রাজস্থানী চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর। রাজস্থানী শিল্পের বৈশিষ্ট্য।
প্রকৃতপক্ষে বিশুদ্ধ রাজস্থানীশৈলী বলে সম্ভবত কিছুই নেই। মুঘল শিল্পের মত এর কোনো একটি কেন্দ্র বা সরলরৈখিক ঐতিহাসিক অভিমুখ অনুপস্থিত। রাজস্থানের আঞ্চলিক ঘরানার মধ্যে আজমীর, অম্বর (জয়পুর), ওর্ছা, বুঁদি, কোটা, কিষেণগড়, মাড়োয়ার (যোধপুর) ও মেবার (উদয়পুর) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রাজস্থানী চিত্রকলায় দেশীয় ঐতিহ্যে আদিম প্রাণশক্তি, দৃঢ়, বলিষ্ঠ বহিঃরেখা ও উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার দ্বারা একটি সু-সামঞ্জস্যপূর্ণ আদর্শ গড়ে উঠেছিল। মুখের গড়ন, স্থানীয় দৃশ্যাবলী ও কৌশলগত কিছু প্রভেদ আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যে লক্ষণীয় ছিল মাত্র। রাজপুত-জীবনের স্বকীয় নান্দনিকতার অনুভূতিসমূহ, দৈনন্দিনতা ও আবেগপূর্ণ ভাবনার আকস্মিক প্রবাহ রাজস্থানী চিত্রকলায় অনুপম রূপে প্রকাশ পায়।
রাজস্থানী শিল্পকলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গঠন ও কম্পোজিশন অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সরল। নির্দিষ্ট সাঙ্গীতিক ধরনও রাধা-কৃষ্ণের ধর্মীয় বিষয়সমূহ এতে বহুল পরিমাণে চিত্রিত হয়। চিত্রগুলিতে শরীরের গঠনের একইরকম পরিপ্রেক্ষিতকে এখানে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে। নারী চরিত্রকে একটি চিত্রে যখন উপস্থাপন করা হয়, তখন অন্য নারী চরিত্রগুলিতেও নারী চরিত্রকে একইরকমভাবে উপস্থাপনা করা হয়ে থাকে। প্রায় প্রত্যেকেরই পদ্মের মত চোখ, দৃঢ় স্তন, তন্বী কোমর ও গোলাপের মত হাত।
রাজস্থানী চিত্রগুলি দ্বিমাত্রিক। রেখার চলন সেখানে সোজা এবং রঙের ব্যবহার অত্যন্ত সরল। প্রতিটি রঙের ব্যবহার অবশ্য করা হয়। অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এবং প্রতিটি রঙের একটি নির্দিষ্ট প্রতীকায়ণ আছে। রাজপুত শিল্পীরা তাদের আঞ্চলিক বিভিন্নতা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে রঙ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক অদ্ভূত সমঝোতা গড়ে তুলেছিলেন। লাল রঙ– উষ্ণতা, আবেগ, উত্তেজনা; হলুদ–বিস্ময়; বাদামি—প্রেম সম্বন্ধীয় উপমা বোঝাতে ব্যবহৃত হত। উজ্জ্বল লাল, নীল ও সবুজ রঙের ব্যবহার একধরনের বৈপরীত্যমূলক ঔজ্জ্বল্য প্রকট করে। মাঝে মাঝে ছবিতে মোহিনী সৌন্দর্য যুক্ত করার জন্য সোনালী এবং রূপোলী রঙ খুব সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করা হয়।
রাজস্থানী চিত্রশৈলী বিদেশী প্রভুদের (মুঘল) কাছ থেকে কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে কিছু প্রাথমিক কৌশল এবং ছন্দবদ্ধ সীমারেখার মত কিছু ছোটোখাটো বিষয় গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেগুলিকে ব্যবহার করে নিজস্ব শৈল্পিক সৃষ্টিগুলিকে শিল্পীরা আরও বলিষ্ঠ ও উন্নত করেছিলেন মাত্র। কিন্তু কখনোই নিজস্ব চিত্রশৈলীকে বিদেশী প্রভুদের কাছে নত হতে দেননি।
রাজস্থানী চিত্রকলার অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য ছিল রঙের ব্যবহার। মুঘল চিত্রকলায় রঙ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আড়ম্বর ও অলঙ্করণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু রাজস্থানী চিত্রকলায় অদ্ভূত কৌশলে উজ্জ্বল রঙ ও অতি অলঙ্করণযুক্ত নক্সায় সজ্জিত করে যেভাবে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা অথবা ভক্তি বা বীররসের আখ্যানগুলিকে তুলে ধরা হয় তা একইসাথে রাজপুত অভিজাত এবং সাধারণ কৃষক উভয়েরই হৃদয় জয় করে।
রাজস্থানী চিত্রে ধ্রুপদী সঙ্গীতের মূর্ছনা বা ভাব প্রকাশ পেয়েছিল ‘রাগমালা চিত্রাবলী’-তে ব্যবহৃত রঙসমূহের মধ্যে। সর্বোপরি, বিভিন্ন ধরনের কল্পনা ও ভাবনাকে চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশের পরও দর্শকের নিজস্ব ভাবনা ও ব্যাখ্যার জন্য অবকাশ রাখা হয়েছিল। চিত্রে বিষয়বস্তু এমনভাবে নির্বাচন করা হয়েছিল, যাতে শিল্পী স্পষ্টভাবে বিষয়কে প্রকাশ করতে সক্ষম হন; অথচ চিত্র নির্মাণের খরচ খুব বেশি হয় না।