StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

সান ইয়াৎ সেনের তিনটি নীতি আলোচনা করো

সান ইয়াৎ সেনের তিনটি নীতি কি ছিল। সান ইয়াৎ সেনের তিনটি নীতি আলোচনা করো । সান ইয়াৎ সেনের তিনটি মূলনীতি ।

সান ইয়াৎ সেনের রাজনৈতিক দর্শন তাঁর ১৯২৪ সালে প্রদত্ত ১৬টি ভাষণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল যা সান মিন চুই বা “Three Principles of People” নামে পরিচিত। এগুলি হল— (১) জনগণের জাতীয়তাবাদ (Nationalism) (২) জনগণের অধিকার বা গণতন্ত্র (Democracy) এবং (৩) জনগণের জীবিকা বা সমাজতন্ত্র (Socialism) |

জাতীয়তাবাদ (Min-tsu) :

জনগণের জাতীয়তাবাদকে দুটি ভাগ করে এর প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করা যেতে পারে। এগুলি হল, (ক) রাজনৈতিক ঐক্য এবং (খ) সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা। ডঃ সান মনে করেন যে চীনা জনগণের চেতনায় দৃঢ় রাজনৈতিক ঐক্যের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং এই ধারণা পরম্পরাগত চীনা সাংস্কৃতিক ঐক্যের পরিবর্তে করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তাঁর মত হল: “The Chinese people were of the Han, or Chinese race with common blood, common language, common religion and common custom – a single pure race (ikomintsu)” সানের মতে চীনাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য থাকলেও জাতীয় ঐক্য নেই। তিনি তাঁর বক্তৃতামালায় চীনকে “বালির দড়ির” (Sand rope) সঙ্গে তুলনা করেন। মৌলগুলি এক হওয়া সত্বেও রাজনৈতিক ঐক্যের অভাবে তা ছিল বিচ্ছিন্ন।

সানের জাতীয়তাবাদের দ্বিতীয় দিকটি হল অ-সাম্রাজ্যবাদ। এখানে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা বলতে শুধু বিদেশী মাঞ্চু শাসনের অবসানের কথাই বলা হয়নি, সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল মোচনের কথাও বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সান জাতীয় স্বদেশ-প্রেমের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদই এশিয়ার উৎপীড়নের কারণ। সানের জাপান অবস্থান কালে জাপানী নেতৃবৃন্দরাও মনে করে যে, সমগ্র এশিয়ার স্বার্থে চীনের পুনরুত্থান বিশেষ প্রয়োজন এবং এই পুনরুত্থানে ডক্টর সেনের নেতৃত্ব অপরিহার্য। জাতীয়তাবাদকে সম্ভব করে তুলতে তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিকে মনে করতেন একদলীয় একনায়কতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ। তিনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাও বলেন। তিনি এশিয়ার সংগ্রামে জাপানের পক্ষ এবং শোষিত সর্বহারা শ্রেণীর সংগ্রামের ক্ষেত্রে রাশিয়ার পক্ষাবলম্বনের পক্ষপাতী ছিলেন।

গণতন্ত্র (Min-chuan ) : 

ডঃ সানের দর্শনের দ্বিতীয় নীতি হল গণতন্ত্র (Democracy)। তাঁর মতে চীনে গণতন্ত্র আসবে প্রথমে বিবর্তনের মাধ্যমে এবং পরে বিপ্লবের মাধ্যমে। গণতন্ত্রের বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে আমরা তিনটি স্তরে বিভক্ত করতে পারি—যথা সামরিক, রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক। গণতন্ত্রের প্রথম স্তরটি হবে রাজতন্ত্রের পতন জনিত বিশৃঙ্খলা দমনের স্তর। দ্বিতীয় স্তরে জনগণকে নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনের অধিকার দিতে হবে। তৃতীয় স্তর হবে সংবিধান, কেবিনেট ইত্যাদি নিয়ে গঠিত সংসদীয় স্তর। সানের গণতান্ত্রিক আদর্শ ভারতের সুভাষ চন্দ্রের ও তুরস্কের কামাল আতার্তুকের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে তুলনীয়। কেননা সানের মত নেতাজীও বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃত গণতন্ত্রের মর্ম উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই শক্তিশালী, কেন্দ্রভূত এবং স্বৈরাচারী। 

শাসনের স্তর অতিক্রম করা বাঞ্ছনীয়। সানের মতে গণতন্ত্র চীনাজাতিকে চারটি অধিকার দান করবে, যথা ভোটদানের অধিকার, আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণের অধিকার (Ini tiative), নির্বাচিত ব্যক্তির প্রত্যাহারের অধিকার (Re call ) এবং গণভোটের অধিকার) চীনা সরকারের পাঁচটি প্রশাসনিক ক্ষমতা হবে, আইন বিভাগীয়, প্রশাসনিক, বিচারবিভাগীয়, পরীক্ষা সম্বন্ধীয় এবং সামাজিক ও নৈতিক আচার পদ্ধতির সমালোচনার ক্ষমতা। কিন্তু যেহেতু চীনা জনগণ এই ধরনের সরকারের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হবে, সেই জন্য প্রাথমিক পর্বে কুয়োমিনটাং-এর অধীনে স্বায়ত্ব শাসনের প্রশিক্ষণ লাভ করবে। (সানের গণতান্ত্রিক আদর্শ পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হলেও চীনের প্রাচীন রাজনৈতিক রীতির সঙ্গে তাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছিল। যে উপাদানগুলির সমন্বয়ে সানের রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে উঠেছিল তা হল: (১) পাশ্চাত্য প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ, (২) উদ্যোগ সূচনার (initiation) এবং গণভোটের সুইস (Swiss) নীতি, (৩) গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার (democrative centralism) সোভিয়েট আদর্শ এবং চীনাদের পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের ঐতিহ্য।

সমাজতন্ত্র (Min-sheng ) : 

সানের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বা জনগণের জীবিকা, সমাজতন্ত্র, সমষ্টিবাদ, মুক্ত উদ্যোগ এবং মানবিকতাবাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। সমাজতন্ত্রের আদর্শ পূরণের জন্য সান দুটি প্রস্তাব দেন। তা হল ভূমির সম বন্টন এবং গলধন নিয়ন্ত্রণ। সানের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ চীনের প্রাচীন আদর্শ “লাঙ্গল যার, জমি তার Land to the tiller)”-এর আদর্শ এবং তাইপিংদের ভূমি বন্টন নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সান মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে চীনের কৃষকেরা যেমন সামন্ততান্ত্রিক শোষণ মুক্ত হবে তেমনি চীনে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের উত্থান রোধ করা সম্ভব হবে। সানের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুযায়ী বিপ্লবের শেষে ভূমিমূল্য বৃদ্ধি পেলে বর্ধিত মূল্যাংশ দেশের সরকারের প্রাপ্য বলে বিবেচিত হবে। এর ফলে ফাট্‌কাবাজ এবং একচেটিয়া কারবারীগণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে তিনি মনে করেন।

সান ইয়াৎ সেন মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। চীনা জাতীয়তাবাদীরা মার্ক্সবাদের বিরোধী না হলেও তারা বিশ্বাস করতেন যে তাদের নিজস্ব সমস্যা নিজেদের দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাধান করতে হবে। সান মার্ক্সীয় তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলেন যে চীনের কৃষিভিত্তিক সমাজে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব খাটে না। চীনে কৃষকদের জীবিকার ওপরই বেশী প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। চীনে কৃষি সমস্যার সমাধানের যে পথ সান দেখিয়েছিলেন তা আমাদের হেরি জর্জের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ সামাজিক বিকাশের ফলে জমির বর্ধিত মূল্য রাষ্ট্রের প্রাপ্য বলে গ্রহণ করে ভূমি মালিকানার সাম্যীকরণ করা সানের লক্ষ্য ছিল।

সংক্ষেপে সান সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক দিকটি গ্রহণ করেছিলেন। আদর্শগতভাবে সানের সমাজতন্ত্রকে জাতীয়তাবাদের স্বতঃসিদ্ধ দিগুলির পরিবেশগত এবং জনতত্ত্বগত সম্প্রসারণ রূপে বিবেচনা করা যেতে পারে। (প্রথাগত অর্থবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সানের চিন্তাধারাকে আধুনিক রাজনীতিবিদদের অবিকশিত রাষ্ট্রের সংস্কার পরিকল্পার সমতুল্য মনে হবে। সামগ্রিক বিচারে চীনা বিপ্লবের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সহগামী রূপে জাতীয় অর্থনৈতিক বিপ্লব ছিল অপরিহার্য। দ্বিতীয়তঃ, সানের সমাজতন্ত্র বা জনগণের জীবিকার সদর্থক দিক হল এখানে পুঁজি ও ভোগ্যপণ্যর সমন্বয়ে জাতীয় সমৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, সানের সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অস্পষ্ট হলেও ন্যায় বিচারের আদর্শ লক্ষ্য করা যায়। এখানে সকল শ্রেণীর বিশেষ করে সাধারণ জনগণের দাবিদাওয়া পূরণের কথা বলা হয়

রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবে সান ইয়াৎ সেন অনেকাংশে সফল ছিলেন। তিনি মাঞ্চুবংশের পতন ঘটিয়ে চীনে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছিলেন। বস্তুত সানের তিন নীতির আদর্শ জাতীয়তাবাদী চীনের সংবিধানের মূল ভিত্তি ছিল। পঞ্চশক্তির সংবিধান (Five Power constitution) গৃহীত হয়েছিল আঞ্চলিক স্বাধীনতার সঙ্গে কেন্দ্রিকতার মেলবন্ধন ঘটাবার জন্য। তাঁর আদর্শ চীনের শিক্ষানীতিরও ভিত রচনা করেছিল। তাছাড়া ডঃ সানের “The International Development of China” তে চীনের কৃষি ও শিল্প বিকাশের যে ব্যাপক পরিকল্পনার ছক কষেছিলেন তা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার নির্দেশিকা রূপে গৃহীত হয়েছিল। অবশেষে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন (National Planning) গড়ে তোলা হয় সানের পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দানের জন্য।

সানের নেতৃত্বে দুহাজার বছরেরও বেশি কাল ধরে চলে আসা রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটে এবং প্রজাতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু হয়। এটাই বিপ্লবের সবচেয়ে সফল দিক্। কিন্তু এর ফলে জনগণ যথার্থ প্রজাতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছিল এটা মনে করার কোন কারণ নেই। চীনের (সাধারণ জনগণ বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। মতাদর্শগত দিক থেকে তিনি সমাপ্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ হানতে পারেননি। তাঁর সমাজতন্ত্রে তাই পেটি বুর্জোয়া কল্পনাপ্রবণ সমাজতন্ত্রবাদের ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

মার্কসবাদীরা তাই সানের নেতৃত্বে সংগঠিত এই বিপ্লবকে “বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব” আখ্যা দিয়েছেন। তাছাড়া ইউয়ান শি-কাইয়ের সঙ্গে সানের আপোস মীমাংসাকে তাঁর সহকর্মীরা ভাল চোখে দেখেনি। ইউয়ানশি কাই যেমন মাথু রাজদরবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন ঠিক তেমনভাবেই তিনি চীনা বিপ্লবীদের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ক্ষমতা লাভের জন্য তিনি উৎকোচ প্রদান, সামরিক দাঙ্গা এবং আততায়ীদের কাজে লাগিয়েছিলেন এবং পার্লামেন্টকে কুক্ষিগত করে ও ইচ্ছেমত সংবিধান সংশোধন করে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে প্রয়াসী হন। ফলে সানের আদর্শ চীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরা থেকে যায়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *