প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের কারণ গুলি কী ছিল । প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে জাপান কেন পরাজিত হয়েছিল
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর পার্ল হারবার আক্রমণ করে জাপান আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছিল। এর আগে জাপান মালয় আক্রমণ করে তা অধিকার করে নিয়েছিল, মালয়ের প্রাকৃতিক সম্পদ জাপানের দরকার ছিল। এই যুদ্ধে আমেরিকা ৪টি যুদ্ধজাহাজ, তিনটি ডেস্ট্রয়ার ও ১৮০টি যুদ্ধবিমান হারিয়েছিল। এই ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা না করেই আক্রমণ চালিয়েছিল, চিন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাপান এধরনের রণকৌশল আগেই অনুসরণ করেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মতুষ্টি এবং সমস্ত আভাস-ইঙ্গিত অগ্রাহ্য করার প্রবণতা জাপানের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল (There was undoubtedly complacency)। পার্ল হারবারের আক্রমণের আপাতসাফল্য জাপানে বিপুল জাতীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল, এমনকি সম্রাটের প্রাসাদে খুশির হাওয়া বয়ে যায়। সমরবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে একে উন্নতমানের সামরিক পরিকল্পনা বলা যায় না। অন্যান্য রণক্ষেত্রেও জাপান সাফল্য লাভ করেছিল, ফিলিপিনে মার্কিন বিমানবহরের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল, এক সপ্তাহের মধ্যে থাইল্যান্ড অধিকৃত হয়। জাপান গুয়ামের ওপর আক্রমণ চালিয়ে অধিকার করে নিয়েছিল, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আরও অনেকগুলি দ্বীপের গতন ঘটে। হংকং, বোর্নিও ও সিঙ্গাপুর জাপানি অভিযানের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়, ইন্দোনেশিয়া, ম্যানিলা ও বার্মা জাপানিরা অনায়াসে দখল করেছিল।
প্রথম পর্বের যুদ্ধে জাপান জয়ী হয়েছিল দুটি কারণে—মিত্রপক্ষ অন্য রণাঙ্গনে যুদ্ধরত ছিল আর জাপান তীব্র নির্মম আক্রমণ চালিয়েছিল (Initial successes by Japan were in part due to the Allies being occupied in Europe, but in large part also due to the sheer intensity of their attacks)। মিত্রশক্তিবর্গ এই ধরনের তীব্র আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না, পশ্চিমি শক্তিগুলি জাপানের শক্তির যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেনি। হিটলার জাপানের মতো নিম্নমানের জাতির সাফল্যে বিস্মিত হন (inferior people)।
জাপানিরা মনে করে আত্মশক্তি তাদের জয় সম্ভব করেছে। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস হল জাপানি আক্রমণের তীব্রতা এবং তাদের অনায়াস জয় তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। সহজ জয়ের ফলে তাদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে তারা হল দুর্জয়, অজেয়। এই ধারণা গড়ে ওঠার ফলে তাদের রণকৌশলের পরিবর্তন হয়, হঠাৎ তীব্র আক্রমণ চালিয়ে আলোচনার পরিবেশ গড়ে তোলার যে কৌশল তাদের ছিল তার পরিবর্তন ঘটে (A quick blow and then a move for peace) | জাপানিদের নৃশংস আচরণ মিত্রশক্তিবর্গের প্রতিরোধ স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিল, তারা জাপানের পক্ষে সুবিধাজনক শর্তে যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হয়নি। জাপানের অজেয় ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে। ডুলিটলের (Doolittle) নেতৃত্বে মার্কিন বোমারু বিমান টোকিও শহরে আকস্মিকভাবে বোমাবর্ষণ করেছিল, জাপান প্রতিরোধ করতে পারেনি। পরের মাসে কোরাল সি-র যুদ্ধে (Battle of the Coral Sea) জাপানি বাহিনী বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল, তার মনোবল ভেঙে যায়। জাপানের নিউ গিনি আক্রমণের পরিকল্পনা জোর ধাক্কা খেয়েছিল। এই ঘটনার পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মিডওয়ের যুদ্ধে জাপান আবার পর্যুদস্ত হয়।
নৌঅধ্যক্ষ নাগুমোর অধীনস্থ চারখানি বিমানবাহী জাহাজ ও একখানি ক্রুজার জাপান হারিয়েছিল, মারা যায় দু’হাজার নৌসৈনিক। এরপর জাপান এশিয়াতে অনেকগুলি যুদ্ধে জয়ী হয় কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার অবক্ষয়ের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। জাপান অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নিউ ক্যালিডোনিয়া, ফিজি ও স্যামোয়া দখলের পরিকল্পনা বাতিল করেছিল, নিউ গিনি ও গুয়াদাক্যানাল থেকে জাপানি সৈন্য বিতাড়িত হয়েছিল। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাপানের শক্তি ও সম্পদের বিভাজন ও বিস্তার ঘটেছিল (Japanese resources were stretched)। অধিকৃত অঞ্চলে জাপান প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের নীতি অনুসরণ করতে থাকে। ব্রহ্মদেশে ও ফিলিপিনকে নামমাত্র স্বাধীনতা দেওয়া হয়, জাপান এশিয়ার দেশগুলিতে নিজেকে মুক্তিদাতা হিসেবে প্রচার করেছিল। পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ থেকে এশীয়দের মুক্ত করা হল তার লক্ষ্য।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই নভেম্বর টোকিও শহরে মিলিত হয়ে মাঞ্চুরিয়া, চিন, থাইল্যান্ড, বার্মা, ফিলিপিন ও স্বাধীন ভারতের জাপান আশ্রিত নেতারা ‘গ্রেট ইস্ট এশিয়া’ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছিল। হয়তো এসব দেশের নেতারা গোড়ার দিকে জাপানি প্রচারের বিভ্রান্ত হয়ে জাপানকে মুক্তিকামী হিসেবে গ্রহণ করেছিল কিন্তু মোহভঙ্গ হতে বেশি দেরি হয়নি। জাপানি অধিকৃত অঞ্চলে সৈন্যবাহিনীর নিষ্ঠুরতা, জনগণের দুর্দশা ও দুঃখকষ্ট তাদের মোহভঙ্গের কারণ হয়েছিল। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে জাপানে খাদ্যাভাব দেখা দেয়, তরুণীদের জোর করে কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের কাজে লাগানো হয়। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে জাপান নতুন করে সামরিক প্রস্তুতি নিয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধের গতি তার বিরুদ্ধে চলে যায়। চিনে জাপান খানিকটা সাফল্য পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেচুয়ানে মার্কিন বিমানঘাঁটি থেকে আক্রমণ বন্ধ করতে পারেনি। ঐ বছর জুলাই মাসে জাপানের ওপর সবচেয়ে বড়ো আঘাত হল মিত্রশক্তি সাইপান ঘাঁটি দখল করে নিয়েছিল, এখান থেকে টোকিওর ওপর বোমাবর্ষণের সুবিধা হয়। প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধমন্ত্রী এবং সেনাপতিমণ্ডলীর প্রধান তোজো হিদেকি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সাইপান ঘাঁটি হারানোর পর জাপান আত্মরক্ষার কাজকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে জাপানি সামরিক নেতারা উপলব্ধি করেন যে যুদ্ধ জয় প্রায় অসম্ভব ব্যাপার (A Japanese victory was out of the question)। অনেকে সম্মানজনক শর্তে শান্তি চুক্তি করার পক্ষপাতী ছিলেন কিন্তু কেউ সাহস করে সে কথা প্রকাশ্যে বলতে পারেননি, আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার ভয় ছিল। রাশিয়া মিত্রশক্তিবর্গকে আশ্বস্ত করেছিল জার্মানি পরাস্ত হলে সে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে। জাপানি নেতারা বীরত্বের সঙ্গে দেশ রক্ষার লড়াই করে মিত্রশক্তিবর্গের কাছ থেকে সম্মানজনক শর্ত আদায় করতে চেয়েছিল। এরই পরিণতি হল ‘সুইসাইড বোমারু বিমান’ আক্রমণ (কামিকাজ) পরিকল্পনা। ঐ বছর অক্টোবর মাসে ফিলিপিনের লেইট (Leyte) উপসাগরে সবচেয়ে বড়ো নৌযুদ্ধ হয়। জাপান এই নৌযুদ্ধে তার নৌবহর হারিয়েছিল, মিত্রশক্তি ম্যানিলা অধিকার করেছিল।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ব্রিটিশ বাহিনী রেঙ্গুন অধিকার করেছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ওপর নিরন্তর বিমান আক্রমণ চালাতে থাকে, জাপান বাধা দিতে পারেনি (The Japanese really had no answer to these raids)। জাপানের সব শহরের ওপর বিমান আক্রমণ চলতে থাকে, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাস নাগাদ ১৩ মিলিয়ন জাপানি গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। মে মাসে জার্মানি পরাস্ত হলে মিত্রশক্তিবর্গ জাপানের দিকে নজর দিয়েছিল। জাপানের কাছে ওকিনাওয়া ঘাঁটির ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছিল, ওকিনাওয়া তিনমাস যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করেছিল। এই যুদ্ধে দু’লক্ষ ষাট = হাজার জাপানি মারা যায়, এরমধ্যে এক লক্ষ দশ হাজার ছিল সৈন্য। মে মাসের পর জাপানের পরাজয় ছিল অনিবার্য, প্রধানমন্ত্রী সুজুকি আত্মসমর্পণের কথা ভেবেছিলেন কিন্তু সৈন্যবাহিনী শেষপর্যন্ত যুদ্ধ করার পক্ষপাতী ছিল।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মিত্রশক্তিবর্গ পটসডাম সম্মেলনে জাপানকে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছিল, জাপান এই নির্দেশে সাড়া দেয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপান যুদ্ধে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির হিসেবনিকেশ করে আণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ৬ ও ৯ই আগস্ট যথাক্রমে হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল। নাগাসাকির আগের দিন সোভিয়েত রাশিয়া জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, মাঞ্চুরিয়ার ওপর আক্রমণও শুরু করেছিল, এটা ছিল জাপানের পক্ষে আরও বড়ো আঘাত। যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতা জাপানের আর ছিল না, ১৫ই আগস্ট সম্রাট হিরোহিতো বেতারে জাপানের আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করেন। ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় স্বীকার করে মার্কিন সেনাপতি ম্যাকআর্থারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।
জাপানি সেনাপতিমণ্ডলী ও অন্যরা মনে করেছিল অন্যায় যুদ্ধে তারা পরাস্ত হয়েছে, আণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করলে জাপান পরাস্ত হত না, বাস্তব অবস্থা হল প্রথাগত যুদ্ধেও জাপান পরাস্ত হয়েছিল। সম্রাট হিরোহিতো এক পত্রে পুত্র। অকিহিতোকে যুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের কারণগুলি ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর মতে, জাপানের পরাজয়ের প্রথম কারণ হল সামরিক কর্তৃপক্ষ ব্রিটেন ও আমেরিকার শক্তির যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেনি। জাপানিদের পরাজয়ের দ্বিতীয় কারণ হল জাতির আত্মশক্তির ওপর (spirit) অতিমাত্রায় নির্ভরতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়নি। জাপান পরাস্ত হল কারণ উদ্ধৃত সামরিক নেতারা ছিলে। অতিমাত্রায় উদ্ধত ও আগ্রাসী, তারা সর্বদা সম্প্রসারণবাদী মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত হন (Hirohito attributed defeat to an underestimation of Britain and America, to overreliance on spirit as opposed to science, and to arrogant military leaders who only knew how to go forward)।
মূল্যায়ন :
জাপান পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এক বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল কিন্তু তার উচ্চাশা ছিল আকাশচুম্বী। জাপান উচ্চাশার অনুসরণে নিজেকে এতখানি প্রসারিত করেছিল যে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। ভয়ংকর জাতীয় অবমাননা ও অস্থিরতার মধ্যে তার উচ্চাশার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।