স্কন্ধগুপ্তকে ভারতের রক্ষাকর্তা বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত ।
ভূমিকা :
হুন আক্রমণের সূত্র ধরে স্কন্দগুপ্ত ও তাঁর পূর্ববর্তী গুপ্ত শাসকদের রাজনৈতিক অনুরদর্শিতা প্রতিভাত হয়ে ওঠে। অধ্যাপক শ্রী রাম গয়াল এ প্রসঙ্গে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষা সম্পর্কে গুপ্ত শাসকদের কোনো বলিষ্ঠ নীতি গ্রহণ না করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। উত্তর-পশ্চিমের গিরিপথগুলি সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে যে-কোনো মুহূর্তে বৈদেশিক আক্রমণ ঘটতে পারে সেই বাস্তব সতাকে তারা উপলব্ধি করতে পারেননি। এরই ফলস্বরূপ হুনদের পক্ষে ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করা সহজসাধ্য হয়।
স্কন্ধগুপ্তকে ভারতের রক্ষাকর্তা বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত :
হুন আক্রমণের প্রাবলাকে অত্যন্ত শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছিলেন স্কন্দগুপ্ত। এক্ষেত্রে স্কন্দগুপ্তের কৃতিত্বকে সম্যকভাবে অনুধাবন করতে গেলে সমকালীন জগতে হুনদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। প্রসঙ্গত বলা যায়, স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণের অল্পকাল আগে ইওরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে হুনদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বিশাল রোমান সাম্রাজ্য এই বর্বর আক্রমণের চাপে বিশ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। হুনদের তৎকালীন নেতা অ্যাটিলা-র নেতৃত্বে এইসব ধ্বংস কাণ্ড ঘটেছিল। এমনকি স্কন্দগুপ্তের কাছে পরাজিত হবার অল্পকাল পর তারা পারস্য আক্রমণ করেছিল এবং পারস্যের শাসককে হত্যা করেছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখিয়েছেন যে যেখানে হুনরা প্রবেশ করেছিল সেখানেই শহর 80 ও নগরকে তারা বিধস্ত করে দেয়। হুনদের এই সমস্ত কর্মকাণ্ডকে সামনে রেখে বিচার করলে তাদের ওপর স্কন্দগুপ্তের এই মহান জয়লাভের ঘটনাকে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিচার করা বাঞ্ছনীয় হবে।
আর. সি. মজুমদার ছনদের সঙ্গে যুদ্ধে স্কন্দগুপ্তের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ‘ভারতের রক্ষাকর্তা’ অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যকে মোটেই অযৌক্তিক বলে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। বস্তুতপক্ষে বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ভারতবাসী এর ফলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। স্কন্দগুপ্তের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি যুবক-বৃদ্ধ সকলের মনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। বর্বরোচিত ও নিষ্ঠুর শত্রুদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করার এই মহান কৃতিত্বের জন্য সম্ভবত পিতামহের অনুকরণে তিনি ‘বিক্রমাদিত্য’ অভিধা গ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল এই যে, যখন পাশ্চাত্য সভ্যতা হুনদের ভয়াবহতার বিপদাপন্ন, তখন তিনি ভারতকে ঐ বিপদ থেকে মুক্ত করেছিলেন।
হুন আক্রমণের প্রাবল্যকে স্কন্দগুপ্ত কিষ্ট করেছিলেন সত্য, কিন্তু নতুন কোনো অঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেননি। এ পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি যার ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে তিনি কোনো নতুন এলাকা জয় করেছিলেন। তবে বৈদেশিক শত্রুদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যের অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়েছিল সে বিষয়ে সংশয় কম। স্বপ্নগুপ্তের সময়ের মুদ্রাগত তথ্যের ভিত্তিতে একথা বলা সম্ভব হয়। প্রথমত, তাঁর আমলে স্বর্ণমুদ্রাগুলি সংখ্যায় খুবই কম এবং দ্বিতীয়ত, মুদ্রাগুলিতে পূর্ববর্তী শাসকদের তুলনায় ধাতুর পরিমাণও কম।
স্কন্দগুপ্ত নতুন কোনো অঞ্চল সাম্রাজ্যভুক্ত না করলেও তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন পূর্বসুরিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের কোনো অঞ্চল নষ্ট হয়নি—তা অটুট ছিল। সুশাসনব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাকে তিনি সুদৃঢ় করার চেষ্টা নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে জুনাগড় শিলালেখর সপ্তম ছত্রে উদ্ধৃত সর্বেষু দেশে বিধায় গোখুন শব্দগুলি (সমস্ত ‘দেশ’ অর্থাৎ প্রদেশগুলি গোপ্তদের দ্বারা শাসিত হত) থেকে বিষয়টি বোঝা সম্ভব হয়।
বৈদেশিক আক্রমণের মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকলেও প্রজা সাধারণের মঙ্গল সাধনের ব্যাপারে তিনি যে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। এ প্রসঙ্গে তাঁর সময়ে জুনাগড় শিলালেখতে উল্লেখিত সুরাষ্ট্রের সুদর্শন হ্রদের সংস্কার সাধনে তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে। উল্লেখ্য, সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র থেকে অনেকটা দূরে অবস্থিত পশ্চিম ভারতের কাথিয়াবাড় অঞ্চলে হ্রদের সংস্কার সাধনে তাঁর উদ্যোগ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে তিনি কতখানি জনকল্যাণমূলক ছিলেন। ঐ লেখটির ষষ্ঠ একাদশ ছত্র থেকে জানা সম্ভব হয় যে বৃষ্টির জলে সুরাষ্ট্রের সুদর্শন হ্রদ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল, অথচ ঐ হ্রদটির মাধ্যমে এক বৃহৎ এলাকাব্যাপী কৃষিক্ষেত্রে জল সরবরাহ হত।
প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, মৌর্য শাসক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে ঐ হ্রদটি তৈরি হয়। পরে শক শাসক রুদ্রদামনের আমলে ১৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এর সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক নানা সমস্যার দরুন দীর্ঘকাল পর স্কন্দগুপ্তের রাজত্বের প্রথম বর্ষে হ্রদটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেখানের প্রাদেশিক শাসক পর্ণদত্ত ও তাঁর পুত্র চক্রপালিত অতি দ্রুত ঐ হ্রদটির মেরামতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ও সফল হন।
স্কন্দগুপ্ত সংক্রান্ত দীর্ঘ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা সম্ভব হয় যে তিনি এমন এক সময় সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন, যখন বৈদেশিক দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। ভ্রাতৃবিরোধের সম্ভাবনাকে সঠিক বলে ধরে নিলে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল বলা যায়। ঘরে-বাইরের এই উভয় সংকটকে কাটিয়ে উঠে তিনি শেষপর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন।
সৌভাগ্যবশত শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে তিনি কিছু যোগ্য কর্মচারীর সহায়তা লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে পূর্বে উল্লেখিত সুরাষ্ট্রের প্রাদেশিক শাসক পূর্ণদত্ত ও তাঁর পুত্র চক্রপালিত এবং অন্তর্বেদী বা গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলের বিষয়পতি সর্বনাগের নাম উল্লেখের দাবি রাখে। সিংহাসনে আরোহণের সময় ও অব্যবহিত পরেই সাম্রাজে কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলেও শেষপর্যন্ত তিনি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম হন। তাঁর শেষ জীবন শাস্তিতেই অতিবাহিত হয়। আনুমানিক ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে গুজরাট পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধিকারেই ছিল।
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সাম্রাজ্য সীমাকে তিনি যে অটুট রাখতে পেরেছিলেন তা শিলালৈখিক ও মুদ্রাগত তথ্য থেকে সমর্থিত হয়, যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। স্কন্দগুপ্তের বিরুদ্ধেঅবশ্য অভিযোগ তোলা হয় যে তিনি সাম্রাজ্যকে এমন সুদৃঢ় করে যেতে পারেননি, যার ওপর ভিত্তি করে তা অনেক দিন টিকে থাকতে পারে। তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল এই যে সাম্রাজ্যের দুর্বলতর অংশ সুরাষ্ট্র ও পশ্চিম মালবকে তিনি বিশেষ মজবুত করতে পারেননি। এই কারণেই সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর অল্পকাল পরেই ঐ দুটি অঞ্চল সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও ঘন আক্রমণকে প্রতিহত করেও মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি যে সাম্রাজ্যকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন তা তাঁর কৃতিত্বকে অম্লান করে রেখেছে অর্থাৎ স্কন্দগুপ্তকে ভারতের রক্ষাকর্তা বলা যুক্তিসঙ্গত।