শ্বেতপদ্ম সমিতির কার্যাবলী আলোচনা কর

 

শ্বেতপদ্ম সমিতির কার্যাবলী আলোচনা কর 

উনিশ শতকের চিন হল বিদ্রোহ ও বিপ্লবের পীঠস্থান, আর এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিত গুপ্ত সমিতিগুলি। চিং রাজবংশের স্বৈরাচার, অপশাসন ও দুর্নীতি জনমে যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটত গুপ্ত সমিতিগুলির অভ্যুত্থানে মাধ্যমে। এযুগে অনেকগুলি গুপ্ত সমিতির কথা জানা যায়, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ নামগুলি হল হেভেন অ্যান্ড আর্থ সোসাইটি (ট্রায়াড সোসাইটি), হেভেনলি রিজন সোসাইটি ও হোয়াইট লোটাস সোসাইটি। হেভেন অ্যান্ড আর্থ সোসাইটি মাধু বিরোধী ছিল, এরা মাঞ্চুদের বিতাড়িত করে মিং-দের ফিরিয়ে আনার কথ বলেছিল (overthrow the Ching and restore the Ming)। উনিশ শতকের চিনে রাজনৈতিক অধিকার, ব্যক্তিগত অধিকার, নাগরিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি ছিল না। গুপ্ত সমিতিগুলির কাজকর্মের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রকাশ ঘটত।

শ্বেতপদ্ম সমিতির চিনা নাম হল পাই লিয়েন চিয়াও (Pai-lien Chiao) প্রচলিত অর্থে শ্বেতপদ্ম সমিতি গুপ্ত সমিতি নয়, এটি হল একটি ধর্ম সম্প্রদায় পশ্চিমে সেচওয়ান থেকে পূর্বে শানটুং পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই সম্প্রদায়ের মানুষরা ঐক্যবন্ধ হয়। একাদশ শতকে এই ধর্ম সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এটি হল বৌদ্ধধর্মের এক লোকায়ত রূপ (Pureland Buddhism)। এই সম্প্রদায়ে যাজকরা হত বিবাহিত, নিরামিষাশী এবং মাতৃভাষায় শাস্ত্র আলোচনা করত। এজন্য বৌদ্ধরা এবং কনফুসীয় বুদ্ধিজীবীরা এদের পছন্দ করত না। স্থানীয় কৃষক, কারিগর, শ্রমিক ও বণিকরা এই ধর্মমত গ্রহণ করেছিল, সম্প্রদায়ের মধ্যে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য ছিল, কিন্তু সমন্বয় ও মৌল ঐক্য রক্ষা করা হয় (The white lotus creed was regionally diverse and broadly syncretic)। তাও লোর | কাহিনি, মৈত্রেয় বৌদ্ধমত এবং পুরোনো শাস্ত্রের আলোকিত রাজপুত্রের ধারণা | (Prince of light) এই আদর্শবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বুদ্ধ মৈত্রেয় রূণে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসবেন, আর আলোকিত রাজপুত্র অন্ধকার দূর করে পৃথিবীতে শান্তির স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। সব অন্ধকার দূর হয়ে যাবে, এটাই হল এই সম্প্রদায়ের দর্শন।

প্রকৃতিগত দিক থেকে তাইপিং বিদ্রোহ একটি কৃষক আন্দোলন হলেও এর সূচনা হয়েছিল একটি ধর্মীয় আন্দোলন রূপে যার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল মাঞ্চু (চিং) শাসনের অবসান। ধর্মীয় আদর্শের দ্বারা পরিচালিত এই আন্দোলনগুলি প্রতিষ্ঠান বিরোধী গুপ্ত সমিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। স্বদেশপ্রেমী এই গুপ্ত সমিতিগুলি (যেমন Heaven & Earth Society ও White Lotus Secret Society) মিং বংশের সমর্থক ছিল। তাই তারা বিদেশী চিং বংশের অবসান ঘটিয়ে মিং রাজবংশকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিল। মাঞ্চু স্বৈরতন্ত্রে আইনগতভাবে রাজবিরোধী শক্তির অস্তিত্ব অনুমোদিত না হওয়ায় গুপ্তসমিতিগুলিই মাঝে মাঝে চীনা ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে White Lotus Secret Society বা শ্বেত পদ্ম গুপ্ত সমিতির নেতৃত্বে এক বড় বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। মধ্য ইয়াংসি উপত্যকার পাহাড়ের পাদদেশে প্রচরণশীল কৃষকদের মধ্যে এই বিদ্রোহ দেখা দেয়। পাহাড়ের ঢালে তাদের এক ফসলী ভুট্টা চাষ ভূমিক্ষয়ের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল। এই কৃষি তথা আর্থিক সংকট জনিত হতাশা বিদ্রোহের রূপ নেয়। এই বিদ্রোহ দ্রুত গোটা উত্তর চীনে ছড়িয়ে পড়ে। অসন্তোষের আগুন চীনা সাম্রাজ্যের অর্ধাংশে এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের রূপ নেয়। গুপ্ত সমিতিগুলির মধ্যে White Lotus Sect-ই প্রথম আধা ধর্মীয় গোপন সমিতি রূপে সংগঠিত হয়েছিল ১২৫০ খ্রিস্টব্দে বা তারও আগে। এই সময় এই গুপ্ত সমিতির লক্ষ্য ছিল মোঙ্গল বংশের অবসান ঘটিয়ে সুং (Sung) বংশকে ক্ষমতায় আনা। চিং বা মাঞ্চুবংশের শাসনকালেও এই গোপন সমিতি টিকে ছিল। এই সময় তাদের লক্ষ্য হয় চিং বা মাঞ্চু বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিং রাজবংশকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা।

মাঞ্চুদের চীনা অধিবাসীদের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল এই গুপ্ত সমিতিগুলির অন্যতম লক্ষ্য। মাঞ্চু বিরোধী জনগণ যারাই এই লক্ষ্যে বিশ্বাসী ছিল তাদেরকেই গুপ্ত সমিতির সদস্যপদ দেওয়া হত। জন্ম, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান যাইহোক না কেন সকলকেই গোপন সমিতির সদস্যপদ দেওয়া হত। তবে সাধারণত নীচু শ্রেণীর লোকেরাই গুপ্ত সমিতির প্রতি আকৃষ্ট হত বেশী। White Lotus Secret Society সদস্যরা বৌদ্ধ ও তাও আদর্শকে গ্রহণ করেছিল গণসমর্থন পাবার জন্য। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে এই সমিতির অন্যতম নেতা লিউ সুংকে (Liu Sung) বন্দি করে সীমান্তে নির্বাসন দেওয়া হয়। তারপরে মাঞ্চু সরকার এই গোষ্ঠীর সদস্যদের নিরন্তর বিব্রত করার নীতি গ্রহণ করলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করে।

এরপর মাঞ্চু সরকার এই সমিতিকে সদস্যদের ব্যাপক ধরপাকড় ও নিগ্রহ শুরু করলে ১৭৯৬ খ্রিঃ White Lotus -র সদস্যরা মধ্য চীনে সরকারি নিগ্রহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। খুব অল্প দিনের মধ্যেই সেচুয়ান, হুপে, শেন্‌সী (Shensi) কানসু এবং হোনান প্রদেশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি সেনা এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। যে বিদ্রোহ দমনে অক্ষম হয়। আত্মরক্ষার তাগিদে স্থানীয় জেন্ট্রী ও কর্মচারীবৃন্দ নিজেরাই সামরিক সংগঠন গড়ে তোলে এবং দুর্গ নির্মাণ করে। যাইহোক নবছর পরে ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে এই আন্দোলন দমিত হয়। White Lotus Society-র প্রভাব মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের আদিম অধিবাসীদের মধ্যে গভীরভাবে পড়েছিল যার প্রতিফলন ১৮৩০-র মিয়াও (Miao) বিদ্রোহ ১৮৩৬-র হুনানের ইয়াও (Yao) বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি তাইপিং বিদ্রোহের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।