ভারতে চরমপন্থার উৎপত্তি ও বৃদ্ধি আলোচনা কর। কেন এটি ব্যর্থ হয়েছে? । চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ।
ভারতে চরমপন্থার উৎপত্তি ও বৃদ্ধি / চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ
কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিকরা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মধ্যে চরমপন্থার উৎস অনুসন্ধান করেছেন। জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে এরা আদর্শ খুঁজে পাননি। এদের মতে, কংগ্রেস রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে ছিল দল ও উপদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াই। নরমপন্থার বিরুদ্ধে আদর্শগত দ্বন্দ্বকে তাঁরা গুরুত্ব দেননি। জুডিথ ব্রাউন অবশ্য আঞ্চলিক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সঙ্গে আদর্শগত বিরোধকে যুক্ত করেছেন। তবে তিনিও মনে করেন আঞ্চলিক গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিত্বের সংঘাতকে পরিমার্জিত রূপ দেবার জন্য আদর্শগত বিরোধকে ব্যবহার করা হয়েছিল।
অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী মনে করেন চরমপন্থা ছিল ভারতীয় রাজনীতি ও চিন্তার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য প্রভাব ও অনুকরণের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। তিনি জোর দিয়েছেন আদর্শ ও তাত্ত্বিক অবস্থানের ওপর। তিনি দেখিয়েছেন ভারতীয় জীবনে পাশ্চাত্য চিন্তা ও আদর্শের অনুপ্রবেশ রুখতে চরমপন্থী নেতারা প্রাচীন ভারতের শাশ্বত হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিপান চন্দ্র ও ম্যাকনিলের মতো ঐতিহাসিকরা মনে করেন নরমপন্থী আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে চরমপন্থী আন্দোলনের উদ্ভব হয়। নরমপন্থী নেতারা দেশের বাস্তব পরিস্থিতির খবর রাখতেন না। কংগ্রেসের বাইরে জনগণের মধ্যে ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। নরমপন্থী নেতারা সে সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। এই ধরনের পরিস্থিতি চরমপন্থার বিকাশ ঘটাতে সহায়ক হয়েছিল।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ ও স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী চরমপন্থী মতবাদের তাত্ত্বিক পটভূমি, চিন্তাধারা ও মতাদর্শ গঠন করে দেন। অধ্যাপক হাস কন (Hans Kohn) জানিয়েছেন যে উদীয়মান জাতীয়তাবাদ কোনো প্রচলিত জাতীয়তাবাদের সংস্পর্শে এলে প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে সে তার প্রেরণা খুঁজে পায়। ভারতের চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ করা যায় । প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও হিন্দুধর্মের মহিমা সম্পর্কে রামমোহন থেকে অরবিন্দ সকলেই সচেতন ছিলেন। উপনিষদ ও বেদের মধ্যে তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন ভারতের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। এক্ষেত্রে রেনেশাঁসের মানবতাবাদীদের সঙ্গে তাঁদের মিল লক্ষ করা যায়। প্রাচীন উৎসমুখ থেকে মৃত সঞ্জীবনী আহরণ করে ব্যক্তি ও সমাজকে তাঁরা উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র জন স্টুয়ার্ট মিল, কোত ও বেহামের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর চিন্তার উৎস হল মহাভারত, গীতা ও ভাগবতের শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব। ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ এবং সেই বিকশিত ব্যক্তিত্বকে মানবহিতে উৎসর্গ করা হল হিন্দুধর্মের সারতত্ত্ব। বঙ্কিমচন্দ্র এর নাম দেন অনুশীলন ধর্ম। আনন্দমঠে তিনি দেশকে দেবী দুর্গার সঙ্গে একাত্ম করে দেখিয়েছিলেন। দেশসেবা হল মাতৃবন্দনার মতো প্রধান ধর্ম, আত্মত্যাগ মহান আদর্শ। তিনি দেশবাসীকে সারমেয়ের রাজনীতি ত্যাগ করে সিংহের রাজনীতির অনুসরণ করার পরামর্শ দেন। কৃষ্ণচরিত্রে তিনি ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তাঁর এই দুঃসাহসী পরিকল্পনা চরপন্থীদের অবশ্যই প্রভাবিত করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ ছিল বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস, তাঁর বন্দেমাতরম্ হল স্বাধীনতা আন্দোলনের মহামন্ত্র। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের ধ্যানধারণা অরবিন্দের ভবানী মন্দিরে’ সুস্পষ্টরূপ লাভ করে।
রামকৃষ্ণদেবের প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। রামকৃষ্ণ কখনও বিপ্লব প্রচার করেননি, তবুও ভারতীয় রাষ্ট্রনেতাদের অনেকে তাঁর মধ্যে ভারতীয় সভ্যতার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছিলেন। রামকৃষ্ণ প্রচারিত ধর্ম উদার ও মানবিক, তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন ছিল না, সব ধর্মমতকে তিনি সত্য বলে প্রচার করেন। বিবেকানন্দ ভারতের মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, পশ্চিমকে তিনি দেন অদ্বৈত ও যোগতত্ত্ব, ভারতীয়দের পশ্চিমের কর্মোদ্যোগ, বীর্য, প্রযুক্তি ও শৃঙ্খলা। ভারতীয়দের তিনি আরও দিয়েছিলেন প্রবল পৌরুষ, অদ্বৈতের অভীমন্ত্র। ভারতীয় যুবকদের তিনি শিখিয়েছিলেন আমরা মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত ।
বঙ্কিমচন্দ্রের দেশমাতা ছিলেন কবির কল্পনা, বিবেকানন্দ তাকে দেন রক্ত, মাংস ও মজ্জা। ভারতের নব জাতীয়তাবাদের জাগরণে অরবিন্দ বিবেকানন্দের অবদান স্বীকার করেছেন। ভারতীয় যুবসমাজকে বিবেকানন্দ দেন আত্মশক্তি, আত্মনির্ভরশীলতা, ত্যাগ ও সেবার আদর্শ। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী দেখিয়েছেন চরমপন্থীরা বিবেকানন্দ ও বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তার অপব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁরা মানুষ তৈরি করা ধর্মের চেয়ে স্বরাজের ওপর বেশি জোর দেন। বিবেকানন্দ ও বঙ্কিমচন্দ্র মনে করেন খাঁটি মানুষ তৈরি হলে স্বরাজ আসতে দেরি হবে না।
চরমপন্থীরা ইংরেজদের জাত্যভিমানের পেছনে দেখেছিলেন টিউটনিক জাতিকূলের শ্রেয়ম্মন্যতার আদর্শ। আর্য শ্রেয়ম্মন্যতা জাহির করে চরমপন্থীরা এর জবাব দেন। এক্ষেত্রে তাঁদের গুরু ছিলেন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী। দয়ানন্দের কাছে বেদ হল ঈশ্বরের বাণী, তার মধ্যে শুধু আধ্যাত্মিক জীবন নয়, জড় জীবনের সব কথা আছে। দয়ানন্দ পাশ্চাত্য ভাবধারার বিরোধী ছিলেন। তাঁর আর্যসমাজ আন্দোলন উত্তর ভারতের সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর চিন্তাভাবনার প্রভাব পড়েছিল চরমপন্থীদের ওপর। তাঁর শুদ্ধি আন্দোলন এবং গোরক্ষিণী সভা সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ তৈরি করলেও তাঁর ধর্ম ও সমাজসংস্কারের কর্মসূচি চরমপন্থীদের আকৃষ্ট করেছিল। এসব নতুন ভাবাবহ ও চিন্তাধারা চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের উদ্ভদের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল।
প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির গৌরব প্রচার, দেশপ্রেম, ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ সম্পর্কে চেতনার বিস্তার চরমপন্থার বিকাশের সহায়ক হয়। চরমপন্থার বিকাশের আদর্শগত দিক ছাড়াও এর একটি অর্থনৈতিক দিক ছিল। দাদাভাই নৌরোজি, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, জি. ভি. জোশী, কে. টি. তেলাং, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, মদনমোহন মালব্য ও অন্যান্যরা তাঁদের রচনা ও বক্তৃতার মাধ্যমে এই পটভূমি তৈরি করে দেন। তাঁদের লেখা ও বক্তৃতায় ব্রিটিশ শাসনের শোষণমূলক দিকটি তাঁরা তুলে ধরেন। তাঁদের লেখা থেকে এদেশের জনগণ বুঝতে পারেন সীমাহীন দারিদ্র্যের কথা। উনিশ শতকের শেষদিকে এদেশে ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ হত, এসব দুর্ভিক্ষে মারা যেত লক্ষ লক্ষ মানুষ।
জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদরা প্রচার করেন যে ভারতীয় সম্পদের বহির্গমন, ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব, শিল্পবাণিজ্য ও শুল্কনীতি ভারতীয়দের দুর্গতির কারণ। চরমপন্থী নেতারা কোনো নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্ব খাড়া করেননি, তাঁরা নরমপন্থীদের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনাকে জনমত গঠনের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। উনিশ শতকের শেষদিকে পশ্চিম ভারতের প্লেগ মহামারি ব্রিটিশ শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছিল। তিলক তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে জনগণ ব্রিটিশ প্লেগ অফিসারদের অত্যাচারের চেয়ে প্লেগে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করত। বলা হয় এই প্লেগের সময় থেকে চরমপন্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল। উনিশ শতকের শেষ দিককার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, প্লেগ মহামারি ও দুর্ভিক্ষ, শিক্ষিত ভারতীয়দের বেকারত্ব ও হতাশা চরমপন্থার ভিতকে শক্তিশালী করেছিল।
নরমপন্থী নেতাদের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা, তাদের ব্রিটিশ প্রীতি, পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি মিথ্যা মোহ, তাদের আন্দোলন পদ্ধতি, আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি নিঃসন্দেহে চরমপন্থার উদ্ভদের জন্য দায়ী ছিল। সেইসঙ্গে ভারতের বাইরের কিছু ঘটনা ভারতবাসীকে চরমপন্থী মনোভাব নিতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। জাপানের বিস্ময়কর অভ্যুত্থান ও অগ্রগতি ভারতবাসীর চোখ খুলে দিয়েছিল, তাদের মনে আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়ার হাতে ইতালির পরাজয় এবং ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের হাতে রাশিয়ার পরাজয় প্রমাণ করেছিল আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলি পিছিয়ে নেই। শ্বেতকায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা অলীক বলে।
প্রমাণিত হয়, ইউরোপীয়দের অজেয় ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছিল। তাছাড়া আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, চিন, তুরস্ক, মিশর প্রভৃতি দেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রাম ভারতীয়দের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
১৮৯০ দশকে ভারতে চরমপন্থার সূচনা হয়। ১৮৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে অরবিন্দ ইন্দুপ্রকাশ পত্রিকায় ‘New Lamps for Old’ শিরোনামে যে প্রবন্ধগুলি লেখেন তাতে জাতীয় কংগ্রেস, তার কর্মসূচি ও চরিত্রকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। তাঁর মতে, কংগ্রেস কখনও জাতীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না, এর সঙ্গে সাধারণ ভারতবাসীর কোনো যোগ ছিল না। অরবিন্দ রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি ত্যাগ করে বলিষ্ঠ গণ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে বালগঙ্গাধর তিলক, লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত ও অন্যান্যরা এই মতবাদ সমর্থন করেন। কার্জনের শাসননীতি নরমপন্থার ব্যর্থতা তুলে ধরে চরমপন্থী মতবাদকে শক্তি জুগিয়েছিল।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে চরমপন্থা জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। চরমপন্থীরা জোর দেন বয়কট, স্বদেশি, জাতীয় শিক্ষা ও স্বরাজের ওপর। এই চারটি বিষয় নিয়ে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে নরম ও চরমপন্থীদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। ১৯০৭ ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চরমপন্থীরা স্বাতন্ত্র্য্য বজায় রেখে চলেছিল, ফিরোজশাহ মেহতার নেতৃত্বে নরমপন্থীরা ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে বার্ষিক অধিবেশনে মিলিত হয়েছিল। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনে গান্ধিজি ও তিলকের নেতৃত্বে এই দুই গোষ্ঠী আবার মিলিত হয়।
আদি পর্বের নরমপন্থী কংগ্রেস নেতারা ছিলেন পশ্চিমি শিক্ষা ও ভাবধারায় পুষ্ট। এরা মনে করেন পশ্চিমি শিক্ষা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান ভারতের আধুনিকীকরণের জন্য প্রয়োজন। চরমপন্থী নেতারা পশ্চিমি শিক্ষায় সুশিক্ষিত হলেও মনে করেন এদেশের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে জাতীয় শিক্ষা ও জাতীয় পুনর্গঠন করতে হবে। নরমপন্থীরা মনে করেন এদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হল ঈশ্বরের অভিপ্রায়, ব্রিটিশ শাসন এদেশের অনেক মঙ্গলসাধন করেছে। চরমপন্থীরা মনে করেন ব্রিটিশ শক্তি শঠতা ও অসাধুতার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ জয় করেছে, ব্রিটিশ শাসনে এদেশের মানুষ শোষিত ও নির্যাতিত হয়েছে। নরমপন্থী জাতীয়তাবাদীরা মনে করেন ব্রিটিশ জাতি যুক্তিবাদী ও ন্যায়পরায়ণ।
ব্রিটিশ জাতি ও পার্লামেন্টকে ভারতের দুর্দশার কথা জানানো হলে তারা ভারতের সমস্ত ন্যায্য দাবি মেনে নেবে। চরমপন্থীরা মনে করেন ব্রিটিশ জাতি প্রকৃতই সাম্রাজ্যবাদী, ভারতকে শোষণের উদ্দেশ্য নিয়ে তা স্থাপিত হয়েছে। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতকে সাব নিজ অধিকার আদায় করে নিতে হবে। ব্রিটিশ জাতি স্বেচ্ছায় ভারতকে কিছু দেবে না, এজন্য দরকার হবে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস, সাহস ও আত্মত্যাগ। নরমপন্থীরা ধরে নিয়েছিলেন ভারতের অশিক্ষিত জনগণ জাতীয় আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত নন। ব্রিটিশ সরকার, পার্লামেন্ট ও উচ্চ রাজপুরুষদের কাছে আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে ভারতীয়দের ন্যায্য দাবিগুলি আদায় করা যেতে পারে।
চরমপন্থীরা কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্তের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ ও গণ-আন্দোলনে আস্থা রেখেছিলেন, অসহযোগ, বয়কট ও স্বদেশি হবে আন্দোলনের পদ্ধতি। প্রয়োজন হলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নরমপন্থী নেতাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শাসনতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের ব্যবস্থা করা। আদি পর্বের একেবারে শেষদিকে দাদাভাই নৌরোজি ও গোপালকৃষ্ণ গোখলে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলেন। অপরদিকে চরমপন্থী নেতা বালগঙ্গাধর তিলক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন ‘স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার, আমাকে তা অর্জন করতে হবে’।
চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের চার প্রধান প্রবক্তা লোকমান্য তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায় ও অরবিন্দ ঘোষ আন্দোলনের লক্ষ্য ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এদের কাছে জাতীয় আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হল স্বরাজ অর্জন। স্বরাজ বলতে তাঁরা বুঝেছিলেন স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, সমাজ ও ধর্মের প্রকৃত স্বাভাবিক বিকাশের জন্য স্বরাজের প্রয়োজন। এঁরা স্বরাজের যে ব্যাখ্যা দেন তা সর্বার্থে ছিল স্বাধীনতা। এঁরা চেয়েছিলেন ভারতের সমস্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটাতে। চরমপন্থীদের কর্মসূচিতে চারটি প্রধান বিষয় হল বয়কট বা ব্রিটিশ পণ্য বর্জন, স্বদেশি পণ্যের প্রচার ও ব্যবহার, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গঠন এবং নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে সব বিষয়ে অসহযোগিতা করা।
ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করে তাঁরা ব্রিটিশ শাসনকে অচল করে তুলতে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বয়কটের ব্যবহার পৃথিবীর অন্যত্র আগেই হয়েছিল। চরমপন্থীরা স্বদেশি শিল্প স্থাপন করে এদেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। বিদেশি শাসক এদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল চরমপন্থীদের তা পছন্দ ছিল না, তাঁরা এর বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বাংলার কাউন্সিল অব ন্যাশনাল এডুকেশন, মাদ্রাজ ন্যাশনাল কলেজ এবং পাঞ্জাব কলেজ স্থাপন করে তাঁরা এব্যাপারে এগিয়েছিলেন। চরমপন্থীরা মনে করেন ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল এদেশে মানুষের সহযোগিতার ওপর। সারা ভারতের সর্বশ্রেণির মানুষ যদি ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা না করে তাহলে এই শাসন অচল হয়ে পড়বে। চরমপন্থীরা ব্রিটিশ শাসনের বিকল্প গঠনের কথাও ভেবেছিলেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, সালিশি বিচার, দুর্গত ত্রাণ ইত্যাদি কাজের জন্য তাঁরা সংগঠন গড়ার দিকে নজর দেন।
লোকমান্য তিলক চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চারটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রথম বৈশিষ্ট্য হল ভারতের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর অবিচল আস্থা, এর ওপর ভিত্তি করে নতুন ভারত গঠনের প্রয়াস। দ্বিতীয়টি হল ভিক্ষার রাজনীতি ত্যাগ করে আবেদন-নিবেদন ছেড়ে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন । আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বশাসনের অধিকার অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ। গত বিশ বছর ধরে জাতীয় কংগ্রেস শুধু প্রশাসনিক সংস্কারের দাবি করেছিল। চরমপন্থী আন্দোলনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল তাঁরা স্বরাজ সাধনাকে জাতীয় আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। স্বরাজের অর্থ বৃহত্তর ব্যঞ্জনা লাভ করেছিল। এর অর্থ হল স্বায়ত্তশাসন ও পরাধীনতা থেকে মুক্তি। এর চতুর্থ লক্ষ্য হল জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার ঘটিয়ে গণ-আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা।
ব্যর্থতার কারণ
প্রায় দু’দশক ধরে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (১৮৯৪-১৯১৬) জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চ অধিকার করেছিল। চরমপন্থীরা ভারতের দৃষ্টি পশ্চিমি শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির দিকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। চরমপন্থী আদর্শ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংস্কারধর্মী শৌখিন রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে জনগণকে প্রতিবাদী আন্দোলনমুখী করে তুলেছিল। ভারতের রাজনীতিতে শুরু হয়েছিল গণ-আন্দোলন, নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ, বয়কট, স্বদেশি, জাতীয় শিক্ষা ও সশস্ত্র সংগ্রামের যুগ। গান্ধিজি চরমপন্থীদের কাছ থেকে অসহযোগ ও আইন অমান্যের মতো সংগ্রাম পদ্ধতি পেয়েছিলেন। চরমপন্থী আন্দোলন থেকে বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রামের আদর্শ অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল।
চরমপন্থীদের মধ্যে উগ্র বামপন্থীরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন উৎখাতের পরিকল্পনা নিয়েছিল। চরমপন্থীদের কার্যকলাপ ও চিন্তাভাবনার ফলে জাতীয় আন্দোলনের ওপর হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল। শিবাজি উৎসব, গণপতি উৎসব, প্রতাপাদিত্য উৎসব, বীরাষ্টমী ইত্যাদির মাধ্যমে গণ-জাগরণ ঘটানো সম্ভব হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা ক্ষুণ্ণ হন, তাঁদের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দেয়। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা যায় চরমপন্থী নেতারা জাতীয় আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেন। আইনসভা বা সভাকক্ষ থেকে তাঁরা রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের বৈঠকখানা ছেড়ে রাজনীতি রাজপথে নেমে এসেছিল। সভা-সমিতি বা বক্তৃতা নয়, গণ-আন্দোলন ও প্রতিরোধ হল নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি।