সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও । সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশ ।
ভূমিকা :
বিশ শতকের প্রথম অর্ধের ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। হিন্দু, মুসলমান, শিখ ও খ্রিস্টান সকলের মধ্যে কমবেশি সাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনার বিকাশ ঘটেছে। নিজের সম্প্রদায়কে ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু নিজের সম্প্রদায়ের মঙ্গলকামনা থেকে অনেক অনর্থের সৃষ্টি হতে পারে। জাতিগঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে, সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখা দিতে পারে বা অন্য সম্প্রদায় সম্পর্কে ঘৃণা ও বিদ্বেষের সৃষ্টি হতে পারে।
সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশ :
অধ্যাপক বিপান চন্দ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদের উদ্ভব বিকাশ ও পরিণতি নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেছেন এবং লিখেছেন। সাম্প্রদায়িকতার উৎস তিনি খুঁজে পেয়েছেন তিনটি উপাদানের মধ্যে।
প্রথমত, সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী মানুষজন মনে করেন তাদের ধর্ম যেহেতু পৃথক তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থও পৃথক। এর দ্বিতীয় উপাদান হল অন্য ধর্মের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থও পৃথক ও ভিন্নমুখী মনে করা। প্রথমটির সঙ্গে দ্বিতীয়টির মিল হতে পারে না। এ ধরনের চিন্তার তৃতীয় উপাদানটি হল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের অভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ স্বার্থ থাকতে পারে না। এদের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী হতে বাধ্য, এদের মধ্যে স্বার্থ দ্বন্দ্ব বা সংঘাত হল অনিবার্য। এটি হল সাম্প্রদায়িকতাবাদের পরিণতি। সাম্প্রদায়িকতাবাদের প্রধান শত্রু হল বহুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ। বহু ধর্মের মানুষজন মিলে একটি জাতি গঠন করা বা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জাতি-রাষ্ট্র গঠন করাকে এরা গুরুত্ব দেন না।
বিপান চন্দ্র সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের তিনটি পর্ব লক্ষ করেছেন। প্রথম পর্বে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটেছে, দ্বিতীয় পর্বের সাম্প্রদায়িকতাবাদ অনেক মানবিক, মধ্যপন্থী বা উদারপন্থী। শেষ পর্বের সাম্প্রদায়িকতা অনুদার, সংকীর্ণ, অসহিষ্ণু, ঘৃণা ও বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। বলা বাহুল্য, এই ধরনের উগ্র অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িকতা জাতীয়তাবাদের ক্ষতি করেছে, জাতি-রাষ্ট্র গঠনের কাজ ব্যাহত হয়েছে। স্বাধীনতার শেষদিকে সাম্প্রদায়িক দলগুলি দাবি করেছে হিন্দু ও মুসলমান হল আলাদা জাতি, তাদের স্বার্থ ভিন্ন। এদের মধ্যে চিরকালের শত্রুতা রয়েছে, এদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব কাজ। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ এক নাও হতে পারে কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের মিল থাকতে বাধা নেই।
সাম্প্রদায়িকতাবাদের উর্বরক্ষেত্র হল হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মধ্যবিত্তরা। জওহরলাল নেহরু এধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন, উচ্চ বা নিম্নস্তরে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনা তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ভারতের জাত-পাতের সমস্যা নিয়েও এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়েছে। হিন্দু ধর্মের মধ্যেও উচ্চবর্গের মানুষের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ উঠেছে, এই অভিযোগ তুলেছেন দলিতরা। তবে উল্লেখ্য সাম্প্রদায়িকতা হল ভারতীয় রাজনীতির এক বাস্তব সত্য, একে অস্বীকার করা ঠিক নয়। একে ক্ষমতালোভী রাষ্ট্র নেতাদের কৌশল হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়, এর পিছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ।
ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অসম উন্নতি ঘটেছে। হিন্দুরা লেখাপড়া শিখে, সরকারি চাকরি, পেশা, ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্রিটিশ ভূমি ব্যবস্থায় হিন্দুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমির মালিক হয়ে বসেছে, মহাজনি কারবারে হিন্দু বণিকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। একদা রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। ভারতের অনগ্রসর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে, তাদের অবস্থান ও অগ্রগতি নিয়ে সমাজের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ততা দেখা দিয়েছে।
ব্রিটিশ সরকার অগ্রসর হিন্দুদের বিরুদ্ধে অনগ্রসর মুসলমান সমাজকে ব্যবহার করে ব্রিটিশ শক্তিকে অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াস চালিয়েছে। এতে সাম্প্রদায়িকতাবাদ অবশ্যই উৎসাহিত হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে হতাশা ও নৈরাশ্য ছিল, অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক পরিষেবার তেমন বিকাশ ঘটেনি। ভারতের সর্বত্র ভূস্বামী ও কৃষকের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল, পুঁজিপতি ও শ্রমিকের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। এসব দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তুলে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা যেত কিন্তু এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা সেদিকে নজর দেননি। অল্প সুযোগ-সুবিধার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল।
স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ও তাঁর আলিগড় আন্দোলন রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার প্রতিষ্ঠা দেয়। এই সাম্প্রদায়িকতা উগ্র বা অসহিষ্ণু ছিল না। স্যার সৈয়দের ধারণা হয় অগ্রসর হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মুসলমানরা পরাস্ত হবে। এজন্য তিনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বা নির্বাচনের বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করেন কংগ্রেস হল হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান, মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করবে না কংগ্রেস। মুসলমানদের স্বার্থে এদেশে চিরকাল ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখতে হবে, একাজে মুসলমানরা ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। তাঁর ধারণা হয়েছিল এদেশ থেকে ব্রিটিশ শক্তি সরে গেলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে গৃহযুদ্ধ হবে। গৃহযুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হবে কারণ অতীতে তারা এদেশ শাসন করেছে। সৈয়দ আহমদের পর তাঁর অনুগামী আলিগড় সম্প্রদায় এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাকে বজায় রেখে চলেছিল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে সরকার সংস্কারের ইঙ্গিত দিলে মুসলমান প্রতিনিধিরা লর্ড মিন্টোর সঙ্গে দেখা করে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার দিকে নজর দিতে বলেছিলেন। মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণ এবং পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের প্রস্তাব করা
হয়। মর্লে-মিন্টো সংস্কারে এসব প্রস্তাব গৃহীত হয়। উৎসাহিত হয়ে মুসলমান সমাজের উচ্চশ্রেণির নেতারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থপূরণ ও সম্প্রসারণের জন্য ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাতে গঠন করেছিলেন মুসলিম লিগ। ইতিমধ্যে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতারা স্বদেশি আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন, তাঁরা বঙ্গ বিভাজনকে তাদের স্বার্থরক্ষামূলক বলে গণ্য করেন। পূর্ববঙ্গের কয়েকটি জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় । ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে উচ্চশ্রেণির অভিজাতদের তাদের শাসনের সহায়ক বলে গণ্য করেছিল। কিন্তু ইউরোপে বলকান যুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ শাসক ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল।
ভারতীয় মুসলমানরা তুরস্কের খলিফার পদ ও তীর্থস্থানগুলির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। সাম্প্রদায়িক স্বার্থে তারা গান্ধিজির নেতৃত্বে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন করতে রাজি হয়েছিল। খিলাফতের স্বার্থে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছিল। কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে বিপ্লব ঘটিয়ে খলিফার পদ তুলে দিলে মুসলমানরা উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পর মুসলমানদের মধ্যে তনজিম ও তবলিগ এবং হিন্দুদের মধ্যে সংগঠন ও শুদ্ধি আন্দোলন শুরু হয়েছিল। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গার ঘটনা ঘটতে থাকে। কংগ্রেস নেতৃত্ব মুসলমানদের জাতীয় আন্দোলনে শামিল করতে পারেনি। জাতীয়তাবাদের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্য তৈরি হয়নি।
কংগ্রেসের ব্যর্থতার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের চরমপন্থীরা প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের ওপর জোর দিয়েছিল। বিপ্লবীরাও প্রাচীন সংস্কৃতি ও হিন্দু ধর্ম নিয়ে আত্মগৌরব বোধ করতে থাকে। রাষ্ট্রনেতারা তাঁদের ভাষণে, আলাপ-আলোচনায় হিন্দু প্রতীক বা হিন্দু কল্পরাজ্যের কথা বলেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদ প্রচার করার জন্য তিলক গণপতি উৎসব ও শিবাজি উৎসব প্রবর্তন করেন। মোগল শক্তির বিরুদ্ধে রাজপুত ও মারাঠাদের সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রাম হিসেবে দেখানো হয়। এতে মুসলমান মানসে অবশ্যই আঘাত লেগেছিল। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এদেশের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এরা প্রচার করেন যে মোগল শাসকরা ছিল অত্যাচারী, ব্রিটিশ শাসন মুসলমান অপশাসন থেকে হিন্দুদের রক্ষা করেছে। এদেশের সাহিত্যিকরা এই ধারাকে বহন করে মুসলমান শাসনকে অত্যাচারী বলে চিহ্নিত করেছিল। এসবের ফলে শিক্ষিত মুসলমানরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
এটা হল সাম্প্রদায়িকতাবাদের একটা দিক, এর অন্য দিক হল গোহত্যা বন্ধ করা নিয়ে আন্দোলন। এদেশের সামরিক শিবিরে গোহত্যা করা হত, সে সম্পর্কে হিন্দুরা অনেকটা নীরব ছিলেন কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গোহত্যা হলে তাঁরা সোচ্চার হতেন। উত্তরপ্রদেশে হিন্দি ও উর্দু নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। আর্যসমাজের মতো সংস্থা শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করলে সংখ্যালঘুরা ভয় পেয়েছিল। কংগ্রেস বারবার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করলেও বেশিরভাগ মুসলমান সে সম্পর্কে সন্দিহান থেকেছে, সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়নি। ভারতের মুসলমানরা পশ্চিম এশিয়ায় সাফল্যের কথা স্মরণ করে ইতিহাস লিখলেন, ঐসব দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তাদের নিজের বলে প্রচার করলেন। ভারতের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তাঁরা আপন করে নিতে পারেননি। মুসলমান রাজশক্তির পতন নিয়ে তাঁরা নিজেদের মতো করে ভাষ্য রচনা করলেন। হিন্দু ও মুসলমানের ঐতিহ্যের মধ্যে মিল হল না, ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বিভাজন রয়ে গেল।
আধুনিক ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয়েছে উনিশ শতকের শেষদিকে। জমিদার, মহাজন, পেশাদার, মধ্যবিত্ত সকলে ঔপনিবেশিক ইতিহাস ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে মুসলমানদের অত্যাচারী হিসেবে বর্ণনা করলেন। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এই অত্যাচার থেকে হিন্দুদের রক্ষা করেছে। হিন্দুরা ব্যাপকভাবে গোহত্যা বিরোধী প্রচার চালালে মুসলমানদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা মুসলমানদের মতো জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে আইনসভায় আসন সংরক্ষণ ও সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের দাবি তুলেছিল।
হিন্দু স্বার্থ রক্ষার জন্য পাঞ্জাবে হিন্দু সভা এবং পরে হিন্দু মহাসভা (১৯১৫) গঠিত হয়। হিন্দু মহাসভার নেতা লালচাঁদ ঘোষণা করেন ‘আমি প্রথমে হিন্দু, পরে ভারতীয়’। মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন অবশ্যই দুর্বল হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের যতখানি সমর্থন করতেন, হিন্দুদের ততখানি মদত দিতেন না। সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা একটি যুক্তি দেখিয়ে থাকেন যে অন্যদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিক্রিয়া হিসেবে সাম্প্রদায়িক পথ ধরেছেন। এই ধারণাটি একবারেই ভিত্তিহীন।
হিন্দু মহাসভার নেতারা প্রকাশ্যে প্রচার করতে শুরু করলেন মুসলমান বিরোধী মনোভাব। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হলে এই প্রচার উগ্র জঙ্গিবাদী হয়ে উঠেছিল। এরা বললেন ‘হিন্দু রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য হিন্দু জাতি, হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দু সভ্যতাকে বজায় রাখা, রক্ষা করা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হল লক্ষ্য’। হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা প্রচার করতে লাগলেন। লালা লাজপত রায়, মদনমোহন মালব্য এবং এন. সি. কেলকার হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়ে হিন্দু সংহতির কথা প্রচার করেন। মুসলমান সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা প্রচার করেন যে হিন্দুরা মুসলমানদের ওপর আধিপত্য করতে চাইছে। এসবের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রসার। সাইমন কমিশন তার রিপোর্টে বলেছিল ১৯২২-২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাঁচ বছরে এদেশে ১১২টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে যে সংবিধানের খসড়া রচিত হয় সাম্প্রদায়িক কারণে তা কার্যত বাতিল হয়ে যায়, মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায়ের নেতারা এর বিরোধিতা করেন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সমস্যার মীমাংসার চেষ্টা হয়েছিল লন্ডন গোলটেবিল বৈঠকে, কিন্তু আলোচনা নিষ্ফল হয়। ম্যাকডোনাল্ডের ঘোষণায় সাম্প্রদায়িক জটিলতা বেড়েছিল। হিন্দু রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত দরাজ হাতে আসন সংরক্ষণের সুযোগের ব্যবস্থা করে, চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে হয়তো সাম্প্রদায়িকতার তীব্রতা কমাতে পারত কিন্তু এই হিন্দুমধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল বেশ শক্তিশালী। আপস হলেও তা যে স্থায়ী হত তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না, অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক নেতাদের তোষণ করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে রাষ্ট্রনেতারা মনে করেননি। রাজনৈতিক স্তরে এর মোকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে অনেক কংগ্রেস নেতা মনে করেন কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। কৃষক ও শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দাবি দাওয়া নিয়ে সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হলে হয়তো সাম্প্রদায়িকতাবাদ দুর্বল হয়ে যেত।
হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের ভিত্তি ছিল দুর্বল ও সংকীর্ণ। ট্রেড ইউনিয়ন, কিষান সভা, যুব সভা সবই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। গান্ধিজি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে তাঁর কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সমাজবাদী চিন্তার বিস্তার ঘটলে সাম্প্রদায়িক শক্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মুসলমানদের অনেকে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, আবুল কালাম আজাদ ও আনসারি হলেন এদের অন্যতম। ভারতে সাম্প্রদায়িকতাবাদের শেষপর্বকে বিপান চন্দ্র বলেছেন ফ্যাসিস্ট পর্ব। এই পর্বে উভয় তরফে উন্মত্ততার লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের পর উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা উন্মত্ততা, ভয়, অবজ্ঞা ও প্রচণ্ড ঘৃণার মনোভাব নিয়ে’ পরস্পরকে আক্রমণ চালাতে থাকেন। পরস্পরের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চলেছিল, এমন সব স্লোগান দেওয়া হল যা আবেগ বা উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে। মুসলমানদের স্লোগান ছিল ‘ইসলাম বিপন্ন’। হিন্দুরাও পিছিয়ে ছিল না, তারাও প্রচার করলেন হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি বিপন্ন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুলভাবে জয়ী হলে মুসলমানরা ভয় পেয়েছিল। পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট দল এবং বাংলায় ফজলুল হকের প্রজা পার্টি সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকেছিল। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনী ফলাফল সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের কট্টর, উগ্র সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। গান্ধিজি ‘ভারত ছাড়ো’আন্দোলন শুরু করলে মুসলিম লিগ তার বিরোধিতা করেছিল।
মূল্যায়ন :
জিন্নাহ্র মতো উদারপন্থী রাষ্ট্রনেতা পাকিস্তান রাষ্ট্র স্থাপন করে মুসলমান স্বার্থরক্ষার কথা ভেবেছিলেন। হিন্দু আধিপত্যের ভয় থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকর বা আর. এস. এস. প্রধান গোলওয়ালকার ফ্যাসিস্ট কায়দায় তাদের সংগঠন গড়ে তোলেন। এদের বক্তব্য হল কংগ্রেস আন্দোলনের জন্য মুসলমানরা লাভবান হয়েছে, হিন্দু স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। হিন্দু ধর্ম বিপন্ন, হিন্দু বিশ্বাস বিপন্ন এবং হিন্দু সংস্কৃতি বিপন্ন বলে এরা প্রচার করেন। শেষপর্বে জিন্নাহ্ সাম্প্রদায়িকতার বিপদ উপলব্ধি করে সাবধানতা অবলম্বন করার কথা ভেবেছিলেন কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশভাগ হয়ে যায়। কংগ্রেস সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে দেশভাগ মেনে নিয়েছিল। অন্যকোনো বিকল্প তাঁরা খুঁজে পাননি। সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলা করার মতো রণনীতি কংগ্রেস নেতারা উদ্ভাবন করতে পারেননি। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের ব্যর্থতাকে অস্বীকার করা যায় না।