আলোচনা করা হয়েছে। হালকা রঙের পাশে ঘন রঙ প্রয়োগে বা ছায়াসম্পাতের দ্বারা বস্তুর স্থূলত্ব সৃষ্টি করা, বর্ণের ঐক্যতান, বর্ণবিন্যাস এবং তুলি চালনার নানাবিধ কৌশল গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে।

‘চিত্তামনি’ গ্রন্থে নৃত্যে, অভিনয়ে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভঙ্গগুলি কীভাবে শরীর-সংস্থাপনা দ্বারা উৎপন্ন করা যায়—সেসম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। এই ভঙ্গগুলি ভাস্করদের মূর্তি নির্মাণের সময় সাহায্য করেছিল। গ্রন্থটিতে চিত্র রচনার জন্য দুটি নতুন উপাদানের উল্লেখ পাওয়া যায়। গুড়ো রঙ দ্বারা চিত্রিত অঙ্কন পদ্ধতিকে বলা হয়েছে ‘ধূলিচিত্র’ এবং তরল রঙ দ্বারা চিত্রিত অঙ্কন পদ্ধতিকে বলা হয়েছে ‘রসচিত্র’। সোমেশ্বর চিত্রকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন-১। ভাবচিত্র (Mood)-চিত্রের দার্শনিক দিক ও ভাব প্রধান, ২। বিদ্যাচিত্র—প্রতিকৃতি (Potrait) এবং ৩) অবিদ্যাচিত্র-নকশা বা আলঙ্করিক চিত্র। তবে মনে রাখতে হবে, মূলত রঙ্গালয় সংক্রান্ত চিত্রকর্মের উপর ভিত্তি করে এই গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল।

শিবেশ্বরাতঙ্কারা

খ্রিস্টীয় সতেরো শতকে বেদনূরের বাসপ্ননায়ক এই গ্রন্থটি রচনা করেন। এই গ্রন্থটি ‘অভিলাষিতাৰ্থ চিন্তামনি’ গ্রন্থটির অনুরূপ শিল্পগ্রন্থ। 

 শিল্পরত্ন

খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে শ্রীকুমার নামক পণ্ডিত এই গ্রন্থখানি রচনা করেন। তিনি শিল্পকর্মকে দু’ভাগে বিভক্ত করেন—১। চিত্র ও ২। ভাস্কর্য। ভাস্কর্যকে আবার তিনি দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থকার বিষয়টিকে তিনভাগে বিভক্ত করেন – ১। চিত্র (আলেখ্য), ২। অর্থচিত্র (রঙীন বা সাধারণ খোদাই করা ফলক চিত্র অর্থাৎ‍ উৎকীর্ণ চিত্র) এবং ৩। চিত্রভাস (ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য)। গ্রন্থকার সাদা, কালো, লাল, নীল ও হলুদ—এই পাঁচটি বর্ণকে মূল বর্ণ বলে গ্রহণ করেছেন। তিনি লিখেছেন; এই বর্ণগুলির সংমিশ্রণে বহু সংকর বর্ণের উদ্ভব হয়। গ্রন্থটিতে নানা ধরনের তুলির স্থূলত্ব উৎপন্ন (ভর্তিকা) বিবরণ প্রদান করা হয়েছে।

পন্ডিত শ্রীকুমার আলো-ছায়। প্রয়োগ করার কৌশল, স্বর্ণ সংযুক্ত করা এবং চিত্রে বার্ণিশ প্রয়োগ করে চিত্রের ঔজ্জ্বল্য সম্পাদন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। গ্রন্থটিতে একটি অধ্যায়ে মূর্তির ‘ভঙ্গ’ (Pose) বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। ‘শিল্পরত্ন’ গ্রন্থে ধূলিচিত্র ও রসচিত্র সম্পর্কে যে আলোচনা রয়েছে তাতে রসচিত্র–‘টেম্পারা’ (ঘন জলরঙ)–কেই নির্দেশ করে; ভাবকে নয়। প্রসঙ্গত ‘অভিলাষিতাৰ্থ চিন্তামনি’ গ্রন্থে ‘রসচিত্র’ বলতে কোনো কোনো স্থানে ‘ভাব’অর্থও প্রযুক্ত হয়েছিল।

সরস্বতী শিল্প

এই গ্রন্থটিতেও চিত্র, উৎকীর্ণ চিত্র ও নিরেট ভাস্কর্য সম্পর্কে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। গ্রন্থকার চিত্রকে তিনভাগে ভাগ করেছেন—চিত্র, অর্ধচিত্র ও চিত্রভাস (‘শিল্পরত্ন’ গ্রন্থের অনুরূপ)। গ্রন্থটিতে বর্ণ (রঙ) প্রস্তুত করাকে বলা হয়েছে ‘বর্ণ সংস্কার’। গ্রন্থটিতে এর পর দেবমূর্তিসমূহের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে এবং সবশেষে পটচিত্র সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। 

প্রজাপতি শিল্পমূল গ্রন্থখানি বর্তমানে পাওয়া না গেলেও অন্যান্য শিল্পগ্রন্থে এই গ্রন্থটির উল্লেখ পাওয়া যায়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *