চিত্রকলার ইতিহাসে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা,
ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর অবদান ।
দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর চিত্র ও ভাস্কর্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ভারতীয় ভাবধারার শিল্পকলার শিক্ষায় অবনীন্দ্রনাথের যোগ্যতম শিষ্য ছিলেন দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের এক সমৃদ্ধ জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। গ্রামীণ সংস্কৃতির বাতাবরণে তিনি পরিণত হয়ে উঠেছিলেন।
গ্রামের দূর্গাপুজায় মূর্তি তৈরির প্রতিটি পর্ব পর্যবেক্ষণ করতে করতে তিনি শিল্পকার্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। তৎকালীন অভিজাত পরিবারগুলির প্রথা অনুযায়ী তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা ও শিল্পচর্চার শুরু হয় বাড়িতে গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। দশ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং তখন থেকেই মূর্তি গড়ার স্বপ্ন, ছবি আঁকার জেদ এবং বড় হওয়ার সংকল্প তাঁর জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পারিবারিক বাধা সত্ত্বেও তিনি শিল্পকলাকেই তাঁর জীবনের মোক্ষ বলে বেছে নেন। আর্জেন্টাইন নামক এক গ্রিক সাহেব ছিলেন তাঁর ছবির প্রথম ক্রেতা।
জীবনের প্রথম দিকে অবনীন্দ্রনাথের কাছে তিনি জলরঙের কাজ শেখেন। ভাস্কর্যে তাঁর প্রথম গুরু ছিলেন হিরন্ময় রায়চৌধুরী। উভয়ের কাছে শিক্ষালাভের সময় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন এবং ভবিষ্যতে চিত্র ও ভাস্কর্য উভয় ক্ষেত্রেই একজন দক্ষ শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। চিত্রাঙ্কনে বিশেষত জলরঙের ক্ষেত্রে চিত্রে ‘ওয়াশ’ পদ্ধতিতে রঙ প্রয়োগের নিপুণতায় তিনি যে পেলবতার সঞ্চার করেছিলেন তা অতুলনীয়। মাদ্রাজে সরকারি চারু ও কারুকলা বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ২৮বছর অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার পর ১৯৫৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে।
দেবীপ্রসাদের চিত্রে নানাধরণের আঙ্গিকের সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু চিত্রাবলী পুরোপুরি ছিল ভারতীয় ভাবধারা ও প্রকরণের অনুসারী। তাঁর আঁকা ছবিগুলির মধ্যে ‘মা ও পূজারিণী’ইউরোপীয় পদ্ধতিতে ভারতীয় ভাবধারার প্রতিফলনে আঁকা ছবি। এছাড়া ‘সূরের নেশা’, ‘আকাশ গঙ্গা’, ‘প্রহরী’, ‘শহরে সন্ধ্যা’, ‘অন্ধ বালক’, ‘ঝড়ের পাখি’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম। পরিণত বয়সে দেবীপ্রসাদের আঁকা ‘সুমাত্রদ্বীপের পাখি’ ছবিটি পঞ্চম জর্জের রাণী মেরি ক্রয় করেছিলেন।
চিত্র ও ভাস্কর্য ছাড়াও কুস্তিগীর হিসেবে, বংশী বাদক হিসেবে, শিকারী হিসেবে, অশ্বারোহী হিসেবে দেবীপ্রসাদের পরিচিতি ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বে ছিল সৌন্দর্যের অনুভূতি শক্তি আর সংবেদনশীলতা। লেখক হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর লেখা ‘বল্লভপুরের পাট’, ‘পিচাশ’, ‘রিক্সাওয়ালা’, ‘পোড়োবাড়ি’ প্রভৃতি পাঠক সমাজে আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনী, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং একাধিক ছবি ‘দেশ’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ললিতকলা আকাদেমির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৫ সালে এই মহান শিল্পীর প্রয়াণ ঘটে।