মেইজি যুগে জাপানে সংঘটিত শিক্ষাগত সংস্কারগুলি আলোচনা কর।
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের চার্টার ওথে সম্রাট দেশে সর্বজনীন শিক্ষা প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেন (All people, high or low, and of both sexes should receive education, so that there should not be found one family in the whole empire, not one member of a family ignorant and illiterate)। শিক্ষার উদ্দেশ্যও ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। সারা পৃথিবী থেকে জ্ঞান আহরণ করে সম্রাটের শাসনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্য ঘোষিত হয় (Knowledge shall be sought ) for all over the world and thus shall be strengthened the foundation of imperial polity)।
মেজি নেতারা বুঝেছিলেন যে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির উৎস হল সর্বজনীন শিক্ষা। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে জাপানে শিক্ষাবিভাগ স্থাপন করা হয়। প্রথম দিককার শিক্ষাবিস্তার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ফুকুজাওয়া ও মোরি আরিনোরি। টোকুগাওয়া যুগে কিছু ছাত্র বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া শিখতে শুরু করেছিল। অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমি সাহিত্য, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে তাদের পরিচয় গড়ে উঠেছিল। মেজি সরকার এই ব্যবস্থা বজায় রেখেছিল, তাছাড়া বিদেশিরা জাপানে এসে জাপানি ছাত্রদের নানাবিষয়ে শিক্ষা দিত।
বিদেশি বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি, নৌবিদ্যা, জাহাজ নির্মাণ, ভাষা শিক্ষাদান ইত্যাদি কাজের গ্রহণ করা হয়। মেজি যুগে খ্রিস্টান মিশনারিরা জাপানে প্রবেশ করে শিক্ষার বিস্তারে, বিশেষ করে নারী শিক্ষার বিস্তারে সহায়তা দিয়েছিল। কুকুজাওয়া ও মোরি মিলে মেরোকুশা নামে সংস্থা স্থাপন করে পশ্চিমি জ্ঞানবিজ্ঞানের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন।
টোকুগাওয়া যুগে জাপানে একধরনের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা ছিল, এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদের লেখাপড়া ও অঙ্ক শেখানো হত। মঠগুলি এগুলি পরিচালনা করত। তা ছাড়া ছিল হান স্কুল ও বেসরকারি ব্যক্তিদের স্থাপিত বিদ্যালয়, এসব বিদ্যালয়ে সর্বশ্রেণীর মানুষ শিক্ষা পেত না। মেজি প্রত্যাবর্তনের পর এসব বিদ্যায়তন বন্ধ হয়ে যায়, সরকার ফরাসি, মার্কিন ও পরে জার্মান উপদেষ্টাদের পরামর্শ মতো শিক্ষানীতি স্থির করেন।
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে জাপানে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। রিচার্ড স্টোরি জানাচ্ছেন যে মেজি নেতারা যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন তাতে প্রতি ছশো জনের জন্য অন্তত একটি বিদ্যালয় ছিল, মোট ৫৪,০০০ | শিক্ষায়তন স্থাপিত হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা সম্পর্কিত ঘোষণায় তিন ধরনের | শিক্ষায়তনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল—প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়। পরে | শিক্ষক শিক্ষণ বিদ্যালয় ও টেকনিক্যাল স্কুল যুক্ত করা হয়। মেজি নেতাদের | শিক্ষা পরিকল্পনায় মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না, শিক্ষার লক্ষ্য হল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, দেশ, জাতি ও সম্রাটের প্রতি অবিচল আনুগত্য তৈরি করা, আধুনিক প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক কৌশল আয়ত্ত করা এবং দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা (Therefore education was limited to specific purposes: national unification, unquestioning loyalty, the acquirement of modern scientific and economic technique and the perfection of national defence)।
সরকার ঘোষণা করেছিল ব্যবহারিক শিক্ষা ও স্বাধীন চিন্তার ওপর জোর দেওয়া হবে। শিক্ষার বিস্তার ঘটলে শিক্ষিত সচেতন মানুষ সরকারের কাজকর্মের সমালোচনা করতে থাকে, সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাস তৈরি হয়। মহিলা ও পুরুষদের শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ভিন্ন, পুরুষরা রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের কাজ করবে, মহিলারা স্ত্রী ও মাতা হিসেবে সমাজে তাদের ভূমিকা পালন করবে।
১৮৮০-এর দশকে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে যায় (a great shift in educational policy came during the 1880s)। শিক্ষা পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, নৈতিক শিক্ষার দিকে ঝুঁকেছিলেন। এই পর্বে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন মোরি আরিনোরি (১৮৮৬-১৮৮৯)। শুধু শিক্ষায়তন নয়, পাঠক্রমের ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছিল, সত্তরের দশকের উদারনৈতিক শিক্ষানীতির পরিবর্তন ঘটে। শিক্ষকদের সামরিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়, কনফুসীয় আদর্শবাদকে শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর সম্রাটের আদেশে বলা হয় শিক্ষার উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য উপযুক্ত, দক্ষ ব্যক্তি গড়ে তোলা। সম্রাটের ছবি ও সরকারি আদেশ প্রত্যেক শিক্ষায়তনে পাঠানো হয়। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের সরকারি আদেশে প্রত্যেক প্রিফেকচারে অস্তম্ভ একটি স্ত্রীশিক্ষায়তন স্থাপন করা হয়। এব্যাপারে অধিকতর উদ্যোগ নিয়েছিল মিশনারি সংস্থাগুলি। সরকার বিদ্যালয়গুলির ওপর সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিল। এদের মধ্যে বিখ্যাত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় হল কিয়োটো, তোহুকু, কুসু ও হোক্কাইডো। এই শিক্ষাব্যবস্থার অন্য বৈশিষ্ট্য হল প্রাথমিক শিক্ষার পর উচ্চশিক্ষা ছিল স্বেচ্ছাধীন। সম্পন্ন মানুষেরা তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা দিতে পারত।
জাপানি নেতারা শিক্ষার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং দেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারেননি। মোরি দেশের প্রতি দায়বদ্ধ শিক্ষিত তরুণশ্রেণী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শিক্ষা পরিকল্পনার ফলে জাপান এশিয়ার সবচেয়ে শিক্ষিত দেশে পরিণত হয়েছিল ঠিকই (The Japanese became the most highly literate people in Asia) কিন্তু সামরিক শিক্ষাদানের নীতি পরবর্তীকালে সমরবাদের উদ্ভবে সহায়তা করেছিল। পশ্চিমি সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান ছিল সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। তা সত্ত্বেও উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রবণতার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না।
ফেয়ারব্যাঙ্ক মেজি জাপানের শিক্ষা সংস্কারের প্রশংসা করেছেন (This was a beautifully logical system and on the whole it worked very well)। শিক্ষার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল, অল্প ব্যয়ে সাধারণ মানুষ শিক্ষা নিতে পারত। এর ত্রুটি হল শিক্ষা পরিকল্পনাকারীরা ১৭ বছর ব্যাপী শিক্ষার যে ব্যবস্থা করেন তাতে রাষ্ট্রের সুবিধা হয়, কিন্তু জাপানি সমাজের সব চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। উচ্চ শিক্ষা ও স্ত্রীশিক্ষার চাহিদা মেটানো সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই চাহিদা মেটাতে এগিয়ে এসেছিল বেসরকারি সংস্থা ও খ্রিস্টান মিশনারিরা।