StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

স্কন্দগুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা কর

 

স্কন্দগুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা কর ।স্কন্দগুপ্তের কৃতিত্ব ।

ভূমিকা : 

স্কন্দগুপ্ত ছিলেন প্রথম কুমারগুপ্তের পুত্র । স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকাল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় পাঁচটি শিলালেখ থেকে। এগুলি হল—৪৫৮ খ্রিস্টাব্দের জুনাগড় শিলালেখ, ৪৬১ খ্রিস্টাব্দের কাহায়ুম স্তম্ভলেখ, ৪৬১ খ্রিস্টাব্দের সুপিয়া গুলেন, ৪৬৬ খ্রিস্টাব্দের ইন্দোর তাম্রশাসন এবং সর্বোপরি তারিখবিহীন ভিতারি গুলেখ। এই পাঁচটির মধ্যে জুনাগড়, ইন্দোর ও ভিতারি লেখই তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে প্রধান প্রধান তথ্য পরিবেশন করে থাকে। শুধু শিলালেখ নয়, মুদ্রাগত তথ্য থেকেও স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকাল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। লেখমালা ও মুদ্রাগত তথ্য থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে ৪৫৫-৪৬৭ খ্রিঃ পর্যন্ত স্কন্দগুপ্ত রাজত্ব করেছিলেন। 

স্কন্দগুপ্তের কৃতিত্ব : 

পিতার মৃত্যুর পরে পরেই স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে বসেছিলেন কিনা সে বিষয়ে ঐতিহাসিক মহলে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে পিতার মৃত্যুর পর তীব্র ভ্রাতৃবিরোধ দেখা দেয় এবং তারই সূত্র ধরে তিনি পরে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এক্ষেত্রে ভ্রাতৃবিরোধ বলতে স্কন্দগুপ্তের সঙ্গে পুরুগুপ্তের বিরোধের ওপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে। পুরুগুপ্ত যে প্রথম কুমারগুপ্তের একজন পুত্র ছিলেন সে বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় কিছু নালন্দা সীল (অভিজ্ঞান মুদ্রা)-এ।

প্রসঙ্গত বলা যায় বুধগুপ্তের নালন্দা সীলে ‘মহারাজাধিরাজ’ শ্রী-পুরুগুপ্তের নামোল্লেখ আছে এবং বলা হয়েছে যে তিনি ছিলেন প্রথম কুমারগুপ্তের প্রধানা মহিষী অনন্তদেবীর গর্ভজাত সন্তান। উদ্ধৃতিটি হল এরকম – “কুমারগুপ্তসতস্য পুত্রস্তপাদানুধ্যায়ত মহাদেব্যাম অনন্তদেব্যামুতপন্নো মহারাজাধিরাজ শ্রী পুরুগুপ্ত….।” রমেশচন্দ্র মজুমদার এই উদ্ধৃতিটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পরে পরেই সিংহাসনে আরোহণের ব্যাপারে স্কন্দগুপ্ত ও পুরুগুপ্তের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে পুরুগুপ্ত ছিলেন সিংহাসনের বৈধ অধিকারী। কারণ তাঁর মা মহাদেবী অনন্তদেবী ছিলেন কুমারগুপ্তের প্রধানা মহিষী। সাধারণত প্রধানা মহিষীর গর্ভজাত সন্তানই সিংহাসনের বৈধ দাবিদার হয়। অপরদিকে স্কন্দগুপ্ত সিংহাসন লাভের বৈধ অধিকারী ছিলেন না।

উপরিউক্ত তত্ত্বটিকে জোরদার করার জন্য তিনি ভিতারি স্তম্ভলেখর প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তিনি দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে ঐ লেখতে স্কন্দগুপ্তের পূর্বতন সমস্ত গুপ্তশাসক ও তাদের স্ত্রী (পত্নী)-দের নাম অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ অভিধা সহযোগে উচ্চারিত হয়েছে, অথচ আশ্চর্যের বিষয় যে সেখানে স্কন্দগুপ্তের মায়ের নাম অনুপস্থিত। এর ভিত্তিতে আর. সি. মজুমদার সিদ্ধান্তে এসেছেন যে তাঁর মাতৃ পরিচয় প্রদান তেমন গৌরবের বিষয় ছিল না এবং স্বাভাবিকভাবেই সিংহাসনের ওপর তাঁর বৈধ অধিকারও ছিল না। কিন্তু যোগ্যতা ও সামরিক দক্ষতার দিক থেকে তিনি পুরুগুপ্তের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন। এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে সিংহাসন দখল নিয়ে ভ্রাতৃবিরোধ বাধে।

ড. মজুমদার আরো মন্তব্য করেছেন যে, দূরবর্তী এক অভিযানের কাজে স্কন্দগুপ্ত ব্যস্ত থাকায় সেই অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাঁর সৎ ভাই পুরুগুপ্ত পিতা প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে পরেই সিংহাসনে বসেন। কিন্তু স্কন্দগুপ্ত তাঁর বিজয়াভিযান সেরে প্রত্যাবর্তনের পর পুরুগুপ্ত অপসারিত হন। এছাড়া স্কন্দগুপ্তের ভিতারি বা অন্য কোনো শিলালেখতে ‘তৎপাদানুধ্যাতা’ (পিতার মনোনীত) শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। অথচ পূর্বেই বলা হয়েছে যে পুরুগুপ্ত প্রসঙ্গে ঐ  শব্দটি বুধগুপ্তের নালন্দা সীলে ব্যবহৃত হয়েছে। এইভাবে তিনি দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন যে স্কন্দগুপ্ত পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অশোককুমার মজুমদারও প্রায় অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন যে আনুমানিক ৪৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে স্কন্দগুপ্তের সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে পুরুগুপ্ত অল্পকালের জন্য সিংহাসনে বসেছিলেন।

রমেশচন্দ্র মজুমদার ও তাঁর অনুগামীদের মতে, প্রথম কুমারগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তর মধ্যবর্তী সময়ে পুরুগুপ্তের স্থান নির্দিষ্ট করার বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। এ প্রসঙ্গে বি. পি. সিন্হার বক্তব্য উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে। তাঁর দ্য ডিক্লাইন অব দ্য কিংডম অব্ মগধ গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে, নালন্দা সীল লেখগুলিতে যেহেতু পুরুগুপ্ত প্রসঙ্গে ‘মহারাজাধিরাজ’ অভিধা যুক্ত হয়েছে এবং পিতা কুমারগুপ্তের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রশ্নে যেহেতু তৎপাদানুধ্যায়ত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সেহেতু খুব অল্পকালের জন্যে হলেও রাজা হিসাবে তাঁর শাসনের ইঙ্গিত অনেকটাই স্পষ্ট।

অধ্যাপক বি. এন. মুখার্জী বি. পি. সিনহার এই বক্তব্যকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রথম কুমারগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তের মধ্যবর্তী সময়কালে তাঁর স্থান নির্ণয়ে আপত্তি তুলেছেন। যুক্তির ভিত্তিতে তিনি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে যেহেতু পিতা প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের জ্ঞাত শেষ তারিখ (গুপ্তবর্ষ ১৩৬ অর্থাৎ ৪৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং পুত্র স্কন্দগুপ্তের রাজত্বের প্রথম জ্ঞাত তারিখ একই সেহেতু এই দুজন শাসকের মধ্যবর্তীকালের পুরুপ্তের স্থান নির্দিষ্ট করা যথোচিত হবে না। এই যুক্তিটি ছাড়াও মুদ্রাগত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি ঐ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে পুরুগুপ্তের শাসনকালকে কখনই স্কন্দগুপ্তের আগে নির্দিষ্ট করা ঠিক হবে না। তিনি প্রকৃতপক্ষে শাসন করেছিলেন আঃ ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালের অবসানের পর এবং স্কন্দগুপ্ত পিতার অব্যবহিত পরেই সিংহাসনে বসেছিলেন। 

প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পরে পরেই স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে বসেছিলেন একথা যদি ধরে নেওয়া হয় তাহলেও ঐ সময়ে মাতৃবিরোধের প্রশ্নটিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এমন হতে পারে যে কুমারগুপ্তের প্রধানা মহিষী অনন্তদেবীর গর্ভজাত সন্তান পুরুগুপ্ত পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনের ওপর বৈধ অধিকারের দাবি নিয়ে স্কন্দগুপ্তের সঙ্গে সংঘর্ষে নেমেছিলেন। কিন্তু এর ফল শেষপর্যন্ত তাঁর অনুকূলে যায়নি। সুতরাং এর থেকে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে স্কন্দগুপ্তের সিংহাসন আরোহণ একেবারে নিষ্কণ্টক ছিল না।

সিংহাসনে আরোহণের সময় এই ভ্রাতৃ-বিরোধের বিষয়টি ছাড়াও এর প্রাক্কালে তিনি যে পুষ্যমিত্রদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন সে কথা ইতিপূর্বে প্রসঙ্গক্রমে আলোচিত হওয়ার এখানে তা পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। তবে সিংহাসনে আরোহণের পর তিনি যে বৈদেশিক আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। এখানে বৈদেশিক আক্রমণ বলতে হুন আক্রমণকে বোঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান তথ্য হল, পূর্বে উল্লিখিত তারিখবিহীন ভিতারি স্তম্ভলেখ। ঐ লেখ-র অষ্টম স্তবকে দাবি করা হয়েছে যে স্কন্দগুপ্ত হুনদের সঙ্গে এক কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। 

স্কন্দগুপ্তের ৪৫৬-৫৮ খ্রিস্টাব্দের জুনাগড় লেখ থেকেও এই বিষয়টি কতকাংশে সমর্থিত হয়। কেননা, ঐ লেখ-র দ্বিতীয় ছত্রে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে স্কন্দগুপ্তের শত্রুভাবাপত্তা রাজারা তাঁর বিরুদ্ধে সাপের মতো ফণা উদ্যত করেছিলেন কিন্তু স্বপ্নগুপ্ত গরুড়ের মতো স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাহায্যে তাঁদের পরাভূত করেছিলেন। এছাড়া, ঐ লেখ-রই চতুর্থ ছত্রে বলা হয়েছে যে ম্লেচ্ছ দেশীয় (চ্ছে-দেশে) শত্রুদের তিনি মাথা নত করতে বাধ্য করেছিলেন। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী ও তাঁর অনুগামীরা ম্লেচ্ছদের সঙ্গে হুনদের অভিন্ন বলে মনে করেন। যদিও এই মত সর্বজনগ্রাহ্য নয়। অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখার্জী ঐ মতের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। প্রসঙ্গত বলা যায় শিলালৈখিক উপাদান ছাড়াও ভারতীয় সাহিত্য সোমদেবের “কথাসরিৎসাগর”-এ ম্লেচ্ছদের উল্লেখ আছে।

ম্লেচ্ছদের সঙ্গে হুনদের শনাক্তকরণ যদি সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে বলা যেতে পারে যে এই হুনরা ছিল ‘এপথ্যালাইট’ বা শ্বেত হন। উল্লেখ্য, এই ফারা প্রথমে মধ্য এশিয়া থেকে এসে অক্ষু  নদীর উপত্যকা দখল করে এবং পারস্য ও ভারতের পক্ষে এক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর তারা গন্ধার জায় করে (সম্ভবত বিদার কৃষাণদের কাছ থেকে)। রমেশচন্দ্র মজুমদার অনুমান করেছেন যে এরপর তারা সম্ভবত ভারতের অভ্যন্তরের দিকে অগ্রসর হয় এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের পক্ষে যথেষ্ট আশঙ্কা ও ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে হুনরা প্রকৃতপক্ষে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিল, না স্কন্দগুপ্ত গন্ধারে তাদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিলেন সে বিষয়ে বলা শক্ত। হুনদের সঙ্গে স্কন্দগুপ্তের সংঘাতের যে বর্ণনা ভিতারি তত্তলেখর অষ্টম স্তবকে করা হয়েছে সেই অংশটির বেশ কিছুটা ভেঙে গেলেও বাকি অংশটার ভিত্তিতে এটুকু বলা সম্ভব যে ঐ সংঘর্ষ বেশ তিক্ততর হয়েছিল এবং তাতে তিনি পুরোপুরি সফলও হয়েছিলেন।

হুনদের সঙ্গে স্কন্দগুপ্তের যুদ্ধ ঠিক কোন্ সময় বেধেছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা শক্ত। কেননা, ভিতারি স্তস্তলেখতে হুনদের সঙ্গে সংঘর্ষের কথা উল্লেখিত থাকলেও এই লেখটি তারিখবিহীন হওয়ায় তা বোঝা সম্ভব নয়। তবে এর জন্য স্কন্দগুপ্তের কৃতিত্বকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। বস্তুতপক্ষে গুপ্ত সাম্রাজ্যের তথা ভারতবর্ষের এক সংকট মুহূর্তে হতোদ্যম না হয়ে তরবারির সাহায্যে তিনি দুর্ধর্ষ হুনদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মূল্যায়ন:

স্কন্দগুপ্ত কর্তৃক হুনদের আক্রমণ প্রতিহত করার সূত্র ধরে পরবর্তী প্রায় অর্ধশতক গুপ্ত সাম্রাজ্য হন আক্রমণের সম্মুখীন হয়নি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, স্কন্দগুপ্ত কেবল তৎকালীন সংকট থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেননি; ভবিষ্যৎ বিপদের হাত থেকেও গুপ্ত সাম্রাজ্য তথা ভারতকে মুক্ত করেছিলেন তাই বলা চলে স্কন্দগুপ্তের কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *