রাজস্থানী চিত্রকলা সম্পর্কে টিকা লেখ ।
রাজস্থানী শিল্পের প্রধান প্রধান আঞ্চলিক ক্ষেত্রগুলি ছিল মেবার, মালব, বুঁদি, কোটা, যোধপুর (মারওয়াড়), জয়পুর, বিকানির ও অম্বর।
মেবার
মেবার ছিল রাজস্থানী শিল্পচর্চার অন্যতম কেন্দ্র। মেবারের রানা প্রতাপ সিংহ মুঘলদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল সংগ্রাম চালান এবং ট্র্যাজিক হিরে৷” হিসেবে শিল্পীদের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠেন। তাঁর পৌত্র করণ সিংহ মুঘল শিল্পরুচির দ্বারা প্রভাবিত হলেও মেবারের শিল্পীরা মুঘলশৈলী পুরোপুরি গ্রহণ করেননি। মেবারের প্রাচীনতম পুঁথি (১৪২৩ খ্রিস্টাব্দ), যাতে মেবার চিত্রকলার নিদর্শন রয়েছে তা হল ‘সুপাসনাচর্যম’ এবং ‘সুপার্শ্বনাথম্’ (অপভ্রংশশৈলীতে লিখিত)। রানা প্রতাপের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘রাগমালা চিত্রাবলী’ সম্পূর্ণ করা হয়। এগুলিতে রঙের বলিষ্ঠতা, কৌণিকতার প্রয়োগ, অনুপাত মোটেই সুন্দর নয়। অথচ, অপভ্রংশশৈলীর কু-দর্শনতা যেন অনেকটাই দুরীভূত হয়। মানব-মূর্তিগুলি এখানে কালো পশ্চাদভূমির উপর স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
মার্জিত মেবারশৈলীর সূত্রপাত হয় ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে। মাণ্ডুর রাজা মুঘলদের কাছে পরাজিত হলে (১৫৭০ খ্রিস্টাব্দ) সেখানকার একদল চিত্রকর মেবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এর ফলে মেবারের চিত্রশৈলীতে একটা মধ্য-ভারতীয় ধারা যুক্ত হয়। মেবারের নিথারদিন পরিবার ছিল রাজস্থানী শিল্পশৈলীর প্রধান পথিকৃৎ। সপ্তদশ শতাব্দীতে সাহেবদিন (১৬২৭-৪৮ খ্রিস্টাব্দ) দীর্ঘ ২০ বছর শিল্পচর্চায় নিযুক্ত ছিলেন। বলা হয় – ‘This phase represents the Mewar school at its hight’। করণ সিংহের পুত্র জগৎ সিংহ চিত্রাঙ্কন শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁরই সময়ে সাহেবদিন ‘রাগমালা’, ‘ভগবৎপুরাণ’, ‘নায়ক-নায়িকা-ভেদ’-র উপর চিত্রগুচ্ছ অঙ্কণ করেন। মাণ্ডু থেকে আগত মনোহর আঁকেন রামায়ণের উপর অঙ্কিত চিত্ররাজি। এই পর্বের মেবার চিত্রকলায় উজ্জ্বল রঙ ব্যবহৃত হত। পশ্চাদভূমিতে একটি নির্দিষ্ট রঙ ব্যবহার করা হত।
বৈপরীত্যমূলক রঙের ব্যবহার দ্বারা শারীরিক অবয়বগুলি সমগ্র ছবিতে একধরনের ইন্দ্রজাল রচনা করত। মেবার চিত্রকলায় পুরুষ ও নারীর নাক লম্বা, মুখমণ্ডল ডিম্বাকৃতি, চোখ মাছের মত প্রলম্বিত। নারীকে পুরুষের তুলনায় একটু খাটো করে আঁকা হত। পুরুষের মাথায় পাগড়ি, নক্সা আঁক ঢিলে-ঢালা পোষাক; আর মহিলাদের পরণে থাকত চোলি ও স্বচ্ছ ওড়না। পশুপাখির চিত্রগুলিতে প্রথমদিকে প্রাচীন অপভ্রংশশৈলী ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীকালে হাতি ও ঘোড়ার যে ছবিগুলি আঁকা হয়েছিল তাতে ‘বাস্তববাদী’ মুঘল চিত্রকলার প্রভাব অনেকটাই চোখে পড়ে।
মেবারশৈলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য, ভক্তিদেবতা কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে অধিক সংখ্যক চিত্র অঙ্কন। সমকালীন প্রথাসমূহ, গ্রামীণ জীবন, সঙ্গীত ও নৃত্যকলা, বিবাহ-শোভাযাত্রা, রাজদরবার, প্রাসাদ জীবন ও যুদ্ধের দৃশ্যাবলীও বিষয় হিসেবে উঠে আসে। বৃক্ষরাজি সেখানে শোভাবর্ধনকারী গাছের ডালে ডালে পুষ্পশোভিত; পাহাড় ও টিলাগুলি পারসিক রীতিতে অঙ্কিত এবং জলের ঢেউগুলি অপভ্রংশশৈলীর ঝুড়ির আকৃতিবিশিষ্ট। পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহার সেখানে খুবই সীমিত; সমগ্র ছবিটির পরিসর নানা স্তরের রঙ ব্যবহার দ্বারা চিত্রিত করা হয়।
রাজস্থানী শিল্পকলার মেবারশৈলী একটু বেশি মাত্রায় রক্ষণশীল; মুঘল প্রভাব থেকে নিজ স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে অতি-সতর্ক। কেউ কেউ ১৬০৫ সালের ছবি ‘রাগমালা’-কে মেবারশৈলীর পরিপূর্ণ প্রকাশ বলে চিহ্নিত করেছেন। সপ্তদশ শতকের শেষভাগ এবং অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে মেবারশৈলীর পুনরুজ্জীবন ঘটলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে আবার এর অবনতি লক্ষ্য করা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দরবারী চিত্রকলা রূপে মেবারশৈলী নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখে।
মালব
মেবারের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত মালব ছিল রাজস্থানী চিত্রকলার একটি বিশেষ কেন্দ্র। মেবারশৈলীর সাথে এর মিল থাকলেও মালবের একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। মালব অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরনো রাজস্থানী চিত্রমালা হল ‘রসিকপ্রিয়’ (১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তী স্তরে ‘রাগমালা চিত্রাবলী’ তাঙ্কিত হয়েছিল। ১৭০০ সালের পর মালবশৈলী বিভিন্ন আঞ্চলিক স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়।
বুঁদি
বুঁদি রাজ্যটি পশ্চিমে মেবার, দক্ষিণে মালব এবং উত্তরে জয়পুর দ্বারা বেষ্টিত। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে এটি হরবংশ দ্বারা শাসিত হত। ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে বুন্দির রাজপরিবারের আনুকূল্যে ‘চুনার রাগমালা’ অঙ্কিত হয়েছিল। ১৬২৫ সাল পর্যন্ত বুঁদি ও কোটা ছিল একটিই রাজ্য। এরপর এটি মুঘলদের দ্বারা দু’টি পৃথক রাজ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে বুঁদি মেবারশৈলীর একটি শাখা হিসেবে পরিচালিত হয় এবং এর উপরে মুঘল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
বুঁদির চিত্রে মুখ গোলাকার, চিবুকে একটু ছায়া আভাস, নাক তীক্ষ্ণ, চোখের দৃষ্টিতে আকর্ষক মোহ ও আবেগ সেগুলিকে অনন্যতা প্রদান করে। বুঁদি চিত্রকলায় পাহাড়ের সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য, ঘন অরণ্য, নদী, পদ্মে ভরা পুকুর ও হ্রদ, জলবিহারি পাখি দ্বারা প্রাকৃতিক চিত্রাবলীতে এক অপূর্ব শোভন মায়াজাল সৃষ্টি হয়।।
রাজা রতন সিংহের আমলে (১৬০৭-৩১ খ্রিস্টাব্দ) দেওয়াল-চিত্রে বুদিশৈলীর নিদর্শনসমূহ ফুটে ওঠে। রাও-ছত্তর সাল (১৬৩১-৫৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং ভাও সিং (১৬৫৮-৮১ খ্রিস্টাব্দ) দরবারী দৃশ্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। অভিজাতদের জীবনযাত্রা, বিশেষত তাদের প্রেম ও প্রেমিকারা বুঁদির চিত্রে স্থান পান।
বুঁদির চিত্রকলা বিকাশের গোড়ার দিকে অসম্বদ্ধ ‘রাগমালা চিত্রগুচ্ছ’ (চুনার রাগমালা) অঙ্কিত হয়েছিল। ‘ভৈরব রাগিনী’ নামে একটি চিত্রে একটি গম্বুজাকৃতি মন্দিরে একজন রমণী শিবের পূজায় রত। রমণীর গোলাকৃতি চিবুক নেবার শৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয়। একই সঙ্গে পশ্চাদভূমিতে বৃক্ষরাজি এবং সম্মুখভাগের পদ্মপুকুর বুঁদির ভূ-দৃশ্যাবলীর একান্ত নিজস্ব ধরন।
সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বুঁদি চিত্রশৈলীর সর্বোত্তম প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এইসময় মানুষের অবয়বে একটা লালচে-বাদামি রঙ দেওয়া হয়। নারীর মোচড়ানো কটিদেশ, টিকালো নাক, বাদামের মত আকৃতি বিশিষ্ট চোখ। নারী অবগুণ্ঠিতা, চেলি এবং ঘাঘড়া পরিবৃতা—যা একান্তই ভারতীয় ঐতিহ্য। অথচ, পুরুষ মুসলিমদের মত কুর্তা, চুড়িদার পাজামা পরিহিত; মাথায় মুঘল ধরনের পাগড়ি। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন বুদিশৈলী পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় সেসময় বুঁদি রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি অসমাপ্ত ও খণ্ডিত ভগবৎপুরাণ অঙ্কিত হয়।
সপ্তদশ শতকের শেষদিকে বুঁদি শিল্প আরও পরিশীলিত রূপ গ্রহণ করে এবং এতে নির্মল গোলাপি রং ব্যবহার করা হয়। জলরাশিকে পশ্চাদভূমিতে ঢেউ খেলানো সাদা রঙে প্রকাশ করা হতে থাকে। কমলা, নীল, সাদা, ধূসর ও সোনালি রঙের ব্যবহার করা হয় আকাশে ভাসমান মেঘরাশিকে ফুটিয়ে তুলতে। বুঁদি শিল্পীরা হাতির চিত্রে একটি নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ করেন। তরল রেখার দ্বারা হাতির মত বিশালাকার প্রাণীকে চিত্রিত করতে দক্ষতার প্রয়োজন হয়। ‘গ্রীষ্মকালীন হস্তি’ (Summer Elephant, 1750) নামক ছবিটিতে গ্রীষ্মের দাবদাহ ফুটিয়ে তোলার জন্য লাল, কমল, হলুদের মত রঙ ব্যবহার করা হয়েছিল পরম আন্তরিকতা ও উষ্ণতার সঙ্গে।
বুঁদি চিত্রকলায় আবার শিকারের দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছিল মুঘল চিত্ররীতির অনুকরণে। এইধরনের ছবি বুঁদিতে খুব জনপ্রিয় ছিল। ‘গোধূলি’ (Hour of Cowdust) ছবিতে রাখাল কৃষ্ণ এবং বারান্দায় অপেক্ষারত রাধাকে অপূর্ব সুষমায় অঙ্কন করা হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে বুঁদি চিত্রকলার অবনতি লক্ষ্য করা যায়। এইসময় বুঁদি রাজপ্রাসাদে, চিত্রশালায় মুরাল অঙ্কণ ছিল একমাত্র উল্লেখযোগ্য কাজ। এখানেও কৃষ্ণের কাহিনী, শিকারের দৃশ্য এবং রাজকীয় শোভাযাত্রা অঙ্কিত হয়েছিল।
বুঁদিশৈলীতে মানুষের আকৃতি একইধরনের, কিন্তু তাদের মুখের অভিব্যক্তি আলাদা আলাদা। মানুষের মুখমণ্ডল ছোটো, গোলাকার চিবুকের কাছটিতে ছায়াবৃত আঁচড়, চোখ এবং তীক্ষ্ণ নাক শারীরী ভাষাকে আকর্ষণীয় ও আবেগপূর্ণ করে তোলে। ভূদৃশ্যে পাহাড়, ঘন অরণ্য, নদী এবং পদ্মভরা পুকুর; জলে মাছ ও জলজ পাখির জলকেলী অত্যন্ত সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছিল। বুঁদি চিত্রকলার আরেকটি অভিনবত্ব হল কখনো কখনো কোনার দিকে একটি মিনার বা গম্বুজ অঙ্কন। বুঁদি চিত্রকলার প্রিয় বিষয় ছিল— রাগমালা, বারোমাস্যা এবং রসিকপ্রিয়। বুঁদির ছবিতে পশ্চাদভূমিতে ছায়ার ব্যবহার এবং আকাশে আলোর প্রাচুর্য দক্ষিণীশৈলীর সঙ্গে বুঁদির সম্পর্কের আভাস দেয়।
কোটা
কোটা চিত্রকলা উপস্থিতিতে অত্যন্ত স্বাভাবিকতাময়; সম্পাদনার চরিত্রে লিপিময়তা (Calligraphic) লক্ষ্যণীয়। রাজা জগৎ সিংহের আমলে (১৬৫৮-৮৪ খ্রিস্টাব্দ) চনমনে রঙের ব্যবহার এবং বলিষ্ঠ রেখার দ্বারা ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়। অর্জুন সিংহের আমলে (১৮২০-২৩ খ্রিস্টাব্দ) আঁকশির মত টিকালো নাকযুক্ত পুরুষের ছবি আঁকা হতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিকারের দৃশ্য, রাগমালা এবং পোর্ট্রেট আঁকা হতে থাকে। দ্বিতীয় রাম সিংহের আমলে (১৮২৭-৬৬ খ্রিস্টাব্দ) পূজা, শিকার, দরবার এবং শোভাযাত্রার চিত্র অঙ্কনের নির্দেশ প্রদান করা হয়।
যোধপুর (মারওয়াড়)
যোধপুর রাজস্থানের সর্ববৃহৎ রাজ্য। মহম্মদ ঘুরি কর্তৃক মধ্যভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে রাঠোর বংশ এখানে আশ্রয় গ্রহণ করে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে যোধপুরে ভারতীয় জৈন পুথিশৈলী মূলত জৈন ধনী বনিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিক থেকে এখানে মুঘল প্রভাব পড়তে শুরু করে। এসময় রাণা উদয়সিংহের সঙ্গে মুঘল পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সেনাপতি যশোবন্ত সিংহ মালব, গুজরাট, দাক্ষিণাত্য শাসন করেন।
মহারাজা যশোবন্ত সিংহ চিত্রাঙ্কণ শিল্পের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। যোধপুর প্রাসাদে তাঁর বহু প্রতিকৃতি রয়েছে, যেগুলি মুঘলশৈলীতে আঁকা। সভাসদসহ যশোবও সিংহ এবং সঙ্গীতরসিক যশোরও সিংহের দু’টি প্রতিকৃতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দ্বিতীয় ছবিটি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অঙ্কিত হয়। এই ছবিটি মুঘল শিল্প রুচি থেকে অনেকটাই মুক্ত। ছবিটির রঙের কাজ ও বৈচিত্র্য অপূর্ব।
রাজা বিজয় সিংহের আমলে যোধপুরশৈলীর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে। এইসময় ছবিতে ছন্দবদ্ধ রেখার মত রঙের ছটা লক্ষ্য করা যায়। সুন্দরী রমণীদের লাবণ্যময় শরীর-চিত্রণে অবশ্য মুঘলশৈলীর প্রভাব ছিল। পশ্চাদভূমিতে একটি গাঢ় রঙের উপর এই ছবিগুলিতে অসাধারণ রূপ-লাবণ্য যুক্ত হয়েছিল। রমণীরা পাখি অথবা ঘুড়ি নিয়ে খেলা করেন। তাঁদের সৌন্দর্য মনোহর; প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর।
রাজা মানসিংহের আমলে (১৮৩৩-৪৩ খ্রিস্টাব্দ) যোধপুরশৈলী সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌছায়। ‘দুর্গাচরিত’, ‘‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘নলচরিত’, ‘শিবপুরাণ’ গ্রন্থের চিত্রায়নের পাশাপাশি স্বয়ং রাজা মানসিংহের রচিত ‘কৃষ্ণবিলাস’ পুথিটি চিত্রশোভিত করা হয়।
যোধপুরশৈলীর একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘ঢোলা মার্জনী’ (Dhola Marvani) গাথাকে অবলম্বন করে ১২১টি ধারাবাহিক চিত্রের সমাহার। চিত্রগুলিতে ঢোলা ও মার্জনী তাঁদের প্রিয় উট মারু-র পিঠে চড়ে গমন করছেন। উটের ঊর্ধ্বস্থিত মুখ এবং কোনাকুনি আঁকা পা’গুলি উটের গতিময়তাকে প্রকাশ করে। সওয়ারিদের দেহের বহিঃরেখাগুলি উটের দেহের বাঁকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। মার্জনীর ওড়না এবং উটের লেজ একই ধরনের ঢেউয়ে আন্দোলিত হয়। আপাত নিরীহ লাল পশ্চাদভূমিতে এনামেলের মত ঝলমলে রঙে চিত্রগুলি রচিত হয়।
যোধপুরশৈলীতে জাহাঙ্গীরশৈলীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃতির চিত্রগুলি প্রতীকধর্মী এবং কাব্যগুণসম্পন্ন। যোধপুর শৈলীতে নারীদেহগুলি লম্বা, বিনুনি উঁচু করে বাঁধা, কপাল উঁচু, চোখগুলি দোয়েল পাখির লেজের মত। অন্যান্য রাজপুতশৈলীগুলির থেকে এটি অনেকটাই আলাদা। এগুলিতে সূক্ষ্মতা তুলনামূলক কম—পোশাক আড়ম্বরপূর্ণ এবং রঙ উচ্ছ্বল। তাঁবু বা শিবিরগুলি সাদা রঙে আঁকা; বেশ বড় আকারের। এই শৈলীর একটি বিখ্যাত চিত্র হল ‘চৌঘান খেলোয়াড়’ (Chaughan Players )
জয়পুর
রাজস্থানী চিত্রকলায় জয়পুরশৈলীর একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। রাজস্থানের মধ্যে জয়পুরের সঙ্গেই মুঘল দরবারের বহুদিনের ঘনিষ্ঠতা থাকায় জয়পুর চিত্রকলার একটি শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রে পরিণত হয়। জয়পুরী পর্বের নায়ক-নায়িকার মুখের গড়ন, রঙের ঔজ্জ্বল্য ও সুন্দর রেখা-সম্পাত অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। সম্ভবত জয়পুরী শিল্পীরাই সর্বপ্রথম ‘রাগমালা’ ছত্রিশ রাগিণীর চিত্র অঙ্কন করেন। তারপর ভারতের সব অঞ্চলের শিল্পীরাই ‘রাগমালা চিত্র অঙ্কন করতে থাকেন। এসম্পর্কে নানা মতবাদ প্রচলিত থাকায় এই রাগমালারও বহু বিভিন্ন রূপ দেখতে পাওয়া যায়।
জয়পুরের শিল্পীরা মুঘল অনুকরণে বহু প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন। চৌহানরাজ পৃথ্বীরাজ, মহারাণা প্রতাপ সিংহের ছবি জয়পুরের শিল্পীরাই সর্বপ্রথম এঁকেছেন। এছাড়াও মানসিংহ, জয়সিংহ প্রমুখ জয়পুরের রাজাদের বহু প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে। সপ্তদশ শতকে আঁকা জয়সিংহ ও রাজসিংহের দু’টি প্রমাণ সাইজের প্রতিকৃতি জয়পুর প্রাসাদে দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রতিকৃতিদু’টিকে শিল্পীরা পোশাক-পরিচ্ছদে এত সূক্ষ্ম ও সুন্দর করে সাজিয়েছেন যে, মূল প্রতিকৃতির সৌন্দর্যই নষ্ট হয়ে গেছে।