মেইজি যুগে জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন এসেছিল?
মেজী সরকারের আধুনিকীকরণ তথা পাশ্চাত্যায়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষাপদ্ধতি। মেজী নেতৃবৃন্দ নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য জাপানী ছাত্রদের বিদেশে প্রেরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শোগুন যুগেই জাপানী ছাত্রদের বিদেশে প্রেরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে, পরবর্তীকালের নৌ কম্যান্ডার এনোমোটো ও অন্যান্যদের নেদারল্যান্ডসে পাঠানো হয়েছিল। এঁরাই জাপানের আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। চোয়ু গোষ্ঠী কর্তৃক ইটো (Ito) এবং ইনোয়ুকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে সাতসুমা গোষ্ঠী মোরি আরিনোরি (Mori Arinori, ১৮৪৭-১৮৮৯)-কে ইংল্যান্ডে পাঠান। মেজী সরকারের শাসনকালে বিদেশে ছাত্র প্রেরণের নীতিকে আরো সম্প্রসারিত করা হয়। এই নীতি অনুসরণ করে যুবকদের এবং কিছু যুবতীদের ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করা হয়েছিল। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ ইয়াকুরার নেতৃত্বে কম করে ৫৪ জন শিক্ষার্থীকে ইউরোপে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করা হয়েছিল। বিদেশ ফেরত এই শিক্ষার্থীরাই জাপানের আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইটো, ইনোয়ু এবং ইয়ামাগাতার মত অনেকেই পরে আধুনিক জাপানের প্রধান স্থপতিতে রূপান্তরিত হন। এঁরা জাপানের রাজনৈতিক, বুদ্ধি বৃত্তি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন।
বিদেশে প্রচুর সংখ্যক ছাত্র পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় মেজী নেতৃবৃন্দ বিদেশী বিশেষজ্ঞদের জাপানে এনে পাশ্চাত্যের জ্ঞান আহরণের এবং প্রযুক্তি আয়ত্তকরণের উপর জোর দেয়। শোগুন যুগের অন্তিমপর্বে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় নিয়োগ করা হয়। নতুন মেজী সরকার মেধা আমদানি করার এই নীতিকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করেন।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে Bureau Mines-এ ৩৪ জন বিদেশী বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হয় খনি শিল্পের উন্নতিকল্পে এবং এছাড়া ইউরোপীও বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করে কারখানা গড়ে তোলা হয়। ১৮৬৮ থেকে ১৮৭৪-এর মধ্যে আর. এইচ. ব্রান্টন (R. H. Brunton) নামক এক ইংরেজ নৌবিজ্ঞানী জাপানে নৌচলাচলের উন্নতির জন্য জাহাজে আলো স্থাপন করা ও বয়া লাগানোর কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মেজী সরকারের শিল্প মন্ত্রক ১৩০ জন বিদেশী বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করেন যাদের বেতন মন্ত্রকের স্থির ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ ছিল।
টোকুগাওয়া যুগের শেষপর্বের ওলন্দাজদের দেওয়া শিক্ষাপদ্ধতি গত পঞ্চাশ বছরে সেকেলে হয়ে গিয়েছিল। তাই বিদেশী পণ্ডিতদের দেশে নিয়ে এসে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও পাণ্ডিত্যলাভের নতুন প্রয়াস শুরু হয়। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে একদল জার্মান ডাক্তারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জাপানী চিকিৎসাব্যবস্থাকে জার্মান ধারায় গড়নের জন্য। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক ই. এস. মর্স (E. S. Morse) জাপানে আসেন। তিনি আধুনিক প্রাণীতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব এবং সমাজ বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতারূপে আজও সমাদৃত হয়ে আসছেন।
১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বোস্টনের দর্শনের অধ্যাপক আর্নেস্ট ফেনোলোসা (Ermest Fenellossa) জাপানে আসেন তাঁরই উৎসাহে। জাপানের দেশীয় শিল্পধারার পুনরুজ্জীবন সম্ভব হয়। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের দেশে নিয়ে এসে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই অতি অল্পদিনের মধ্যেই তাঁদের পরিবর্তে তাদের জাপানী ছাত্রদের বা সহযোগীদের নিয়োগ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্যুরো অফ মাইনস (Bureau of Mines)- এর বিদেশী কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে এক-তৃতীয়াংশ করা হয়। এইভাবে জাপানে মিশনারিরা বা ধর্মপ্রচারকরা বাদে বিদেশী বিশেষজ্ঞ বা কর্মীর সংখ্যা ব্যাপক হারে হ্রাস পায়।
পাশ্চাত্যায়নের আরেকটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম ছিল বিদেশী গ্রন্থের অনুবাদ। টোকুগাওয়া যুগে বিদেশী বা পাশ্চাত্য গ্রন্থ অনুবাদের জন্য একটি ব্যুরো গড়ে তোলা হয়েছিল ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে। নতুন মেজী সরকারের উদ্যোগে এই অনুবাদের কাজকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় সরকারি উদ্যোগের চেয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুবাদের কাজ আরো ত্বরান্বিত হয়। এই বিষয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন ফুকুজাওয়া ইউকিচি (Fukuzawa Yukichi, ১৮৩৫-১৯০১)। উত্তর কিউসুর সামুরাই বংশীয় ফুকুজাওয়া ইউকিচি ১৮৬০ ও ১৮৬২ সালে শোগুন কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রেরিত মিশনে অংশ নেন এবং বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি “Conditions in the West” বা “Seiyo-jijo” নামক গ্রন্থ প্রকাশ করে সহজ সরল ভাষায় পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের চিত্র তুলে ধরেন। এই গ্রন্থে তিনি ব্রিটিশ সংসদীয় ধাঁচের সরকারের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন। এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ১৫০,০০০ কপি বিক্রি হওয়ার ফলে জাপানী জনসমাজে তার ছাপ পড়ে। পরবর্তী দশকে তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে “The Encouragement of Learning” বা “Gakumon no Susume” নামক গ্রন্থটি খুব জনপ্রিয় হয়। জানা যায় যে এই গ্রন্থের ৭০০,০০০ কপি বিক্রি হয়। ফুকুজাওয়া সহজ সাবলীল লিখনশৈলীকে উৎসাহিত করেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি এবং আরো পনেরো জন বুদ্ধিজীবী মিলে মেইরোকুশা (Meirokusha) বা Sixth year of Meiji Society নামক একটি সোসাইটি গড়ে তোলেন। এই সংস্থা বক্তৃতা এবং একটি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে পাশ্চাত্য ভাবধারা জনপ্রিয় করে তোলেন। ফুকুজাওয়ার সঙ্গে আরো অনেক পণ্ডিত যোগ দিয়েছিলেন জাপানী ভাষায় পাশ্চাত্য গ্রন্থ অনুবাদের কাজে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির উপর লিখিত গম্ভীর গ্রন্থগুলিও অনুবাদ করা হয়। স্যামুয়েল স্মাইলস (Samuel Smiles)-এর ‘Self-Help’ এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের “On Liberty” যথাক্রমে ১৮৭০ ও ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে অনূদিত হয়। এছাড়া রবিনসন ক্রুসো (Robinson Crusoe) ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে অনুবাদ করার পর প্রচুর পশ্চিমী ধ্রুপদী ও জনপ্রিয় সাহিত্য অনূদিত হয়। এর মধ্যে জুলভার্নের (Jules Verne) ছদ্ম-বিজ্ঞানের কাহিনী খুব জনপ্রিয় হয়।
নতুন মেজী সরকার পাশ্চাত্য ধাঁচে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার উদ্যোগ নেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী ধাঁচে জাপানের শিক্ষা বিভাগকে গড়ে তোলা হয়। শোগুন যুগে বৌদ্ধ মন্দির স্কুলে ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষা দান করা হত এবং সামুরাইদের চীনা কনফুশীয় পদ্ধতিতে শিক্ষা দান করা হত। মেজী পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর এগুলির অস্তিত্ব বিলীন হয়। মেজী শাসনের প্রথমপর্বে শিন্টো ধর্মমতে বিশ্বাসী পণ্ডিতেরা সরকারি উদ্যোগে ঐতিহ্যগত জাপানী সংস্কৃতিকে শিক্ষার প্রধান বিষয়ে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। চীনা কনফুশীয় বিদ্যা ও পাশ্চাত্য শিক্ষাপদ্ধতিকে গৌণ স্থান দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফুকুজাওয়ার উদ্যোগ্যেই জাপানে পাশ্চাত্যের উপযোগবাদী শিক্ষা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি পাশ্চাত্যের উদার Anglo-Saxon শিক্ষার আদর্শকে স্বাধীন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানব গঠনের আবশ্যিক শর্ত মনে করেন।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে পুরনো সব শিক্ষাপদ্ধতিকে পরিত্যাগ করে ফরাসী আদলে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী জাপানকে আটটি বিশ্ববিদ্যালয় জেলায় ভাগ করা হয়। এগুলিকে আবার মিডল স্কুল (Middle School) এবং এলিমেন্টারি স্কুলে (Elementary School) -এ ভাগ করা হয়। প্রতিটি ইউনিভার্সিটি জেলায় প্রথমে ৩২টি মধ্য বা সেকেন্ডারি স্কুল অন্তর্ভুক্ত ছিল। সবমিলিয়ে প্রায় হাজার এলিমেন্টারি স্কুল বা প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। পাঠ্য পুস্তকের মান এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি সর্বত্র এক করা হয়। প্রাথমিক স্তরের পর উঁচু ক্লাসে ভর্তি সীমিত করার ফলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ প্রতিটি প্রিফেকচারে (Prefecture) নূন্যতম একটি সেকেণ্ডারি মিড্ল স্কুল স্থাপন করা হয়। যাইহোক, এই সময় নারী শিক্ষার প্রগতি তেমন হয়নি; খুব কম মেয়েই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেড়িয়ে উচ্চ শিক্ষালাভ করতে পেরেছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে কোনো মেয়েই ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হতে পারেনি। যাইহোক এই সময় জাপানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলি কলেজ প্রশিক্ষণের চাহিদা মিটিয়েছিল। প্রাইভেট স্কুলগুলি শিক্ষার উদারীকরণের নীতিকে লালন করেছিল। ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই ১৬ মাসের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের নীতি গৃহীত হয়েছিল। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে এই বাধ্যতামূলক শিক্ষা তিন বছরে জন্য সম্প্রসারিত করা হয়েছিল, পরে তা ছয় বছরের জন্য সম্প্রসারিত করা হয়। ফুকুজাওয়া এবং মোরি-র প্রভাবে মেজী জাপানের শিক্ষা-ব্যবস্থায় আমেরিকার উদার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব বাড়তে থাকে।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ডঃ ডেভিড মুরে (Dr. David Murray) – কে জাপানে নিয়ে আসা হয় এবং তিনি পরবর্তী ছয় বছরের জন্য জাপানের শিক্ষা বিভাগের প্রভাবশালী পরামর্শদাতা নিযুক্ত হন। প্রাথমিক শিক্ষাকে আবার আমেরিকান মডেলে সাজানো হয় এবং নব প্রতিষ্ঠিত নর্মাল স্কুলগুলির নিয়ন্ত্রণ নগরপালের সরকারের ( Prefectural govts.) উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষার নিয়ন্ত্রণের বিকেন্দ্রীকরণের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা গৃহীত হয়, যদিও তা কার্যকর করা হয়নি।
উদার শিক্ষার নীতি প্রসঙ্গে ফুকুজাওয়ার কেইয়ো গিজুকু (Kcio-gijuku) এবং দোশিশা (Doshisha) ও অন্যান্য খ্রিস্টান স্কুলগুলির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ওকুমা (Okuma) সরকার ছেড়ে যেতে বাধ্য হলে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের এর জবাব দেন এক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের (১৮৮২ খ্রিঃ) মাধ্যমে যা পরবর্তীকালে ওয়াসেদা (Waseda) বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। ওয়াসেদা ও কেইয়ো জাপানের দুটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এই সময় আরো কিছু প্রাইভেট স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, যার কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে জাপানে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটে। মিশনারি সোসাইটিগুলি নিজেদের উদ্যোগে জাপানে প্রথমদিকের অনেকগুলি সেকেন্ডারি স্কুল মেয়েদের জন্য খুলেছিল।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় সফরকারী প্রথম পাঁচ ছাত্রীর অন্যতমা সুদা উমেকো (Tsuda Umcko) ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজী ভাষার বিশেষ প্রতিষ্ঠান Tsuda কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনটি ছোট প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে টোকিও ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটি গড়ে ওঠে। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত অর্থেই বিবিধ বিভাগ বিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে ওঠে। কিছুকাল এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা স্নাতকেরা সরাসরি সরকারি চাকুরীতে নিযুক্ত হত। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত অর্থে ভবিষ্যত সরকারি আধিকারীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এর অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতকরা উচ্চ আমলতান্ত্রিক পদগুলিতে একাধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: কিয়োটো (Kyoto) ১৮৯৭ খ্রিঃ, টোহোকু (Tohoku) ১৯০৭ খ্রিঃ, কিউণ্ড (Kyushu) ১৯১০ খ্রিঃ, হোক্কাইডো (Hokkaido) ১৯১৮ খ্রিঃ এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলি না থাকলেও জাপানে স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে এই বিদ্যালয়গুলি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
বিংশ শতকের প্রথম দিকে জাপানের নতুন শিক্ষা কাঠামো সম্পূর্ণ হয়। এই শিক্ষা কাঠামোর একেবারে তলায় ছিল ৬ বছরের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা যা ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। এর উপরে তিন ধরনের প্রতিষ্ঠান ছিল : (১) পাঁচ বছরের ‘মিড্ল স্কুল’ বা মধ্যস্তরের বিদ্যালয় ছাত্রদের জন্য; (২) বিভিন্ন ধরনের কারিগরি বিদ্যালয় যেগুলি প্রাথমিক স্তরের কারিগরি দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করত। (৩) মেয়েদের উচ্চ বিদ্যালয়, যেখানে সম্পন্ন পরিবারের মেয়েদের সব ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এর উপরের স্তরে তিন বছরের শিক্ষার ও কারিগরি শিক্ষার উচ্চ বিদ্যালয় ছিল। সবশেষে শিক্ষার এই পিরামিডের মাথায় অবস্থান তিন বছরের পাঠ্যক্রমের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই পাঠ্যক্রমের সময়সীমা ছিল চার বছর।
মেজী যুগে, সাধারণভাবে, শিক্ষার অসাধারণ অগ্রগতি সাধিত হয়। সামগ্রিকভাবে শিক্ষার পরিকাঠামো ছিল যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত। সরকার নিয়ন্ত্রিত কম বেতনের (Tution fee) স্কুলগুলি পাশ্চাত্যের ইংরেজী ভাষার স্কুলগুলির চেয়ে অনেক বেশি সর্বসমতাবাদী (egalatarian) বা সাম্যতন্ত্রী ছিল। কিন্তু ১৭ বছরের দীর্ঘ শিক্ষার এই সামগ্রিক পরিকল্পনা দেশ ও সমাজের সকল স্তরের জনগণের শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নারীশিক্ষা সরকারি পরিকাঠামোর বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিকশিত হয়েছিল। মূলত মিশনারীদের প্রচেষ্টায় জাপানের নারী শিক্ষার সূত্রপাত হয়। পরে মেজী সরকার এই কাজে এগিয়ে আসে। জাপানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ব্যাপক বিকাশ একথা প্রমাণ করে যে সরকারি উদ্যোগে শিক্ষা বিকাশের নীতি জাপানী সমাজের চাহিদার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। আরেকটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার জন্য জাপানীরা যতটা পাশ্চাত্যমুখী, সাধারণ শিক্ষণ বা সারস্বত সাধনা ও নীতিশিক্ষার বিষয়ে তারা চীনের মত দেশীয় ধর্ম-বিশ্বাস ও নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষায় ততটাই যত্নশীল ছিল। তাই এই সময় জাপানে দর্শনচর্চা ও শিন্টো ধর্মের পুনঃরুজ্জীবন হয়। এবং প্রাচীন অসিচালন-বিদ্যাচর্চা (Kendo)-কে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা হয়।
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মেজী সরকারের শিক্ষামন্ত্রক আমেরিকান চিন্তাধারার সঙ্গে বেমানান জার্মান নীতিকে গ্রহণ করে যার মূল বক্তব্য হল “শিক্ষা ছাত্রদের সুবিধার জন্য নয়, জাতির সুবিধার জন্য” (“Education is not for the benefit of the student but of the nation”) ১৮৯০-এর শিক্ষা অনুশাসনে (Rescript) বলা হয় : “Our imperial ancestors have founded our empire on a basis broad and everlasting, and have deeply and firmly implanted virtue; our subjects ever united in loyalty and filial piety have from generation to generation illustrated the beauty thereof. This is the glory of the funda mental character of our nation, and herein also lies the source of our education”।
মেজী সরকারের শিক্ষা বিষয়ক অনুশাসনে ঐতিহ্যগত এশীয় মূল্যবোধের বিশেষ করে চীনের কনফুসীয় আদর্শের এবং সম্রাট অশোকের দ্বিতীয় ও সপ্তম স্তম্ভ লেখতে উল্লেখিত নৈতিক আদর্শের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। প্রজাবর্গের পিতামাতা, ভ্রাতা ভগিনী, শিক্ষক, বন্ধু ও ভৃত্যের প্রতি সদাচারের কথা যেমন অশোক বলেছেন, তেমনি কনফুশীয় তত্ত্বের পঞ্চ সম্পর্কে, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, জ্যাষ্ঠভ্রাতা কণিষ্ঠ ভ্রাতার মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ বিশেষ করে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানোচিত কর্তব্যবোধ (ffilial picty)-র উপর জোর দেওয়া হয়েছে। মেজী সরকারের শিক্ষা বিষয়ক অনুশাসনেও পিতামাতার প্রতি সন্তানোচিত ব্যবহার, ভাই-বোনের প্রতি স্নেহাসক্ত হতে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক গড়তে ও বন্ধুর প্রতি নিষ্ঠাবান হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি চর্চা, বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিক শক্তির বিকাশের এবং সংবিধান ও দেশের আইন মান্য করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং আপৎকালীন অবস্থার উদ্ভব হলে সাহসিকতার সঙ্গে নিজেকে রাষ্ট্রের স্বার্থে উৎসর্গ করতে বলা হয়। এইভাবে রাজসিংহাসনের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য এবং পূর্বপুরুষদের শ্রেষ্ঠ রীতিগুলি বজায় রাখার জন্য প্রজাবর্গকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এগুলি জাপানের প্রতিটি স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে পাঠ করানো হত। এই ব্যবস্থা দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে চলেছিল। নীতিশিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত এই অনুশাসন যেকোন প্রয়োজনীয় শিক্ষার উপর ধর্ম ও সম্রাটের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল। Crolis ও Buchanan তাই লেখেন: “Almost entirely moral in tone, the rescript restored the pre-eminence of religion based upon the nature of the emperor over any type of useful learning.”