শিমনোসেকি সন্ধির তাৎপর্য ।
চিন এই শিমনোসেকি সন্ধির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বলা হয়, লি তার দেশকে জাপানের হাতে তুলে দিয়েছেন (Li was accused of selling out the country)। প্রাদেশিক শাসকেরা আপত্তি করেছিল, তা সত্ত্বেও ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে চুক্তিটি দুই দেশ অনুমোদন করেছিল। তাইওয়ান হস্তান্তরের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ ছিল, তা সত্ত্বেও দ্বীপটি জাপানের হাতে চলে যায়। এই যুদ্ধে জাপানের জয় ও চিনের পরাজয়ের অনেকগুলি কারণ লক্ষ করা যায়।
প্রথম কারণ হল। জাপানের নব জাতীয়তাবাদ সরকার ও জনগণের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করেছিল, অপরদিকে চিনে সরকার ও জনগণ ছিল পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। জাপান সমস্ত শক্তি সংহত করে চিনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, অপরদিকে চিনের পক্ষ থেকে লড়াই করেছিল লি হুং চ্যাং-এর স্থল ও নৌবহর, অন্যরা যুদ্ধে যোগ দেয়নি। চিনের নেতৃত্ব ছিল বিভক্ত, ঐক্যহীন, ক্ষমতার বিভাজন ছিল না, জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ে সামিল হয়নি (China had no clear demarcation of authority, no unity of command, and no nationwide mobilizaion)।
পিকিং দরবার ছিল দ্বিধাগ্রস্ত, দিশাহীন, যথাসময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। চিনের বিপর্যয়ের আরো কারণ ছিল। রাজদরবারে ছিল প্রচণ্ড দুর্নীতি, আবার নৌবহর যারা পরিচালনা করেন তারাও ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত। বিধবা রানি জু সি নৌবহরের অর্থে তাঁর গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তিনি কতিপয় খোজা ক্রীতদাসের ওপর নির্ভর করতেন, সমগ্র শাসনব্যবস্থায় নীতিহীনতা পরাজয়কে সুনিশ্চিত করে তুলেছিল ( The general degeneration of public morality contributed to the defeat)। রাজপ্রাসাদে খোজা লি লিয়েন ইঙ্গ (Li Liengying) ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, তাকে উৎকোচ দিয়ে সৈন্যবাহিনী ও নৌবহরের অফিসাররা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করত। এসব কারণে চিনের পেয়াং নৌবহর ছিল দুর্বল।
চিনের কোরিয়া নীতি পরিচালনা করতেন লি কিন্তু লি আন্তর্জাতিক রাজনীতির খবর রাখতেন না। তিনি এক দেশকে অন্য দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে চিনের • স্বার্থরক্ষার প্রাচীন কূটনীতি অনুসরণ করে চলেছিলেন। প্রতিশ্রুতি মতো রাশিয়া । চিনকে সাহায্য দেয়নি, লি ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যপ্রার্থী হন। কিন্তু তারাও জাপানকে নিরস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
শিমনোসেকির সন্ধির ছ’দিন পরে রাশিয়া, জার্মানি ও ফ্রান্স জাপানকে লিয়াংটুং উপদ্বীপ চিনকে ফেরত দিতে বলেছিল। এদের বক্তব্য ছিল এই উপদ্বীপ জাপানের অধিকারে থাকলে পিকিং-এর নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হবে, কোরিয়া স্বাধীনতা হারাবে এবং সমগ্র পূর্ব এশিয়ার | পত্তি বিনষ্ট হবে (Japanese possession of Liaotung peninsula would menace Peking, render illusory the independence of Korea, and threaten the general peace in East Asia ) । আসলে এই অঞ্চলে রাশিয়ার সম্প্রসারণের ইচ্ছা ছিল। পশ্চিমি হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দেখে জাপান লিয়াংটুং চিনকে ৩০ মিলিয়ন টায়েলের বিনিময়ে ফেরত দিতে রাজি হয়। পিকিং দরবার ফ্রাঙ্কো-রুশ আর্থিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে জাপানের পাওনা মিটিয়েছিল, পরে ইঙ্গ-জার্মান সংস্থাও চিনকে ঋণ দিয়েছিল।
এই ঘটনার পর চিন রাশিয়ার ওপর নির্ভর করতে থাকে। চিনা রাজপুরুষরা মনে করেন পশ্চিমি ও জাপানি আগ্রাসন থেকে বাঁচতে হলে রাশিয়ার সাহায্য নিতে হবে। রাশিয়া চিনে শান্তিপূর্ণভাবে অনুপ্রবেশের নীতি অনুসরণ করে চলেছিল। (peaceful penetration of China)। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়া | লিয়াওটুং উপদ্বীপ চিনের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছিল, সাউথ মাঞ্চুরিয়ান রেলপথ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই ঘটনার পর অন্যান্য বিদেশি শক্তিগুলি চিনের বিভিন্ন অঞ্চল দখলের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছিল।
জার্মানরা শানটুং-এর দুজন জার্মান মিশনারিকে হত্যার সুযোগ নিয়ে কিয়াওচাও অধিকার করেছিল, জার্মানি এখানে রেলপথ নির্মাণের অধিকার আদায় করে নেয়। ব্রিটেন ওয়াইহাইওয়াই ও হংকং অঞ্চলে নতুন অধিকার পেয়েছিল, ইয়াংসি উপত্যকায় কার্যত ব্রিটিশ প্রভাবাধীন অঞ্চল স্থাপিত হয়। জাপান ফুকিয়েন প্রদেশে বিশেষ সুযোগসুবিধা পেয়েছিল, ফ্রান্স কোয়াংটুং-কোয়াংসি ও উনান অঞ্চলে প্রভাবাধীন অঞ্চল গড়ে তুলেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পেনীয় যুদ্ধ ও ফিলিপিন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। চিনের খণ্ডীকরণ ও দুর্ভাগ্য দেশের মধ্যে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। শাসক গোষ্ঠী সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিল, শত দিবসের সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী উগ্রপন্থী গুপ্ত সমিতির লোকেরা বিদেশি বিতাড়নের মধ্য দিয়ে দেশের মুক্তি খুঁজেছিল (বক্সার বিদ্রোহ)। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন চিনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে সব দেশের জন্য চিনে বাণিজ্যের অধিকার রক্ষা করার কথা বলেছিল।