১৭৭৩ এবং ১৮৩৩ সাল দুটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো ।
• রেগুলেটিং অ্যাক্ট (১৭৭৩)
আঠারো শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে নানা কারণে কোম্পানির ব্যাপারে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। ইংল্যান্ড ও ভারতে কোম্পানির শাসনের উন্নতি ঘটানো ছিল রেগুলেটিং অ্যাক্টের উদ্দেশ্য (a better regulation and management of the affairs of the company both in India and in England)। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আর্থিক নিষ্ক্রমণের হার বেড়েছিল, বাংলা ও বিহারে অর্থনৈতিক দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছিল।
কোম্পানির কর্মচারীরা অবৈধ উপায়ে বহু অর্থ উপার্জন করে ইংল্যান্ডে গিয়ে ‘নবাব’ হয়ে বসেছিল, ইংল্যান্ডের রাজনীতির ওপরে প্রভাব বিস্তারের প্রয়াস চালিয়েছিল। মহীশূর যুদ্ধের জন্য কোম্পানির আর্থিক বোঝা বেড়েছিল, কোম্পানি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করেছিল। সিলেক্ট কমিটি ও সিক্রেট কমিটি (১৭৭২) কোম্পানির কাজকর্ম সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করেছিল। শেয়ারহোল্ডাররা বর্ধিত হারে লভ্যাংশ পেতে থাকে। অ্যাডাম স্মিথ ও অন্যান্যরা কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের তীব্র বিরোধিতা করেন, স্বাধীন বণিকরা ভারতের বাণিজ্যে অংশগ্রহণের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিল। এসবের ফলে রেগুলেটিং অ্যাক্টের পটভূমি তৈরি হয়ে যায়।
তিনটি লক্ষ্য নিয়ে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাশ করা হয়েছিল। (১) ব্রিটিশ সরকার ও কোম্পানির মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করা ছিল এই আইনের প্রথম লক্ষ্য, (২) কোম্পানির ডিরেক্টর সভার পুনর্গঠন করে ভারতের শাসনের ওপর এর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা এবং (৩) ভারতে একটি কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামো গড়ে তোলা যাতে সব ব্রিটিশ উপনিবেশের ওপর এর কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত রেগুলেটিং আইনের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য ছিল।
প্রথমত, এই আইনে কোম্পানির পরিচালক সমিতি ডিরেক্টর সভার সাংগঠনিক পরিবর্তন ঘটানো হয়। নতুন আইনে একহাজার পাউন্ডের শেয়ারহোল্ডারদের শুধু ভোটাধিকার দেওয়া হয়। ২৪ জন ডিরেক্টরের মধ্যে ৬ জন এক বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন, কোনো ব্যক্তি সর্বাধিক চারটি ভোটের অধিকারী হবেন। ডিরেক্টর সভার আয়ুষ্কাল হবে চার বছরের। ইংল্যান্ডে অন্তত দুবছর কাটানোর পর কোম্পানির কোনো কর্মচারী ডিরেক্টর পদের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন। নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেসব দুর্নীতি ছিল এই আইনে সেগুলি দূর করার চেষ্টা হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, বাংলা শাসনের জন্য একজন গভর্নর জেনারেল এবং চারজন সদস্য বিশিষ্ট একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। গভর্নর জেনারেল সংখ্যাগরিষ্ঠের মত নিয়ে চলবেন, কাউন্সিলের সদস্যরা সমানভাবে বিভক্ত হয়ে পড়লে গভর্নর জেনারেল কাস্টিং ভোট দিতে পারবেন। তৃতীয়ত, কলকাতার সুপ্রিম গভর্নমেন্ট অন্যান্য প্রেসিডেন্সির যুদ্ধ ও শান্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন। কলকাতার সুপ্রিম গভর্নমেন্ট ডিরেক্টর সভার নির্দেশ মেনে চলবেন। এই ডিরেক্টর সভা ভারতের শাসন সংক্রান্ত সব তথ্য ব্রিটিশ সরকারকে জানাতে বাধ্য থাকবে।
চতুর্থত, এই আইনে কলকাতায় একটি সুপ্রিম কোর্ট স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। এই কোর্ট ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচার করবে তবে গভর্নর জেনারেল ও তার কাউন্সিলের সদস্যদর বিচারের অধিকার পাবে না। গভর্নর জেনারেল, কাউন্সিলের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের উচ্চ বেতন দানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য করার অধিকার বাতিল করা হয়।
পঞ্চমত, রেগুলেটিং অ্যাক্ট গভর্নর জেনারেল ও তার কাউন্সিলকে শাসনব্যবস্থা স্থাপন ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করতে বলেছিল। রেগুলেটিং অ্যাক্টের কতকগুলি ত্রুটি ছিল। সেজন্য এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। কাউন্সিলে গভর্নর জেনারেলকে বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়নি, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুযায়ী তিনি চলতে বাধ্য ছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে রেগুলেটিং অ্যাক্টে যে চারজন কাউন্সিল সদস্যের নাম ছিল তার মধ্যে তিনজন ক্লেভারিং, মনসন ও ফ্রান্সিস হেস্টিংসের শত্রু ছিলেন, এরা তাঁকে পছন্দ করতেন না। একমাত্র বারওয়েল ছিলেন। হেস্টিংসের বন্ধু। এজন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্মে অচলাবস্থা দেখা দেয়। মনসন ও ক্লেভারিং-এর মৃত্যুর পর গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস কিছুটা স্বস্তি পান। এই আইনে বোম্বে, মাদ্রাজ ও বেঙ্কুলিনের ওপর সুপ্রিম গভর্নমেন্টকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কার্যত এই ক্ষমতা ছিল নেতিবাচক, ইতিবাচক নয় (The Act gives us a mere negative power and no more)।
সুপ্রিম গভর্নমেন্ট কোনো প্রেসিডেন্সির কাজ অপছন্দ হলে তা বাতিল করতে পারবেন, ইতিবাচক প্রস্তাব দিতে পারবেন না। এই আইনের অন্য ত্রুটি হল সুপ্রিম কোর্ট ও সুপ্রিম গভর্নমেন্টের এক্তিয়ার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি, এতে বিরোধের সৃষ্টি হয়। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে একটি সংশোধনী আইন পাশ করে পার্লামেন্ট রেগুলেটিং অ্যাক্টের ত্রুটিগুলি দূর করার প্রয়াস চালিয়েছিল। সংশোধনী আইনে গভর্নর জেনারেলের কার্যাবলিকে সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ারের বাইরে রাখা হয়। বলা হয় রাজস্ব স্থাপন ও সংগ্রহের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। সংশোধনী আইনের আগে সুপ্রিম কোর্ট রাজস্বের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেছিল। সুপ্রিম গভর্নমেন্ট প্রাদেশিক কাউন্সিল ও কোর্টের জন্য আইন প্রণয়নের অধিকার লাভ করেছিল। সংশোধনী আইনে সরকার গভর্নর জেনারেল ও তার কাউন্সিলের পক্ষ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব খর্ব করেছিল। সংশোধনী সত্ত্বেও কোম্পানির সঙ্গে বিরোধীদের সংঘাতের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার ব্যবস্থা এতে ছিল না।
• ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইন
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনের পর থেকে কোম্পানির একচেটিয়া চিন বাণিজ্য ও ভারতের সীমিত একচেটিয়া বাণিজ্যের ওপর আক্রমণ নেমে আসে। ইংল্যান্ডের শিল্প বাণিজ্য জগতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কোম্পানির একচেটিয়া চিন বাণিজ্যের বিরোধিতায় নেমেছিল। এরা মনে করেছিল কোম্পানির একচেটিয়া চিন বাণিজ্যের অবসান ঘটলে ইংল্যান্ডের শিল্প পণ্য অবাধে ঐ দেশে বিক্রি করা সম্ভব হবে।
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনে ব্রিটিশ বণিকদের ভারতে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ দেওয়া হয়, কয়েকটি ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ ছিল। ভারত বাণিজ্য একেবারে অবাধ ও মুক্ত ছিল। না, চায়ের ওপর কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার বজায় ছিল। এদেশে বাণিজ্য করতে হলে ব্রিটিশ বণিকদের ডিরেক্টর সভার অনুমোদন নিতে হত। ইংল্যান্ডের শিল্পপতিরা ও বণিকরা এসব বিধি নিষেধ তুলে দেবার দাবি করেছিল। ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক মহলে এই ধারণা গড়ে উঠেছিল যে, রাজনীতি ও বাণিজ্যকে মেশানোর জন্য ভারতে কোম্পানির শাসন তেমন দক্ষ নয়। বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস গ্রান্ট কোম্পানির বাণিজ্যিক কাজকর্ম বন্ধ করার প্রস্তাব দেন। হাউস অব কমন্সে ভারতীয়দের দেশ শাসনের অধিকার নিয়ে আলোচনা হত।
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনের পটভূমিকায় রয়েছে ইউরোপে নেপোলিয়নের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি, বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের সুযোগ এবং শিল্পবিপ্লবের অগ্রগতি। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতে বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পেশোয়ার রাজ্য, অসম, ব্রহ্মদেশের একাংশ এবং রাজপুত রাজ্যগুলি দখলের পর কোম্পানি কার্যত ভারতে সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত হয়। এই বিশাল দেশ শাসনের ভার কোম্পানির হাতে রাখা উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলেছিল। বাকিংহাম কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতার তীব্র সমালোচনা করেন।
মেকলে অবশ্য মনে করেন ভারতীয়রা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনের উপযুক্ত নয়। তাঁর মতে, ভারতের শাসন ভার কোম্পানির হাতে রাখাই যুক্তিযুক্ত। এইসময় ইংল্যান্ডে হুইগ মন্ত্রীসভা ক্ষমতায় ছিল, এই সময়কালকে বলা হয় হুইগ আদর্শবাদ ও উদারনীতিবাদের জয়যাত্রার যুগ। উপযোগবাদীরা উদারনীতিবাদের সঙ্গে এক নতুন মাত্রা যোগ করে বলেছিল, যে যোগাযোগের উদ্দেশ্য হল শাসিতের মঙ্গল সাধন করা। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে হুইগ সরকার সংস্কার আইন পাশ করে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। হুইগরা আরও কয়েকটি প্রগতিশীল সংস্কার আইন পাশ করেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষ এই উদারনীতিবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। উদারনীতিবাদের প্রবক্তা হিসেবে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে এসেছিলেন।
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্রিটিশ সরকারের সামনে কোম্পানি সম্পর্কিত দুটি প্রশ্ন ছিল। প্রথমটি হল কোম্পানির একচেটিয়া চিন বাণিজ্য বজায় থাকা উচিত কিনা। কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের জন্য ইংল্যান্ডে চায়ের দাম বেড়েছিল, ব্রিটিশ শিল্প পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনে কোম্পানির একচেটিয়া চিন বাণিজ্যের অধিকার বাতিল করা হয়, চিন বাণিজ্য ইংল্যান্ডের শিল্পপতি ও বণিকদের কাছে উন্মুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল কোম্পানি ভারতে শাসক হিসেবে থাকবে কি না। ভারতে কোম্পানির বাণিজ্যিক অধিকার তুলে দেবার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত ছিল না। কিন্তু লর্ড গ্রের সরকার সংস্কার বিল নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে ভারতের শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেবার কথা ভাবেনি। আরও একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এর সঙ্গে যুক্ত ছিল।
কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটলে পৃষ্ঠপোষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, হুইগ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে পারে। এসব কথা বিবেচনা করে হুইগ সরকার কোম্পানিকে ভারতের শাসক হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে এই সিদ্ধান্ত ছিল শর্তাধীন, রাজার প্রতিনিধি হিসেবে কোম্পানি ভারত শাসন করবে আগামী বিশ বছর (১৮৩০-১৮৫৩)। কোম্পানির শেয়ার হোল্ডাররা ভারতের রাজস্ব থেকে ১০.৫ শতাংশ হারে লভ্যাংশ পাবে। বোর্ড অব কন্ট্রোলের সংবিধানে কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়। বোর্ডের সভাপতি ভারত বিষয়ক মন্ত্রীর মর্যাদা পাকেন, তাঁর অধীনে দুজন সহকারী থাকবেন। গোপন নির্দেশ পাঠানোর জন্য আগের মতো সিক্রেট কমিটি থাকবে। সমস্ত শ্রেণির ইংরেজ প্রজা ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবে। মিশনারি ও অন্যান্যদের আইনসংগত কাজ করার পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়।
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনে ভারতে সরকার ও আইনি ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তৃত নির্দেশ দেওয়া হয়। লর্ড মেকলে হাউস অব কমন্সে বলেছিলেন এই আইনের লক্ষ্য হল ভারতের জন্য একটি ভালো শাসনব্যবস্থা গঠন করা (to frame a good government for a country)। তবে তিনি মনে করেন ভারত প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনের উপযুক্ত নয়, ভারতের শাসনভার কোম্পানির হাতে রাখাই বাঞ্ছনীয় । হুইগরা ছিল উদারনীতিবাদী, এই আইনের ওপর উদারনীতিবাদের প্রভাব পড়েছিল। এই আইন অনুযায়ী ভারতের গভর্নর-জেনারেল হন বাংলার গভর্নর, বোম্বে ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি তাঁর অধীনে স্থাপিত হয়। সরকার কেন্দ্রীকরণের নীতি অনুসরণ করেছিল, অর্থ ও আইন প্রণয়নের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপিত হয়। আইন প্রণয়নের জন্য গভর্নর জেনারেলের শাসন পরিষদে আইন সদস্যের পদ তৈরি হয়। আইন নথিবদ্ধ করার জন্য আইন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়। বাংলাকে দুটি প্রেসিডেন্সিতে ভাগ করার প্রস্তাব ছিল, বাংলা শাসনের জন্য একজন ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ করতে বলা হয়। কোম্পানির রাজ্যের সমস্ত রাজস্ব আদায় করা হবে গভর্নর জেনারেলের নামে, অর্থ বরাদ্দ করার পূর্ণ দায়িত্ব থাকবে তার। গভর্নররা বরাদ্দ অর্থ ব্যয় করতে পারবেন।
উদারনীতিবাদের প্রভাবে এই আইনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সরকারি চাকরিতে গ্রহণ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। গভর্নর জেনারেলকে দাস প্রথার কঠোরতা হ্রাস করার জন্য উদ্যোগ নিতে বলা হয়। প্রতিরক্ষা ও বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে রাজার ক্ষমতা আগের মতো অক্ষুণ্ণ ছিল, ব্রিটিশ সরকার এব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এই আইনটি নানাদিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। লর্ড মর্লে মনে * করেন পিটের ভারতশাসন আইন (১৭৮৪) এবং মহারানির ঘোষণার (১৮৫৮) মধ্যবর্তী সময়ে এটি হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কোম্পানির ভারত শাসনের মেয়াদ আরো বিশ বছর বেড়েছিল কিন্তু তার বাণিজ্যিক অধিকার বাতিল হয়ে যায়।
কোম্পানি শুধু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। এই আইন অনুযায়ী ভারতে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসন কাঠামো গঠন করা হয়েছিল। পিটের আইনে কলকাতা কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার যে নীতি অনুসৃত হয় ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের আইনে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। এই আইনে শাসন ও আইনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই আইনে আইন কমিশন ও আইন সদস্যপদ তৈরির প্রস্তাব ছিল। ভারতের জনগণের নৈতিক উন্নতি ও শিক্ষা বিস্তারের দিকে নজর দেওয়া হয়। ভারতীয়দের সকলকে সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। উল্লেখ্য বাস্তবে এই ধারাটি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
এই আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারায় ইংরেজদের ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া হয়। ব্রিটিশ শিল্পপতি ও বণিকদের কাছে ভারত উন্মুক্ত হয়ে যায়। এজন্য এই আইনটিকে ‘Magna Carta of Laissez faire’ বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। ভারতে ব্রিটিশ পুঁজির অবাধ অনুপ্রবেশের পথ সুগম হয়ে যায়। এরপর থেকে ভারতে বিপুল পরিমাণে ব্রিটিশ পণ্যের আমদানি শুরু হয়। এর অভিঘাত পড়েছিল এদেশের হস্ত ও কুটির শিল্পের ওপর। ইংরেজরা ভারতে এসে জমি কিনে চা, কফি, নীল ইত্যাদি বাণিজ্যিক পণ্যের চাষ শুরু করেছিল। ব্রিটিশ ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটে যায়, সাম্রাজ্য ও বাণিজ্যের মধ্যে মেলবন্ধন হয়। মেকলের তথাকথিত ‘ভালো শাসন’ উন্নত শাসনব্যবস্থায় পরিণতি লাভ করেনি। এই আইনে ভারতীয়দের অধিকার ও স্বার্থরক্ষার প্রয়াস লক্ষ করা যায় না। ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে ভারতীয় স্বার্থের মিল ছিল না। ভারতের শাসনব্যবস্থাকে এমনভাবে গঠন করা হয় যাতে এদেশের সম্পদ আহরণে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের কোনো অসুবিধা না হয়। ডিরোজিও পন্থী রসিককৃষ্ণ মল্লিক এই আইনের সমালোচনা করে বলেছিলেন যে ব্রিটিশ পুঁজিপতি ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে এই আইন রচিত হয়েছে। এই বিশাল দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের কল্যাণের জন্য এই আইন তৈরি হয়নি।