ওয়াশিংটন সম্মেলন কেন আহুত হয়েছিল
বিশ শতকের গোড়ার দিকে জাপানি সাম্রাজ্যবাদ অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ড উদ্বেগবোধ করতে থাকে, এরই ফলশ্রুতি হল ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দের ওয়াশিংটন সম্মেলন। এই অঞ্চলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ন’টি দেশ সম্মেলন বসেছিল, দেশগুলি হল চিন, জাপান, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, পর্তুগাল ও হল্যান্ড। প্রধান লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলের সমস্যা বলির মীমাংসা করে রাজনৈতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা ।
রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর নতুন সরকার পূর্ব এশিয়ার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদিও লিগের সদস্য হয়নি এখানকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে সে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। পূর্ব এশিয়ায় জাপান হল উদীয়মান আগ্রাসী শক্তি হার নীতির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সংঘাত ছিল অনিবার্য। চিন হল পূর্ব এশিয়ার রুগ্ন ব্যক্তি, এই বিশাল দেশটি দুর্বল, বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে হাওয়াই ও ফিলিপিন অধিকার করার পর দূরপ্রাচ্য সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছিল। ইঙ্গ-জাপান চুক্তির প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল।
চিন-জাপান যুদ্ধের সময় থেকে (১৮৯৪-৯৫) জাপান পূর্ব এশিয়ায় অভূতপূর্ব দাবিগুলি সাফল্যলাভ করেছিল। জাপান চিন ও রাশিয়াকে পরাস্ত করে, ইংল্যান্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। জাপান আঞ্চলিক শক্তি থেকে বিশ্ব শক্তির স্তরে উন্নীত হয়ে নতুন মর্যাদায় ভূষিত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জাপান চিনের ওপর একুশ দফা দাবি চাপিয়ে দিয়ে অনেক সুযোগসুবিধা আদায় করে নিয়েছিল।
প্যারিস শান্তি সম্মেলনে জাপান নতুন মর্যাদা লাভ করেছিল এবং চিনের অনেকগুলি অঞ্চলের ওপর অধিকার বজায় রেখেছিল। ফরমোজা, কোরিয়া, দক্ষিণ সাখালিন, মাঞ্চুরিয়া ও শানটুং জাপানের অধীনে স্থাপিত হয়। জাপান কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়ায় আধিপত্য স্থাপন করে রেল, বাণিজ্য ও খনি সংক্রান্ত অধিকার লাভ করেছিল। জাপান মঙ্গোলিয়া ও সাইবেরিয়াতেও সম্প্রসারণের প্রয়াস চালিয়েছিল। শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নয়, জাপান চিনের জলপথের ওপর একাধিপত্য স্থাপনের দিকে এগিয়েছিল। সমগ্র উত্তর ও মধ্য চিনের ওপর জাপানের প্রভাব সম্প্রসারিত হয়। জাপান দূরপ্রাচ্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে গিয়েছিল।
বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের আগ্রাসী সম্প্রসারণকে পছন্দ করেনি। চিনে মার্কিন সরকারের নীতি ছিল মুক্তদ্বার, সব দেশ বিনাবাধায় সেখানে বাণিজ্য করবে, চিনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা হবে। মার্কিন সরকারের ধারণা হয় জাপানের অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে মুক্তদ্বার নীতি বাধা পাবে। নানাকারণে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রে জাপানি অভিবাসন সমস্যা তিক্ততা বাড়িয়েছিল। চিন নিয়ে উভয়ের মধ্যে বিরোধ বেধেছিল। আসলে যুক্তরাষ্ট্র চিনের বাজার হাতছাড়া করতে চায়নি, এখান থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ ও মূলধন বিনিয়োগের বিপুল সম্ভাবনা ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব এশিয়ায় রাশিয়াকে তার শত্রু হিসেবে গণ্য করেছিল, রুশ বিপ্লরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে জাপান হল পূর্ব এশিয়ায় স্থিতিশীলতার প্রধান শত্রু। জাপান মাঞ্চুরিয়ায় রেলপথ স্থাপনে উদ্যোগ নিলে ব্রিটেন ও আমেরিকা তাতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল, জাপান রাজি হয়নি। পূর্ব এশিয়ায় ইংল্যান্ডের বিশাল বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল, রাশিয়াকে ইংল্যান্ড তার চিন বাণিজ্য ও ভারত সাম্রাজ্যের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করেছিল। রাশিয়াকে প্রতিহত করার জন্য ইংল্যান্ড জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জাপান ইংল্যান্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল, বিনিময়ে ইংল্যান্ড শান্তি সম্মেলনে জাপানের দাবিকে সমর্থন করে। কিন্তু যুদ্ধের পর জাপান আগ্রাসী হয়ে উঠলে ইংল্যান্ড ভয় পেয়ে যায়, ইংল্যান্ডের উপনিবেশ কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ইঙ্গ-জাপান চুক্তির বিরোধিতা করেছিল।
মূল্যায়ন :
ওয়াশিংটন সম্মেলন আহুত হওয়ার কারণ ছিল, বিশ শতকের গোড়ার দিকে জাপানি সাম্রাজ্যবাদ অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ড উদ্বেগবোধ করতে থাকে, এরই ফলশ্রুতি ছিল ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দের ওয়াশিংটন সম্মেলন।