StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ গুলি সংক্ষেপে আলোচনা কর

 

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ গুলি সংক্ষেপে আলোচনা কর । 

ভূমিকা : 

অধ্যাপক বিপান চন্দ্র লিখেছেন যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ হয়েছিল কারণ ভারতের জনগণ ব্রিটিশ বিরোধী হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে তারা একটি বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কেন্দ্রে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকবেন মোগল বাদশা, প্রদেশগুলি আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য ভোগ করবে। আঠারো শতকের ভারতে যে ধরনের শিথিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ছিল তারই পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল বিদ্রোহীদের কাম্য। সর্বশ্রেণির ভারতীয়দের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস দেখা দিয়েছিল যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো অসম্ভব নয়।

বলা যায় গোড়া থেকে এই বিদ্রোহের সাফল্য সম্পর্কে নেতাদের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। বিদ্রোহ শুরু হলে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে বিপুল জনগণের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়েছিল। সিপাহিদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ, কৃষক, মজুর, কারিগর স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহীরা দিল্লি অধিকার করে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে হিন্দুস্থানের বাদশাহ বলে ঘোষণা করেছিল। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষিত হয়। যেসব অঞ্চলের মানুষ এই বিদ্রোহে যোগ দেয়নি তারাও আন্তরিকভাবে বিদ্রোহীদের সাফল্য কামনা করেছিল। বিদ্রোহীরা ব্যর্থ হতে থাকলে এদের মধ্যে বিষণ্ণতা নেমে আসে। এককথায় বলা যায় প্রায় সমগ্র ভারতে এই বিদ্রোহ জনসমর্থন লাভ করেছিল।

মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ  : 

নানা কারণে মহাবিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল। বিদ্রোহীদের সাহস, বীরত্ব ও দেশপ্রেমের অভাব ছিল না। মহাবিদ্রোহ ব্যর্থতার সবচেয়ে বড়ো কারণ হল ভারতের সর্বত্র সর্বশ্রেণির মানুষ সক্রিয়ভাবে একে সমর্থন করেনি। ভারতের দেশীয় রাজাদের মধ্যে গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া, ইন্দোরের হোলকার, হায়দ্রাবাদের নিজাম, ভূপালের নবাব, যোধপুরের রাজা, নেপালের রানা এবং অসংখ্য জমিদার বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করেছিল। বিপান চন্দ্রের মতে, এক শতাংশের বেশি জমিদার এই বিদ্রোহে যোগ দেয়নি।

বিদ্রোহ দমনের পর গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং মন্তব্য করেছিলেন যে ভারতীয় রাজারা তাদের সাহায্য না করলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বনাশ হয়ে যেত। মাদ্রাজ, বোম্বে, বাংলা ও পশ্চিম পাঞ্জাব এই বিদ্রোহে শামিল হয়নি। সাধারণভাবে বলা যায় ভারতের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত এই মহাবিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। অযোধ্যা অঞ্চলে জমিদার ও তালুকদাররা বেশি সংখ্যায় এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল, সম্পত্তি ফিরে পাবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে তারা বিদ্রোহ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। এর ফলে অযোধ্যা অঞ্চলে কৃষক ও সিপাহিদের পক্ষে বিদ্রোহ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। গ্রামের কৃষকরা বিদ্রোহের সময় মহাজন ও বণিকদের আক্রমণ করেছিল। এজন্য এই শ্রেণির লোকেরা বিদ্রোহ দমনে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। বাংলার জমিদাররা সরকারের সঙ্গে ছিল, বোম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতার ধনী বণিকরা বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। এর কারণ হল বিদ্রোহের ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

ভারতের সদ্যোজাত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে সমর্থন করেনি। তাদের ধারণা হয়েছিল এই বিদ্রোহের নেতারা মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চান। এই নেতারা ব্রিটিশ প্রবর্তিত সমস্ত রকম আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের বিরোধী। একথা ঠিক বিদ্রোহের নেতারা মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। আধুনিক সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ভারতের প্রথাগত পুরোনো সমাজ ও নেতৃত্বের সঙ্গে আধুনিক ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের দ্বন্দ্ব এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল।

ভারতীয়দের মধ্যে অনৈক্য ছিল, তবে এই অনৈক্য বিদ্রোহের ব্যর্থতার একমাত্র কারণ নয়। বিদ্রোহীদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জাম ইত্যাদির অভাব ছিল। এদেশের প্রথাগত অস্ত্রশস্ত্র তির-ধনুক, বর্শা, তরবারি ইত্যাদি নিয়ে বিদ্রোহীরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছিল। সিপাহি বাহিনীর মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা, সংগঠন ও নিয়মানুবর্তিতার অভাব ছিল। বিদ্রোহীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষিপ্তভাবে লড়াই শুরু করেছিল, এসব বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত সিপাহি বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। এদের না ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, না ছিল কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা। একটিমাত্র লক্ষ্য সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে একই কর্মসূচি অনুসরণ করে এরা লড়াই করতে পারেনি। কোনো অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে কী ধরনের শাসন স্থাপিত হবে সে সম্পর্কে এদের মধ্যে মতৈক্য ছিল না।

বিদ্রোহের নেতারা পরস্পরের প্রতি সন্দেহপরায়ণ ও ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অযোধ্যার বেগম হজরত মহল ফৈজাবাদের মৌলবি আহম্মদ উল্লার সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিলেন। মোগল রাজপুত্রদের সঙ্গে সিপাহি সেনানায়কদের বিরোধ ছিল। নেতাদের স্বার্থপরতা ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বিদ্রোহীদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কৃষকরা বিদ্রোহে যোগ দিয়ে মহা উৎসাহের সঙ্গে রাজস্ব দপ্তরের কাগজপত্র, জমিদার ও মহাজনের নথিপত্র পুড়িয়েছিল, এরপর এরা খানিকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল।

বিদ্রোহের ব্যর্থতার জন্য শুধু কয়েকজন নেতাকে দায়ী করা ঠিক নয়, ব্যর্থতার কারণ ছিল আরও গভীর ও মৌলিক। সমগ্র আন্দোলনটির মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় তো ছিলই না, নেতারা লক্ষ্য হিসেবে কোনো প্রগতিশীল কর্মসূচি তৈরি করতে পারেননি। বিক্ষিপ্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেসব গোষ্ঠী লড়াই করেছিল তাদের মধ্যে একমাত্র ঐক্যসূত্র ছিল ব্রিটিশ বিরোধিতা। এদের মধ্যে নানা বিষয়ে অমিল ছিল। এদের ক্ষোভের কারণ এক ছিল না, স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র কাঠামো নিয়েও মতৈক্য তৈরি হয়নি। বিপ্লবী প্রগতিশীল কর্মসূচি না থাকার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল রাজা ও জমিদাররা এর নেতৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল। এর আগে মোগল, মারাঠা ও শিখরা ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ব্যর্থ হয়েছিল। এই শ্রেণির নেতৃত্ব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রগঠনে সক্ষম হবে এমন আশা ছিল বৃথা।

মূল্যায়ন :

একথা অনস্বীকার্য যে ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য ছিল না, ভারতে তখনও আধুনিক জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়নি। ঐ সময় দেশপ্রেম ছিল একটি ছোটো অঞ্চল বা রাজ্যের প্রতি ভালোবাসা, সর্বভারতীয় চেতনা বা আত্মবোধ তখনও গড়ে ওঠেনি। বলা যায় এই বিদ্রোহ থেকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এইসময় ব্রিটিশ শক্তি ছিল পৃথিবীর সেরা। ভারতে বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, লোকজন ও সাজসরঞ্জাম নিয়ে এসেছিল। শুধু সাহস ও বীরত্ব দিয়ে এরকম শক্তিশালী। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায় না। ব্রিটিশ সেনানায়ক লরেন্স, আউটরাম, হ্যাভলক, নিল, ক্যাম্বেল ও হিউ রোজ আধুনিক সমরবিজ্ঞানকে বিদ্রোহ দমনের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। এসব কারণে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যায়। তবে শুধু ব্যর্থতা নিয়ে এরকম অভ্যুত্থানকে বিচার করা ঠিক নয়। ভারতের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ একটি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর এর গভীর প্রভাব পড়েছিল।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *