মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি আলোচনা করো । মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ।
ভূমিকা :
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে যেসব ভারতীয় শক্তি সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রতিভা ও যোগ্যতা দেখিয়েছিল মারাঠারা হল তাদের অন্যতম। অন্যান্য দেশীয় শক্তি শিখ, রাজপুত, জাঠ ও আফগানদের চেয়ে মারাঠারা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ ছিল। এদের সামরিক প্রতিভা, নেতৃত্ব, প্রশাসনিক দক্ষতা ও কূটকৌশল মোগল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে মারাঠা রাষ্ট্রের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর পঞ্চাশ বছর ধরে মারাঠারা ভারতীয় রাজনীতিতে ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মারাঠারা যে দ্রুতগতিতে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল ইংরেজরাও তা পারেনি। এজন্য অনেক ভারতীয় ঐতিহাসিক আঠারো শতককে ‘মারাঠা শতক’ আখ্যা দিয়েছেন। দিল্লির বাদশাহ থেকে হায়দ্রাবাদের নিজাম মারাঠা আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু মারাঠাদের দুর্ভাগ্য হল তারা তাদের আধিপত্য দীর্ঘকাল টিকিয়ে রাখতে পারেনি।
মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনের কারণ :
১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠা শক্তি অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যায়নি। পেশোয়া প্রথম মাধব রাওয়ের নেতৃত্বে মারাঠারা উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। আঠারো শতকের শেষ পাদে ভারত সাম্রাজ্য নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে মারাঠাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। ১৭৭৫-১৮১৮ মধ্যে মারাঠাদের সঙ্গে ইংরেজদের তিনবার সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছিল, এই সংঘর্ষে মারাঠারা পরাস্ত হয়, ইংরেজরা জয়ী হয়। ইংরেজরা মারাঠা সাম্রাজ্য অধিকার করেছিল। মারাঠাদের পরাজয়ের পর ভারতীয় রাজনীতিতে ইংরেজরা অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসেছিল। বস্তুত পাঞ্জাব ও সিন্ধু বাদে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ সার্বভৌমত্ব স্থাপিত হয়। মারাঠা সাম্রাজ্যের উজ্জ্বল নাটকীয় আবির্ভাব ও আকস্মিক পতনের ব্যাখ্যা খুঁজেছেন ।ঐতিহাসিকরা (dramatic climax and grim aftermath)।
রানাডে, ভাণ্ডারকর, রাজওয়াড়ে, খরে ও সারদেশাই মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনের ওপর আলোকপাত করেছেন। স্যার যদুনাথ সরকারের লেখায় এই পতনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় শেষপর্বে নেতৃত্বের দুর্বলতা, অযোগ্যতা ও অপদার্থতা হল এই সাম্রাজ্যের পতনের একটি বড়ো কারণ। শিবাজি প্রজাকল্যাণকামী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে শাসকের চরিত্র, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা এবং দূরদর্শিতা রাষ্ট্রের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
প্রথম তিনজন পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ, প্রথম বাজিরাও ও বালাজি বাজিরাও নিজেদের প্রতিভা ও দক্ষতাবলে যে সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন পরবর্তীকালের নেতারা তাদের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার জন্য তা রক্ষা করতে পারেননি। মারাঠাদের শেষ পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও ছিলেন ষড়যন্ত্রপ্রিয় এবং দুর্বল চরিত্রের মানুষ। হোলকারের কাছে পরাস্ত হয়ে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে বেসিনের চুক্তি করে ওয়েলেসলির অধীনতামূলক মিত্রতা গ্রহণ করেন, স্বাধীনতা বিসর্জন দেন। সিন্ধিয়া পরিবারের প্রধান দৌলতরাও সিন্ধিয়া ছিলেন অপদার্থ, বিলাসী ও অলস। উচ্চস্তরের এইসব নেতারা তাদের কার্যকলাপের দ্বারা সমগ্র মারাঠা শাসকগোষ্ঠীর নৈতিক অধঃপতনের পথ তৈরি করে দেন। দেশের সর্বত্র অপশাসন, দুর্নীতি ও উৎপীড়ন দেখা দেয়। মারাঠা জাতির দুর্ভাগ্য তাদের প্রতিভাবান নেতারা সব অল্প বয়সে মারা যান।
শিবাজি, প্রথম বাজিরাও, প্রথম মাধব রাও, দ্বিতীয় মাধব রাও সকলে অল্প বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন। আঠারো শতকের শেষ দিকে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ যখন আগ্রাসী ভয়ংকর হয়ে উঠেছে মহানজি সিন্ধিয়া, হরিপন্থ ফাড়কে, অহল্যাবাঈ, নানা ফাড়নবিশ সকলে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে চলে যান। নানার মৃত্যু সম্পর্কে গ্রান্ট ডাফ লিখেছেন যে তার সঙ্গে মারাঠা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিচক্ষণতা ও নমনীয়তা নষ্ট হয়েছিল। মারাঠাদের মধ্যে যখন নেতৃত্বের অভাব ঠিক সেই সময় ইংরেজদের শ্রেষ্ঠ রাজপুরুষরা ভারতে এসে সাম্রাজ্য গঠনের কাজে মন দেন। এদের মধ্যে ছিলেন লর্ড ওয়েলেসলি (পরবর্তীকালের ডিউক অব ওয়েলিংটন) জন ম্যালকম, এলফিনস্টোন ও অন্যান্যরা।
স্যার যদুনাথ সরকার মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার ওপর জোর দিয়েছেন। মারাঠা রাষ্ট্রের মধ্যে মৌলিক ঐক্য ছিল না, এই রাজ্যে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি, উপজাতি ও গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়নি। এদের নিয়ে একজাতি, একরাজ্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। মারাঠা রাজ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অভাব ছিল। যে সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিবাজি মহারাষ্ট্রে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নেন আঠারো শতকে এসে সেই আন্দোলন নিঃশেষিত হয়ে যায়। অপর দিকে মারাঠাদের প্রতিপক্ষ ইংরেজরা ছিল প্রবল জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ একটি আধুনিক ইউরোপীয় জাতি।
মারাঠা শাসনতন্ত্রের দুর্বলতার কথা অনেকে উল্লেখ করেছেন। বালাজি বিশ্বনাথ শিবাজির আদর্শ থেকে সরে গিয়ে একটি শিথিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গঠন করেন। পেশোয়াদের শাসনকালে সিন্ধিয়া, হোলকার, গাইকোয়াড়, ভোঁসলে কার্যত স্বাধীন হয়ে যান, এদের পৃথক রাজপাট, কোষাগার ও সৈন্যবাহিনী ছিল। এরা নামমাত্র ছিল পেশোয়ার অধীন। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পর মারাঠা যুক্তরাষ্ট্রীয় বন্ধন আরও শিথিল হয়ে পড়েছিল। শুধু চারটি প্রধান শক্তি নয়, মারাঠা রাষ্ট্রের অসংখ্য সামন্ত প্রভু সর্দাররা স্বাধীনভাবে চলতে থাকে। সিন্ধিয়া, হোলকার, গাইকোয়াড় ও ভোঁসলে শুধু যে পেশোয়াকে মানত না তা নয়, এরা নিজেদের মধ্যেও কলহে লিপ্ত হত। সিন্ধিয়া ও হোলকার পরিবারের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে বিরোধ চলেছিল।
নাগপুরের ভোঁসলে রাজারা নিজেদের ছত্রপতিদের সমকক্ষ বলে মনে করতেন। শুধু মহারাষ্ট্রের মধ্যে নয়, মারাঠা দলপতিদের বিরোধ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজপুত রাজ্যগুলির ওপর আধিপত্য নিয়ে সিন্ধিয়া ও হোলকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। মারাঠা দলপতিরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে তাঁরা মারাঠা রাষ্ট্রের স্বার্থের কথা ভাবেননি। দ্বিতীয় মারাঠা যুদ্ধে মারাঠা রাষ্ট্রপঞ্চকের মধ্যে মাত্র দুটি সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। গাইকোয়াড় ইংরেজদের বন্ধু হন, আর হোলকার নিরপেক্ষ থাকেন, এতে ইংরেজদের খুবই সুবিধা হয়েছিল। সিন্ধিয়া ও ভোঁসলেকে পরাস্ত করে তারা হোলকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। মারাঠা সাম্রাজ্যে সাংবিধানিক বা কাঠামোগত ঐক্য না থাকায় মারাঠারা ইংরেজদের যথাযথভাবে বাধা দিতে পারেনি।
মারাঠা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কখনও শক্তিশালী ছিল না। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যে ধরনের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের দরকার হয় মারাঠা রাষ্ট্র তা কখনও অর্জন করতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে মারাঠাদের অর্থনৈতিক দুর্দশার সূচনা হয়। আওরঙ্গজেব তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে দীর্ঘ পঁচিশ বছর দাক্ষিণাত্যে কাটিয়েছিলেন, ঐ সময় কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষতি হয়।
দীর্ঘকাল ধরে মোগল বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করার ফলে মারাঠাদের মধ্যে সৈনিক মনোবৃত্তি গড়ে উঠেছিল। শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক কাজকর্মের চেয়ে পার্শ্ববর্তী গুজরাট, মালব, বুন্দেলখণ্ড, রাজপুতানা ইত্যাদি লুণ্ঠন করার দিকে তারা বেশি নজর দিয়েছিল। মারাঠা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল চৌথ ও সরদেশমুখী, পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে জোর করে চৌথ ও সরদেশমুখী আদায় করা হত। এই নীতি মারাঠা সাম্রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক হয়নি কারণ যে সমস্ত অঞ্চল থেকে এসব রাজস্ব আদায় করা হত সেখানকার শাসকরা মারাঠাদের শত্রুতে পরিণত হয়।
মারাঠা শাসকরা তাদের সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক বনিয়ানটি খুব শক্ত করে গড়ে তুলতে পারেননি। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির ওপর একটি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। মহারাষ্ট্রের কৃষি অনিশ্চিত বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ইজারাদারি ও সরঞ্জামি ব্যবস্থার জন্য মারাঠা কৃষক দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল, বণিকরা উৎপীড়নের শিকার হ্যা, শিল্পের তেমন উন্নতি হয়নি (From the economic point of view the Maratha state had no stable basis. Agriculture was dependent on precarious rainfall. Commerce was subjected to harassment. There was little industry)। মারাঠা রাষ্ট্রনায়করা সময়মতো তাদের সৈন্যদের বেতন দিতে পারতেন না। পেশোয়ার গর্দি বাহিনীর সৈন্যরা বিদ্রোহ করে নারায়ণ রাওকে হত্যা করেছিল। শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির দিকে শাসকদের নজর ছিল না। যুদ্ধ ছিল মহারাষ্ট্রের জাতীয় শিল্প, এই যুদ্ধের ওপর অত্যধিক নির্ভরতার জন্য মহারাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল।
মারাঠা শাসকরা উত্তর বা দক্ষিণে সুষ্ঠু সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। মারাঠাদের শাসনব্যবস্থায় ছিল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা। হুজুর দপ্তরের কাজকর্ম বা মামলাভদার ও কামবিসদাদদের কাজকর্মে নিদারুণ অবনতি ঘটেছিল। সাধারণ মানুষ সুবিচার পেত না, রাজ্যের কৃষক ও বণিকদের উৎপীড়ন থেকে রক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসেব ঠিকমতো রাখা হত না (Their agrarian legislation was inadequate. Accounts were not properly maintained) | মারাঠা সরকারের সঙ্গে জনগণের কোনো যোগাযোগ ছিল না। মারাঠা ঐতিহাসিকরা লিখেছেন যে, মারাঠা জাতির নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল, এজন্য মারাঠা শাসকগোষ্ঠী অনেকখানি দায়ী ছিল। তাঁরা দেশে শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা করেননি, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও ভোগবিলাস ইত্যাদি মারাঠা জাতির নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হয়। সিন্ধিয়া, হোলকার, ভোঁসলে ও গাইকোয়াড় কেউই নিজ নিজ রাজ্যের সুশাসনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। মারাঠা জনগণ শাসনের প্রতি ছিল উদাসীন, শাসকদের ভাগ্য সম্পর্কেও তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না।
সমকালীন ব্যক্তিরা লিখেছেন যে মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হল সামরিক (The military organisation of the Marathas was ill-organised, ill equipped and ill-disciplined)। শিবাজি একটি জাতীয় সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। পেশোয়াদের শাসনকালে মারাঠা সৈন্যবাহিনীর জাতীয় চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। সামন্ত নেতাদের অধীনে সামন্তবাহিনী গড়ে উঠেছিল। পেশোয়া বালাজি বাজিরাও সৈন্যবাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্য নেন। শুধু তাই নয়, তিনি বিদেশিদের অনুকরণে শিক্ষিত পদাতিক বাহিনী ও গোলন্দাজ বাহিনী গঠন করেন। মারাঠাদের সমস্যা হল আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি হয়নি অথচ তারা সামরিক বিভাগে আধুনিক যুদ্ধ পদ্ধতির প্রবর্তন করে হালকা অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে লড়াই করার সুযোগ নষ্ট করেছিল।
পেশোয়াদের সৈন্যবাহিনী মোগলদের মতো গতি হারিয়ে ফেলেছিল। অপর দিকে মারাঠাদের প্রতিপক্ষ ইংরেজরা ছিল সেই সময় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি, নৌশক্তিতে তারা ছিল অদ্বিতীয়। স্থলবাহিনীর ক্ষেত্রে তারা মারাঠাদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়েছিল। ইংরেজদের সুশিক্ষিত পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনী মারাঠা বাহিনীর চেয়ে উন্নততর ছিল। ইংরেজদের অশ্বারোহী বাহিনীর সঙ্গে মারাঠারা এঁটে উঠতে পারেনি। ইংরেজ সেনানায়করা আধুনিক যুদ্ধ কৌশল ও সমরবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত ছিল, এসবের সঙ্গে মারাঠাদের পরিচয় ছিল না। মারাঠাদের বিদেশি সৈনিক ও সেনাপতিদের অনেকে বিশ্বাসঘাতকতা করেন (মশিয়ে পেরো এর উদাহরণ), এতে তকতা ব মারাঠারা আরও বিপদের মধ্যে পড়েছিল। সর্বোপরি, মারাঠাদের হাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, উন্নত আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব ছিল, তাদের উন্নত গোলন্দাজ বাহিনী ছিল না। ইংরেজদের কূটনৈতিক ব্যবস্থা মারাঠাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ছিল, আধুনিক কূটনীতি কী মারাঠারা তা জানত না।
কেলকার ও সারদেশাই মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনে অদৃশ্য শক্তির ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন (The plays of the contingent and the unforeseen)। আসলে পশ্চিমি জগতে যে পরিবর্তন ঘটে চলেছিল মারাঠা নেতারা তার খবর রাখতেন না। আগ্রাসী ব্রিটিশ শক্তি একটি মধ্যযুগীয় অনুন্নত সমাজকে পরাস্ত করে নিজেদের অধিকার কায়েম করেছিল। এলফিনস্টোন শেষপর্বের মারাঠা নেতাদের কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন যে, মারাঠাদের সব ছিল, ছিল না শুধু নেতৃত্ব (They only lacked a leader)। অন্যদিকে আর্থার ওয়েলেসলি, লেক, এলফিনস্টোন, ম্যালকম ও মানরোর মতো নেতারা ইংরেজদের নেতৃত্ব দেন।
মারাঠারা ইংরেজ শিবিরে কোনো বিভেদ সৃষ্টি করতে পারেনি, ইংরেজদের দেশাত্মবোধ ছিল প্রবল, অন্যদিকে ইংরেজরা মারাঠা বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তা পেয়েছিল। নাটু, যশোবন্ত রাও, রামচন্দ্র ও যশোবন্ত রাও ঘোড়পারের মতো মারাঠারা ইংরেজদের কাছে গোপন সংবাদ সরবরাহ করেছিল। মারাঠাদের জাতীয়তাবোধের অভাব ছিল, অপর দিকে ইংরেজরা ছিল প্রবল জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ (The tragedy of the Maratha power was the inevitable result of nascent, formidable and aggressive British imperialism bursting upon a sleepy, inert and medieval society) |
মূল্যায়ন :
সর্বকালের যুদ্ধের এক সাধারণ নিয়ম হল যে জাতি সর্বাধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কৌশল আয়ত্ত করেছে তারাই যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হয়। ইউরোপে ইংরেজ জাতি ছিল উন্নত ও আধুনিক, অপরদিকে মারাঠারা মধ্যযুগীয় মানসিকতা ও অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার মারাঠাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। স্যার যদুনাথ সরকার লিখেছেন যে, মারাঠা শাসকদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মারাঠা-ব্রাহ্মণ দ্বন্দ্ব মহারাষ্ট্রের প্রাণশক্তি নিঃশেষ করেছিল। মারাঠারা কখনও ঐক্যবদ্ধভাবে ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে পারেনি। মারাঠা ঐতিহাসিক সারদেশাই, রাজওয়াড়ে ও ঘরে মারাঠাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে অনগ্রসরতা, মধ্যযুগীয় মানসিকতা, কুসংস্কার ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবকে তাদের পতনের জন্য দায়ী করেছেন। ইংরেজ ও মারাঠাদের মধ্যে দ্বন্দ্বে আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি জয়ী হয়েছিল।