1873 সালের পাবনা বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ কর। 1873 সালের পাবনা বিদ্রোহের চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
পাবনা বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র :
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ ছিল বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কৃষকরা ‘এগ্রারিয়ান লিগ’ গঠন করে আইনানুগ পথে জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সম্পন্ন কৃষকদের নেতৃত্বে ভাগচাবি, প্রান্তিক চাষি, ওঠবন্দি প্রজা ও ভূমিহীন কৃষক এতে যোগ দিয়েছিল। জমিদারদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার জন্য তারা একটি তহবিল গঠন করেছিল। জমিদার ও তার আমলারা কোনো অবৈধ কাজ করলে কৃষক সমিতির সদস্যরা সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নিত। যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল না তাদের মধ্যেও প্রচার চালানো হত। পাবনার কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ঈশানচন্দ্র রায়, শম্ভুনাথ পাল ও খুদি মোল্লা। এরা সকলে ছিল সম্পন্ন কৃষক, বিচারালয়ে ও জমিদারের লাঠিয়ালের বিরুদ্ধে এরা নেতৃত্ব দিয়েছিল।
পাবনা বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র নিয়ে একটি বড়ো বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা হলেন অধ্যাপক বিনয় চৌধুরি ও কল্যাণকুমার সেনগুপ্ত। বিনয় চৌধুরি ও সুপ্রকাশ রায় উভয়ে মনে করেন এই বিদ্রোহ ছিল সহিংস, বিদ্রোহীরা হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসাত্মক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরা জমিদারের বাড়ি ও সম্পত্তিও নষ্ট করেছিল, কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। অপরদিকে অধ্যাপক সেনগুপ্ত মনে করেন এই আন্দোলনে অল্পস্বল্প হিংসার প্রকাশ ঘটলেও প্রধানত এটি ছিল আইনানুগ, শাস্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলন।
ইউরোপের কৃষক বিদ্রোহের মতো এই আন্দোলন কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল না। সমকালীন পত্র-পত্রিকা জমিদারদের পক্ষ নিয়েছিল, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে একে সহিংস আন্দোলন বলে দেখিয়েছিল। অধ্যাপক সেনগুপ্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কৃষকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা আনা হয়েছিল তাদের বেশিরভাগ ছিল সাজানো মিথ্যা মামলা। বহু বিদ্রোহী বিনা শাস্তিতে মুক্তি পান, অল্প কয়েকজন লঘু শাস্তি পেয়েছিল। অধ্যাপক সেনগুপ্তের সিদ্ধান্ত হল পাবনা বিদ্রোহ ছিল প্রধানত আইনানুগ কৃষক আন্দোলন, হিংসাত্মক ঘটনা ছিল খুব কম।
জমিদারদের সংগঠন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন জমিদারদের সমর্থন করেছিল, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন ছিল কৃষকের পক্ষে। রমেশচন্দ্র দত্ত এই বিদ্রোহের পর কৃষকের খাজনা স্থায়ীভাবে ধার্য করার আবেদন করেছিলেন। জমিদাররা কৃষকদের হয়রানি করার পথ ধরেছিল, সরকার ভয় পেয়ে শক্তি প্রয়োগ করে বিদ্রোহ দমন করেছিল। তবে এই বিদ্রোহ কখনও ব্রিটিশ বিরোধী রূপ পরিগ্রহ করেনি, জমিদারি উচ্ছেদের দাবিও ওঠেনি। কৃষকরা শুধু নায্য খাজনা ধার্যের দাবি জানিয়েছিল। নিজেদের সম্পত্তির অধিকারের নিরাপত্তা চেয়েছিল, জমিনারের জরিপ ব্যবস্থা, অবৈধ আবওয়াব ইত্যাদি বিলোপের দাবি উঠেছিল। কৃষক আন্দোলনের নেতারা বলেছিলেন যে তাঁরা হলেন মহারানির অনুগত প্রজা। প্রান্তিক ক্ষুদ্র চাষি, ভাগ চাষি ও কৃষি শ্রমিক আন্দোলনে শামিল হলেও এই আন্দোলনের ফলে তারা লাভবান হয়নি। সম্পন্ন কৃষক ও দরিদ্র কৃষকের স্বার্থ এক ছিল না, এদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল শোষক ও শোষিতের। পরবর্তীকালে এদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত ছিল অনিবার্য।
অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিত পাবনা বিদ্রোহের চরিত্র আলোচনা প্রসঙ্গে এধরনের মন্তব্য করেছেন। এই বিদ্রোহের অন্য দিক হল বিতর্কিত সাম্প্রদায়িক চরিত্র—মিদার হিন্দু, প্রজা মুসলমান। বিদ্রোহের নেতারা ছিলেন হিন্দু, প্রজারা মুসলমান হলেও তাঁরা অর্থনৈতিক স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হন। এখানে সাম্প্রদায়িকতা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছিল না, মন্দির অপবিত্র করা বা ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেনি। ধর্ম তাদের ঐক্যবদ্ধ হবার সাহস জুগিয়েছিল। অধ্যাপক সেনগুপ্ত দেখিয়েছেন ফরাজি মতাদর্শ ঐক্যবোধ তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। পাবনার কৃষক আন্দোলন বৃহত্তর কৃষক আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল। ১৮৭৩-১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বগুড়া, বাখরগঞ্জ ও রাজশাহিতে কৃষক বিদ্রোহ হয়, কৃষক সমিতি ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
নীল বিদ্রোহের পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলায় কৃষকদের ওপর জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার নতুন মাত্রা পায়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ‘দশম আইন’-এ কৃষককে জমির মালিকানা ও পাট্টা দেওয়ার কথা থাকলেও জমিদাররা আইন ফাঁকি দিয়ে জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করতে এবং ক্রমাগত খাজনা বৃদ্ধি করতে থাকে। জমির মাপে কারচুপি করেও জমির খাজনা বাড়ানো হয় এবং নতুন নতুন উপকর বসানো হয়। কৃষককে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হয়। ফলে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পাবনার কৃষকরা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কৃষকরা ‘দি পাবনা রায়ত লিগ’ গঠন করে জমিদারকে বেআইনি খাজনা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই লিগ কৃষকদের মামলাগুলি চালাতে থাকে। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ঈশানচন্দ্র রায়, শম্ভুনাথ পাল, ক্ষুদিমোল্লা প্রমুখ। ঈশানচন্দ্র ‘বিদ্রোহী রাজা’ নামে পরিচিত ছিলেন। পাবনার ইউসুফশাহী পরগনায় প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়। এখান থেকে বিদ্রোহ ক্ৰমে সমগ্র পাবনা জেলায় এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজশাহি প্রভৃতি জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ে।
রমেশচন্দ্র দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃম্নকুমার মিত্র, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, লালবিহারী দে প্রমুখ বিদ্রোহীদের সমর্থন করেন। ‘হিন্দু হিতৈষণী’, ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’, ‘সহচর’ প্রভৃতি পত্রিকায় বিদ্রোহের খবরাখবর ছাপা হত | তবে এই বিদ্রোহ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে নয়, মূলত জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। তাই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিদের একাংশ বিদ্রোহীদের সমর্থন করেননি | পুলিশি দমনপীড়ন এবং দুর্ভিক্ষের (১৮৭৩-৭৪ খ্রি.) ফলে বিদ্রোহ ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে।