1931 খ্রিস্টাব্দে জাপান কেন মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করেছিল
ভূমিকা :
ওয়াশিংটন সম্মেলনের পর জাপান এক দশক কাল বিস্তারধর্মী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে। এই সময়কার জাপানী শাসকদের পররাষ্ট্র নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করা। কিন্তু কালক্রমে জাপানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গুরুত্ব হারায় ।
রাজনৈতিক কারণ :
জাপানী রাজনীতিতে যুদ্ধবাদী জিঙ্গোবাদী গোষ্ঠীর প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তানাকা আগ্রাসী বিদেশ নীতির সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। নানাবিধ কারণে জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জিঙ্গোবাদীদের প্রভাব বাড়ে এবং সম্প্রসারণবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
অর্থনৈতিক কারণ :
জাপানী জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি দেশে খাদ্যসংকট তৈরি করে। আবাদী জমির স্বল্পতা হেতু এই সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের পূর্বে (১৯৩০ সালে) জাপানের জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৬৪.৫০ মিলিয়নে) দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ চাষযোগ্য জমি নিয়ে জাপান তখন সমসাময়িক ইউরোপীয় দেশগুলির তুলনায় সবচেয়ে জনঘনত্বপূর্ণ দেশ।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে যেখানে প্রতিবর্গ কিলোমিটারে যথাক্রমে ২২৬, ১০৮ এবং ১৮৫ জনের বাস জাপানে সেখানে ৯৬৯ জনের বাস। এই পরিস্থিতিতে কৃষি, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ মাঞ্চুরিয়া ছিল জাপানের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। জাপানের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার বাসস্থান, খাদ্য সরবরাহ ও জাপানী শিল্পপণ্যের বাজার হিসাবে মাঞ্চুরিয়া ছিল অদ্বিতীয়। তাই মাঞ্চুরিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোনরকম আপোসের পক্ষপাতী ছিলনা জাপান। রুশ-জাপান যুদ্ধে জয়লাভের পরেই জাপান দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। জাপান মাঞ্চুরিয়ার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, খনিজ ও বনজ সম্পদের উপর একাধিপত্য কায়েম করে। দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া রেল কোম্পানীকে কেন্দ্র করে জাপানের অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যিক স্বার্থ গড়ে উঠেছিল। তাই মাঞ্চুরিয়ায় রাশিয়া ও চীনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতায় জাপান সদা উদ্বিগ্ন থাকত।
১৯২৯-৩১-এর বিশ্বব্যাপী মহামন্দা অন্যান্য দেশের ন্যায় জাপানের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের রপ্তানি বাণিজ্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। জাপানের রেশম রপ্তানি বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেলে বেকার সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। এই সময় জাপানে বেকারের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৩ মিলিয়নে। শিল্প সংকোচন থেকে যেমন বেকার সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি কৃষির উপর চাপ সৃষ্টি হয়।
কৃষি পণ্যের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় কৃষকের আয় এক তৃতীয়াংশে নেমে আসে। জাপানের এই আর্থিক সংকটের পাশাপাশি মাঞ্চুরিয়ায় চীনা জনসংখ্যা বৃদ্ধি জাপানে আতঙ্ক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। জাপানীরা আশঙ্কিত হয়-যে এর ফলে মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যাহত হবে। তাই জাপান সমগ্র মাঞ্চুরিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। জাপানের এই আর্থিক সংকটের ফলেই জাপানীরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং জিঙ্গোবাদীদের বিস্তারধর্মী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রীও সক্রিয় বিদেশ নীতি অনুসরণ করেন। জাপানে উগ্র সমরবাদের বিস্তার এবং মাঞ্চুরিয়াতে জাপানী কার্যকলাপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। মাঞ্চুরিয়াতে মুক্তদ্বার নীতি অনুসরণে জাপানের অনীহা পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের অর্থনৈতিক স্বার্থকে বিপন্ন করে তুলেছিল। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ মাঞ্চুরিয়ায় জাপানী প্রভাব রোধে অগ্রসর হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনের সাহায্যে মাঞ্চুরিয়াতে রেলপথ বিকাশের পরিকল্পনা বাধাপ্রাপ্ত হলে মার্কিন-জাপান সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই চীনের প্রেসিডেন্ট ইউয়ান শি-কাইকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে এবং রাজতন্ত্র ফিরিয়ে এনে সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত করতে সাহায্য করলে চীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিকভাবেই জাপানের এই আশঙ্কা হয় যে অদূর ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাঞ্চুরিয়ায় জাপানী স্বার্থ নির্মূল করতে এগিয়ে আসবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে জাপানের নৌ তথা সামরিক শক্তি খর্ব করতে তৎপর তা ওয়াংশিংটন সম্মেলনেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। নয়শক্তি চুক্তির মাধ্যমে জাপান চীনের স্বাধীনতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং মুক্তদ্বার নীতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এর ফলে মাঞ্চুরিয়া সমেত সমগ্র চীনে জাপানী আধিপত্য বিস্তারে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে সৃষ্ট এই প্রতিকূল অবস্থাই জাপানকে মাঞ্চুরিয়া আক্রমণে প্ররোচিত করে।
অভ্যন্তরীণ কারণ :
চীনের দিক থেকেও জাপানের কোন স্বস্তি ছিল না। মাঞ্চুরিয়ায় চীনা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়াও চীনা প্রেসিডেন্ট ইউয়ান শি-কাইয়ের চীনকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশে প্রেরিত উত্তরের সামরিক অভিযানের সাফল্য জাপানকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। জাপান বুঝেছিল যে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী চীনের আত্মপ্রকাশ ঘটলে মাঞ্চুরিয়ায় জাপানী স্বার্থ অবশ্যই বিপন্ন হবে। যুদ্ধবাদী সামরিক চক্র কোনভাবেই জাপানী স্বার্থকে খর্ব করতে প্রস্তুত ছিল না, কারণ মাঞ্চুরিয়ায় বিদেশী বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশই জাপানীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। জাপানের রাজনীতিতে যেমন সামরিক গোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধি পায় তেমনি জাপানের সামরিক সংগঠনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পূর্বের সামরিক অফিসারদের মৃত্যু ও পদত্যাগের ফলে সৃষ্ট নতুন সামরিক পদগুলিতে নবীন, মধ্যবিত্ত কৃষক সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়। এই অস্বচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনী আক্রমণাত্মক বৈদেশিক নীতির মাধ্যমেই জাপানের আর্থিক সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন।
জাতিসংঘের মাধ্যমে (League of Nations) সকল সদস্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং স্বাধীনতা বজায় রাখার নীতি (চুক্তিপত্রের দশম অনুচ্ছেদ) গৃহীত হবার ফলে জাপানের আগ্রাসী নীতি ছাড়া শান্তিপূর্ণ উপায়ে মাঞ্চুরিয়ায় স্বার্থ বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক • সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাই খাদ্য ও খনিজ সম্পদে পূর্ণ মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত ‘নেয় কোয়ানটুং (Kwantung) সেনাবাহিনী। কোয়ানটুং ইজারা অঞ্চল এবং দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া রেলপথের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব-প্রাপ্ত কোয়ানটুং সেনাবাহিনীর মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের চরম বিরোধী ছিলেন চ্যাং সো লিন (Chang Tso-tin)। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুন চ্যাং সো-লিন পিকিং-মুকদেন রেলপথ ও দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া রেলপথের সংযোগস্থলে কোয়ানটুং সেনাবাহিনীর বোমার আঘাতে নিহত হন। এই ঘটনায় মাঞ্চুরিয়ায় জাপান-বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয় এবং চীনা জাতীয়তাবাদীরা মাঞ্চুরিয়ায় চীনের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়।
চীন-জাপান সম্পর্ক উত্তরোত্তর খারাপ হতে থাকলে জাপানী নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারেন যে মাঞ্চুরিয়ায় সক্রিয় উদ্যোগ না নিলে সেখানে জাপানী আধিপত্য বিলীন হবে। মাঞ্চুরিয়া অধিগ্রহণ করলেই তবে সেখানে বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা থাকবে না। এই সময় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর মুকদেনের কাছে রেলপথের উপর বোমা বিস্ফোরণ ঘটলে মুকদেনের জাপানী অধিবাসীরা এই ঘটনার দায় একদল চীনা সৈন্যবাহিনীর উপর চাপান। আবার অনেকের ধারণা জাপানী জঙ্গী সেনাদল-ই এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল যাইহোক, এর আগে চীন দস্যুদের হাতে জাপানী সামরিক অফিসার ক্যাপ্টেন নাকামুরা নিহত হলে মাঞ্চুরিয়ার কোয়ানটুং সেনাবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং মাঞ্চুরিয়া আক্রমণে প্ররোচিত করে। এই পরিস্থিতিতে মুকদেনের জাপানী সামরিক নেতৃবৃন্দ কালবিলম্ব না করে সমগ্র মাঞ্চুরিয়ায় সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। সামরিক অভিযান পরিচালনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একথা অনস্বীকার্য যে জাপানের শীর্ষস্থানীয় সামরিক নেতৃবৃন্দ (যেমন ইসিওয়ারা, নাগাটা ইতাগাকি প্রমুখ) মাঞ্চুরিয়ায় জাপানী আধিপত্য বিস্তারের পক্ষে ছিলেন।
জাপানের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সিদেহারা (Sidchara) প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে চীন ও জাপানের মধ্যে এমন কোন সমস্যা নেই যার শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা সম্ভব। এই ঘোষণার একদিন পরেই কোয়ানটুং সেনাবাহিনী মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে। ১৯৩১-এর ২৪শে সেপ্টেম্বর জাপানী সরকার ঘোষণা করে যে আত্মরক্ষার তাগিদেই জাপানী সেনাকে এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। মুকদেনে উপস্থিত ১০ হাজার চীনা সৈন্য জাপানী আক্রমণের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। অতি সহজেই জাপানী সেনারা চীনা সেনাদের নিরস্ত্র ও ছত্রভঙ্গ করে মুকদেনের উত্তরে ২০০ মাইল জুড়ে সবকটি চীনা শহর দখল করে। ২৮শে ডিসেম্বর জাপানী সেনারা চিন চাউ (Chin Chow) দখল করে।
১৯৩২-এর ৪ঠা জানুয়ারী জাপানী সেনা মাঞ্চুরিয়ার সীমান্তবর্তী শানহাইকাওয়ান (Shanhaikwan)-এ উপস্থিত হলে জাপানের মাঞ্চুরিয়া বিজয় অভিযান সম্পূর্ণ হয়। মাঞ্চুরিয়া জয়ের পর জাপান তাকে সাম্রাজ্যভুক্ত না করে মাঞ্চুকুয়ো (Manchukuo) নামক একটি স্বাধীনরাষ্ট্রে পরিণত করে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই মার্চ সৃষ্ট এই স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধান হন চীনের মাঞ্চু বংশের শেষ প্রতিনিধি পু-ঈ। নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও মাঞ্চুকুয়ো কার্যত জাপানের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এদিকে জাপানী সেনা তাদের বিস্তার নীতি অব্যাহত রাখে। তারা অন্তমোঙ্গ লিয়ার জেহোল (Jchol) অঞ্চলটি দখল করে মাঞ্চুকুয়োর আয়তন বৃদ্ধি করে।
মূল্যায়ন:
আধা বছরের মধ্যেই জাপান নিজ দেশের আয়তনের তিনগুণ ভূখণ্ড দখলে সমর্থ হয়। উর্বর কৃষিজমি থেকে এশিয়ার সমৃদ্ধতম খনিজ অঞ্চল জাপানের অধিকারে আসে। অবশেষে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে মার্চ চীন ও জাপান যুদ্ধ-বিরতি স্বাক্ষর করলে চীনে জাপানের সামরিক অভিযান বন্ধ হয়।