1902 সালের ইঙ্গ জাপান মৈত্রী চুক্তির পটভূমি আলোচনা কর । ইঙ্গ জাপান মৈত্রী চুক্তির প্রেক্ষাপট। ইঙ্গ জাপান মৈত্রী স্বাক্ষরিত হবার কারণ গুলি আলোচনা করো।
চিন-জাপান যুদ্ধের পর পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়ায় রাশিয়ার আগ্রাসন নতুন উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। চিন-জাপান যুদ্ধে জয়ের ফলে জাপানের আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল, সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। রাশিয়া, জার্মানি ও ফ্রান্সের হস্তক্ষেপের ফলে জাপান শিমনোসেকির সন্ধির সব গ্রহণ করতে পারেনি। এই সন্ধির পর রাশিয়া কোরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছিল। কোরিয়ায় জাপানের কর্তৃত্ব কোরিয়াবাসীদের পছন্দ ছিল না, জাপান এখানে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাজদরবারের ওপর প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। রাশিয়া সেই সুযোগ নিয়ে কোরিয়ায় সৈন্য পাঠিয়ে রাজ পরিবারের ওপর রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি করেছিল।
জাপান কোরিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত বোধ করেছিল, রাশিয়া কোরিয়ার কাছ থেকে কিছু সুযোগসুবিধা আদায় করে নিয়েছিল। জাপান ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সঙ্গে লোবানভ-ইয়ামাগাতা প্রটোকল স্বাক্ষর করে কোরিয়ার ওপর যৌথ অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। কোরিয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধের অবসান হয়নি, ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়া নিয়ে উভয়পক্ষ আবার নিশি-রোজেন কনভেনশন স্বাক্ষর করেছিল। উভয়পক্ষ কোরিয়ার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল, কোরিয়ায় হস্তক্ষেপ করবে না বলে দুই দেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ঠিক হয় জাপান কোরিয়া থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাবে, রাশিয়া বাধা দেবে না।
বক্সার বিদ্রোহের সময় রাশিয়া মাঞ্চুরিয়ায় দু’লক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে ওই প্রদেশটি দখল করে নেয়। রাশিয়া চিনের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে (আলেকসিয়েভ-সেং চুক্তি) মাঞ্চুরিয়ার ওপর একাধিপত্য স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল। কূটনৈতিক চাপ সত্ত্বেও চিন এই গোপন চুক্তি অনুমোদন করেনি। রাশিয়া মাঞ্চুরিয়ায় ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ ও চাইনিজ ইস্টার্ন রেলওয়েজ স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছিল। জার মাঞ্চুরিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন, এই উদ্দেশ্যে কয়েকটি পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। এসব ঘটনা জাপানের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না কারণ মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের স্বার্থ ছিল। বৈদেশিক কূটনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে রাশিয়া মাঞ্চুরিয়া থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছিল কিন্তু সরায়নি। কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়া সংকটের পটভূমিকায় জাপান ইংল্যান্ডের সঙ্গে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
উনিশ শতকের শেষ দিককার ইউরোপের কূটনৈতিক পরিস্থিতি ইঙ্গ-জাপান চুক্তির প্রেক্ষিত তৈরি করে দিয়েছিল। বিসমার্ক জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইতালিকে নিয়ে ট্রিপল এলায়েন্স গঠন করেন। রাশিয়া ও ফ্রান্স দ্বৈত চুক্তি করে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেছিল, ইংল্যান্ড ছিল বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ। এই সময় ইউরোপীয় দেশগুলি ইউরোপে স্থিতাবস্থা বজায় রেখে এশিয়া ও আফ্রিকার দিকে তাকিয়েছিল, সম্প্রসারণের সুযোগ খুঁজেছিল। এটি হল চিন ও আফ্রিকায় সম্প্রসারণের যুগ।
পশ্চিমি দেশগুলি রাশিয়া কর্তৃক মাঞ্চুরিয়া অধিকারকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখেনি, আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের অঙ্গ হিসেবে দেখেছিল। জাপান রাশিয়ার আগ্রাসনে ভয় পেয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে এর ফলে চিনে মুক্তদ্বার নীতি বিপন্ন হয়ে পড়বে। ব্রিটেন মনে করে রাশিয়ার সম্প্রসারণের ফলে চিনের ওপর তার প্রভাব কমবে, মহাপ্রাচীরের দক্ষিণে তার প্রভাব ক্ষুণ্ণ হবে। অপরদিকে রাশিয়াকে মদত দিয়েছিল ফ্রান্স ও জার্মানি। ফ্রান্স ছিল রাশিয়ার চুক্তিবদ্ধ বন্ধু, আর জার্মানি রাশিয়াকে মদত দিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
এই সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়, এই পটভূমিকায় পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে নজিরহীন বন্ধুত্ব হয়। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ড গৌরবজনক নিঃসঙ্গতা (splendid isolation) নিয়ে আর সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় বুয়র যুদ্ধের সময় ..(১৮৯৯-১৯০২) ইংল্যান্ড তার বিচ্ছিন্নতা নীতির বিপদ উপলব্ধি করেছিল। সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা ও বিশ্বে তার মর্যাদা রক্ষার জন্য ইংল্যান্ড বন্ধুর খোঁজ করেছিল। ইংল্যান্ড জার্মানির সঙ্গে বন্ধুত্ব চেয়েছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের সব প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়। ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায় না কারণ ওই দেশটি ছিল রাশিয়ার বন্ধু।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে চায়নি। সুতরাং ইংল্যান্ডের কাছে জাপান ছিল একমাত্র দেশ যার সঙ্গে ইংল্যান্ডের বন্ধুত্ব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। জাপান ছিল রুশ সম্প্রসারণ বিরোধী, আবার নৌশক্তিতে বেশ বলীয়ান (Japan thus became the only possibility, the more attractive because of her naval power and well-known antipathy towards Russia)। জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্বের একটি সামরিক দিক ছিল—রাশিয়া ও ফ্রান্সের নৌবহর ব্রিটেনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। ব্রিটেনের সঙ্গে জাপান যোগ দিলে চিন সাগরে এদের প্রধান্য স্থাপিত হবে। ইংল্যান্ড ভয় পেয়েছিল রাশিয়া রাজধানী পিকিং-এর ওপর আধিপত্য স্থাপন করে ইয়াংসি উপত্যকায় অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে, এই অঞ্চলে ব্রিটিশের ক্ষুণ্ন হবে। বেলজিয়াম পিকিং হ্যানকাও রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগ নিলে ইংল্যান্ড আরও ভয় পেয়েছিল।
রাশিয়ার সঙ্গে তিব্বতের দালাই লামার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলে ইংল্যান্ড ভারতের প্রতিরক্ষা নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এশিয়াতে তার প্রভাব বজায় রাখার জন্য ইংল্যান্ড জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তার বিশাল বিচ্ছিন্ন সাম্রাজ্য, ইউরোপীয় রাজনীতিতে নিঃসঙ্গ তা এবং এশিয়ায় রাশিয়ার আগ্রাসন ইংল্যান্ডকে জাপানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে বাধ্য করেছিল (With a far-flung empire, being isolated in European politics, and facing new Russian threats, Britain could hardly do otherwise) |
জাপানও এসময় বন্ধুর খোঁজ করেছিল কারণ ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে রাশিয়ার সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয়েছিল। জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাটসুরা (Katsura) ইংল্যান্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইটো হিরোবুমি রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক পথে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মেটানোর প্রয়াস চালিয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর লোকেরা মনে করেছিল যে রাশিয়ার সঙ্গে আপস হলেও তা হবে অস্থায়ী, কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়া নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে জাপানের সংঘর্ষ হবে। জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব পড়েছিল ইঙ্গ-জাপান চুক্তি সম্পর্কিত আলোচনার ওপর। ইটো ও তাঁর অনুগামীরা রাষ্ট্রের সব ব্যাপারে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ পছন্দ করেনি, অপরদিকে সামরিক বাহিনী চায়নি ইটো ক্ষমতায় ফিরে আসুক। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ইটো ইঙ্গ-জাপান চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি ইঙ্গ-জাপান চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির প্রস্তাবনায় উভয়পক্ষ পূর্ব এশিয়ায় স্থিতাবস্থা ও শান্তিরক্ষার কথা বলেছিল, চিন ও কোরিয়ার স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষা করার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়, পৃথিবীর সব দেশ এই দুই দেশে বাণিজ্য করার অধিকার ভোগ করবে। দুই দেশ ইংল্যান্ড ও জাপান চিন ও কোরিয়ায় নিজেদের স্বার্থরক্ষা করে চলবে। নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য এরা বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ প্রতিহত করবে। এই দুই দেশের একটি যদি তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তবে অপরপক্ষ নিরপেক্ষ থাকবে। নিরপেক্ষ থেকে অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ যাতে এই যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে তার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু যদি তৃতীয় কোনো দেশ যুদ্ধে যোগ দেয়, বন্ধু রাষ্ট্রটি যুদ্ধে যোগ দেবে। চুক্তির মূল কথা হল জাপান রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে, ফ্রান্স রাশিয়ার পক্ষে যোগ দিলে ইংল্যান্ড জাপানের পক্ষে যোগ দেবে।
এই চুক্তি করে জাপান প্রভূত আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছিল, তার শক্তি ও সামর্থ্য পশ্চিমি দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছিল। রাশিয়া ও ফ্রান্স তাদের দ্বৈত চুক্তি পূর্ব এশিয়ায় প্রযোজ্য বলে ঘোষণা করেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিয়োডর রুজভেল্ট জাপানকে পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার রক্ষক হিসেবে গণ্য করেছিল। জাপান মাঞ্চুরিয়ায় রুশ আগ্রাসন প্রতিহত করবে। এই চুক্তির পর রাশিয়া মাঞ্চুরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
অনেকে মনে করেন এই চুক্তি করে ইংল্যান্ড তার শতাব্দীব্যাপী নিঃসঙ্গতা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। এ. জে. পি. টেলর অবশ্য তা মনে করেন না। তাঁর মতে, এশিয়ার দেশ জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ইউরোপীয় রাজনীতির ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, সেখানে ইংল্যান্ড আগের মতো নিঃসঙ্গ রয়ে যায়। ইঙ্গ-জাপান চুক্তির বিরুদ্ধে চিনের প্রতিক্রিয়া ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চিনের প্রতিক্রিয়ায় ছিল স্বস্তি, লজ্জা ও ভয় (China reacted with a mixture of relief, shame ) স্বস্তি দেখা দিয়েছিল কারণ চুক্তিটি ছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে, চিন ও কোরিয়ার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার কথা বলা হয়েছিল। লজ্জার কারণ হল চিন ও কোরিয়াকে এক পংক্তিভুক্ত করা হয়, চিনের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেয় বিদেশি রাষ্ট্র। ভয়ের কারণ হল চিন মনে করেছিল রাশিয়াকে সরিয়ে জাপান চিনে মুখ্য সাম্রাজ্যবাদীর ভূমিকা গ্রহণ করবে।
ইউয়ান শিকাই রাজদরবারকে জানিয়েছিলেন বিশ্বের সেরা নৌশক্তি পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ স্থলশক্তির সঙ্গে যোগ দিয়েছে। শুধু পূর্ব এশিয়ার নয়, পৃথিবীর শক্তিসাম্য ব্যাহত হতে চলেছে। সংস্কার, শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী, সম্পদ ও আধুনিক শিক্ষা শুধু চিনকে রক্ষা করতে পারে। জাপানকে চিন তার শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। ইংল্যান্ড মনে করে এই চুক্তির ফলে জাপান সংযত আচরণ করবে, খুব উদ্ধত হবে না, আবার খুব নরমপন্থী নীতিও অনুসরণ করবে না। এই চুক্তির পর রাশিয়া মাঞ্চুরিয়া সম্পর্কে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। মাঞ্চুরিয়ায় রাশিয়ার অনুমোদন ছাড়া কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে কোনোরকম সুযোগসুবিধা দেওয়া যাবে না বলে সে দাবি জানিয়েছিল। মাঞ্চুরিয়া শাসনের জন্য জার একজন গভর্নর নিযুক্ত করেন। জাপান কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়া নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়েছিল। উভয়পক্ষ গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধানে পৌঁছোতে পারেনি, যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।