StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

হরপ্পা সভ্যতা নগর পরিকল্পনা প্রজেক্ট

হরপ্পা সভ্যতা নগর পরিকল্পনা প্রজেক্ট

 ( Project work)

হরপ্পা সভ্যতা প্রজেক্ট

সূচনা :

নাগরিক জীবনের সম্পূর্ণ পরিপূর্ণতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা ও অন্যান্য কেন্দ্রে হরপ্পা সভ্যতায় স্থাপত্যশৈলীর বিকাশ ঘটেছিল। মূলত নগরকেন্দ্রিক এই সভ্যতার নগর-পরিকল্পনা, শস্যাগার, স্নানাগার, বৃহৎ অট্টালিকা গৃহগুলি এখানকার মানুষের উন্নত স্থাপত্যজ্ঞানের পরিচয় বহন করে।

হরপ্পা সভ্যতার প্রায় প্রতিটি নগরই দুইভাগে বিভক্ত ছিল-উচ্চ-নগর বা সিটাডেল এবং নিম্ন-নগর। উচ্চনগর বা সিটাডেল প্রায় ক্ষেত্রেই আয়তাকার। মহেঞ্জোদাড়োর বৃহৎ স্নানাগার, অ্যাসেম্বলী, শস্যাগার, হরপ্পার শস্যাগার, ধোলাভিরার জলাধারের মত রাষ্ট্রীয় স্থাপত্য এবং অট্টালিকা ইমারতগুলির অবস্থান এই সিটাডেল এলাকার মধ্যেই। অন্যদিকে নিম্ন-নগরে ছিল সাধারণ মানুষের বাড়িঘর এবং মাটি, পাথর, ধাতুর কর্মশালাসমূহের অবস্থান ।

মহেগ্লোদাড়োতে সিটাডেলটি শহরের পশ্চিমদিকে অবস্থিত সমতল থেকে ১২ মিটার উঁচুতে 400×200 মিটার আয়তনবিশিষ্ট। এখানে মাটির তৈরি বেদির উপর যাবতীয় স্থাপত্যগুলি তৈরি হয়েছিল। বেদিটি ইটের তৈরি ৬ মিটার পুরু দেওয়াল বা প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত। এর দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিমে নির্গনপথ এবং দক্ষিণ-পূর্বে গম্বুজ। এই প্রাচীরটি সম্ভবত নিরাপত্তার কারণে দেওয়া হয়েছিল। সিটাডেলের দক্ষিণ দিকে ২৭.৪৪ মিটারের একটি কাঠামো—উত্তরদিকে প্রবেশপথ, চার সারি ইটের মাচার মাধ্যমে সমগ্র কাঠামোটিকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সম্ভবত এটি সভাগৃহ বা বাজার। পূর্বদিকে নিম্ন-নগরের বাইরেও একটি প্রাচীরের চিহ্ন পাওয়া গেছে। নিম্ন নগরের বিন্যাস অনেকটা দাবার ছকের মত।

উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমমুখী বড় রাস্তা আর ভেতরের ছোট ছোট গলি সারা নগরকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করেছে। বড় রাস্তাগুলি ৯-১১ মিটার, ছোট রাস্তাগুলি ১.৫ থেকে ৩ মিটার চওড়া। চানত্দাড়োতে একটি মাত্র ঢিবি–কোনো প্রাকার বা প্রাচীরের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এখানে রাস্তার উপর ইঁটের তৈরি ঢাকা নালি দেখা গেছে। হরপ্পায় আবার একাধিক স্তুপ বা ঢিবি পাওয়া গেছে—পশ্চিমে সিটাডেল, পূর্বে নিম্ন-নগর, সিটাডেলের উত্তর সীমানায় একটি ঢিবি এবং সিটাডেলের দক্ষিণে সমাধিক্ষেত্র—সামতিক আকৃতির সিটাডেলের ইটের তৈরি প্রাচীর, প্রাচীরের মধ্যে বড় বড় গম্বুজ ও দরজা, দুর্গের ভিতরে উঁচু বেদির মত কাঠামো। সিটাডেলের উত্তরের ঢিবিটিও সেখানে প্রাচীরবেষ্টিত। এখানে এক দেওয়াল বিশিষ্ট ১৫ কক্ষে। দুই সারি বিশিষ্ট একটি কাঠামো রয়েছে।

কালিবঙ্গানে সিটাডেলটি পশ্চিমে; এরপর খালি জায়গা, এরপর পূর্বে নগর-নিম্ননগরের পূর্বে একটি ছোট ঢিবি, যেখানে কেবল যজ্ঞবেদি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। সিটাডেলটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় সমানভাগে বিভক্ত, মাঝে প্রাচীর, দক্ষিণ অংশে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। নিম্ন-নগরটিও কাঁচা ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তবে চানাড়ো বা মহেঞ্জোদাড়োর মতো ঢাকা নালি নেই। এখানের বাড়িগুলি শুধু কাঁচা মাটির ইটের তৈরি। সুরকোটাডায় সিটাডেলকে নিম্ন-নগর থেকে আবার আলাদা করা হয়নি। বানোয়ালীতে আবার প্রাচীরবেষ্টিত বসতির পূর্বদিকের দেওয়ালে শহরে প্রবেশের দরজা, সামনে পরিখা ও বেষ্টনী এবং ভেতরে চওড়া দরজা। বসতির মাঝ বরাবর প্রাচীর নগরটিকে সিটাডেল ও নিম্ন-নগরে ভাগ করেছে।

লোথালের সিটাডেলটি আবার চতুর্ভূজাকার-নগরের সিটাডেল অংশে পোড়ামাটির বহু বাড়ি পাওয়া গেছে। লোথালে বন্দর থাকার কারণে নিম্ন-নগরটি উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এবং সিটাডেলটি দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। কোনো কোনো বাড়ি প্রায় ৬ কক্ষবিশিষ্ট সঙ্গে বাথরুম, বারান্দা ও উঠোন। লোথালের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর বা ডকটি পূর্বদিকে অবস্থিত পোড়ামাটির ইঁাঁটের প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত (পূর্বদিকে ২১২ মিটার, পশ্চিমে ২১৫ মিটার উত্তরে ৩৭ মিটার এবং দক্ষিণে ৩৫ মিটার)। বন্দরের পশ্চিমে ১২টি কামরাযুক্ত গুদামঘরের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।

• রাস্তাঘাট

হরপ্পা সভ্যতার প্রায় সব নগরেই রাস্তাঘাট ও অলিগলি পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদাড়োর বড় রাস্তা ৯-১১ মিটার চওড়া; আবার বিভিন্ন কেন্দ্রে মাত্র ১.৮-২ মিটার চওড়া গলিরও সন্ধান পাওয়া গেছে। পূর্বে মনে করা হত, দাবার বোর্ড বা গ্রিড প্যাটার্ন অনুসরণ করে মধ্যবর্তী স্থানে বাড়ি তৈরি করা হত। অধিকাংশ রাস্তা নিজেদেরকে সমকোণে ছেদ করলেও আঁকাবাঁকা গলির ও সন্ধান মিলেছে। তবে বড় রাস্তাগুলি উত্তর-দক্ষিণে এবং ছোটো রাস্তাগুলি পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত ছিল। আলো-বাতাস চলাচলের ক্ষেত্রে নজর রেখেই রাস্তাগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

 • বাড়িঘর 

হরপ্পা সভ্যতার নিম্ন-নগরে নানা আয়তনের বসতবাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদাড়োতে যেমন ২৭ কক্ষ ও উঠোন নিয়ে ৩০০০ বর্গ মিটারের বাড়ির অবশেষ মিলেছে, তেমনি হরপ্পায় মজুরদের থাকার জন্য একাধিক ছোট ছোট কক্ষের সন্ধান পাওয়া গেছে। বানোয়ালীতে একটি বড় বাড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে, যাকে প্রত্নতাত্ত্বিক বিশত ধনী বণিকের বাসগৃহ বলে চিহ্নিত করেছেন। মহেঞ্জোদাড়োতে আবার বাড়িতে সিঁড়ির চিহ্ন এবং মোটা দেওয়াল দ্বিতল বাড়ির সাক্ষ্য বহন করে।

মূলত রোদে পোড়নো কাঁচা ইট ও পোড়া ইঁট স্থাপত্য ও গৃহ নির্মাণে ব্যবহার করা হত। গৃহ নির্মাণে ৭X১৪x২৮ সেমি এবং প্রাকার নির্মাণে ১০x২০x৪০ সেমি আয়তনের ইট ব্যবহার করা হত। দুটি ক্ষেত্রেই ইঁটের আয়তনের অনুপাত ছিল ১ঃ২৪৪। গ্রামীণ কেন্দ্রগুলিতে কাঁচা ইটের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ইট স্থাপন করার জন্য কাদা ও চুন মিশ্রিত কাদা চুন-সুড়কির পরিবর্তে ব্যবহার করা হত। ধোলাভিরায় আবার দুর্গ প্রকারে পালিশ করা গুপ্তের নিদর্শন পাওয়া গেছে। নেঝেতে শক্ত করে পেটাই করা বা বাঁধা মাটি এবং ক্ষেত্রবিশেষে বালির ব্যবহার চোখে পড়ে। তবে গৃহের মধ্যে স্তম্ভ বা খিলানের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না।

ছাদ নির্মিত হত মূলত তৃণ বা বাঁশজাতীয় জিনিসের দ্বারা। দ্বিতল বা ত্রিতল গৃহের মধ্যবর্তী ছাদের জন্য কাঠের বরগার উপর কাঠেরই চওড়া পাটাতন ব্যবহার করা হত। হরপ্পার নগরগুলিতে জানলার ব্যবহার কম, ভেন্টিলেটারের ব্যবহার বিস্ময়কর।

• মহেঞ্জোদাড়োর বৃহৎ স্নানাগার 

মহোঞ্জোদাড়োতে একটি ‘বৃহৎ স্নানাগার’ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর আয়তন ১৪.৫X৭ মিটার, সর্বোচ্চ গভীরতা ২.৪ মিটার। এর উত্তরদিকে সিঁড়ি। জিপসামকে চুন-সুড়কির মত ব্যবহার করে ইটের দেওয়ালগুলি সুন্দরভাবে গাঁথা হয়েছে। দেওয়ালের ও মেঝের প্রান্তে বিটুমিন দিয়ে ওয়াটারপ্রুফ করে তোলা হয়েছে। স্নানাগারের ঢাল দক্ষিণ-পশ্চিমে, যেখানে ছোট নালি দিয়ে জল স্তূপের প্রান্তে গিয়ে পড়ত। স্নানাগারের পশ্চিম দিক ছাড়া সবদিকে ইঁটের তৈরি সারি ও বারান্দা। উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে স্নানাগারের প্রবেশপথ ছিল। পূর্বপ্রান্তে রয়েছে সারিবদ্ধ ঘর। এর একটির মধ্যে স্নানাগারে জল সরবরাহের জন্য কুয়ো ছিল। উত্তরে রয়েছে একটি বাড়ি, যার মধ্যে আটটি ছোট ছোট ঘর বা স্নান করার জায়গা।

স্নানাগারের পূর্বদিকে রাস্তার পাশে ৬৯×২৩.৪ মিটার আয়তনবিশিষ্ট একটি অট্টালিকাসম কাঠামো রয়েছে, যার মধ্যে একাধিক কক্ষ লক্ষ্য করা যায়; রয়েছে ১০ মিটার আয়তন বিশিষ্ট একটি বর্গাকার উঠোন, তিনটি বারান্দা ও দুটি সিঁড়ি। এটিকে পুরোহিতের ধর্মাচরণের স্থল বলে অনুমান করা হয়। 

• শস্যাগার

রাভী নদীর পুরোনো খাতের ধারে হরপ্পার শস্যাগার-১.২২ মিটার উঁচু। এর ভিত উত্তরদিকে। মাঝখানে একটি ৭.০১ মিটার চওড়া ইট দিয়ে বাঁধানোর জায়গা, যা দুই লাইনে ৬টি অংশে (১৫.২৪×৬.১০ মিটার) বিভক্ত মেঝের উপরে ওঠার জন্য ভিতরে নীচ থেকে সিঁড়ি রয়েছে। মহেঞ্জোদাড়োতে স্নানাগারের দক্ষিণ-পশ্চিমে ইঁটের তৈরি ৫০ x২৭ মিটার আয়তনের একটি বেদিকে পরবর্তীকালে শস্যাগার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই কাঠামোতে সম্ভবত কাঠ দিয়ে তৈরি ২৭টি বর্গাকার শস্য রাখার কক্ষ ছিল। একটি সিঁড়ি পাওয়া গেছে, যা নীচে জমি অবধি নেমে গেছে। মার্টিমার হুইলার অবশ্য এটিকে শস্যাগার না বলে মাল তোলার স্থান বলে চিহ্নিত করেছেন। 

• স্নানাগার, শৌচাগার ও পয়ঃপ্রণালী

হরপ্পা সভ্যতার অধিকাংশ বাড়িতে এককভাবে, কখনো বা কয়েকটি বাড়িতে মিলিতভাবে দেওয়াল বরাবর স্নানাগার এবং শৌচাগারের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এগুলির মেঝে ইটের তৈরি ছিল। এগুলি থেকে ঢাল বরাবর ছোট নালা দিয়ে জল বেরিয়ে বড় নালা দিয়ে শহরের বাইরে নির্গত হত। হরপ্পায় প্রচুর বাড়িতে মাটির পাত্র গর্ত করে মেঝেতে ঢোকানো, সঙ্গে জল ঢাকার জন্য লোটা জাতীয় পাত্র পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদাড়োতে সোকপিট এবং হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে টেরাকোটার তৈরি ড্রেন-পাইপের সন্ধান পাওয়া গেছে। ম্যানহোল বা পিটহোল প্রভৃতির অস্তিত্ব প্রমাণ করে, হরপ্পার সভ্যতার অধিবাসীরা পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত ছিল।

• নগরে জলের সরবরাহ

মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, লোথাল, কালিবঙ্গান প্রভৃতি শহরগুলি নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই নদীর জল পানীয় জলের প্রয়োজন মেটাতো। তবে এছাড়াও হরপ্পার নগরগুলিতে পানীয় জলের আরো নানা ধরনের উৎস ছিল। মহেঞ্জোদাড়োতে প্রায় ৭০০টি কুয়ো পাওয়া গেছে। হরপ্পায় খুব বেশি কুয়ো পাওয়া যায়নি। পুরাবিদদের অনুমান, এখানে নগরের কেন্দ্রস্থলে উঁচুস্থানে জল ধরে রাখার ব্যবস্থা ছিল। ধোলাভিরায় ১৬টি বড় বড় জলাধার আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়াও একাধিক নগরে, বিশেষভাবে ধোলাভিরাতে বৃষ্টির জলকে ধরে রাখার জন্য ব্যবস্থার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শর্তুগাই-এর মত কোথাও কোথাও আবার একটু দূরের নদীর খাল কেটে বসতিতে নিয়ে আসার চিহ্ন মিলেছে।

উপসংহার: 

পুরাতত্ত্ববিদ দিলীপ চক্রবর্তী হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলির গঠনে, মান-নির্ণায়ক পরিকল্পনা আর তার সার্থক প্রয়োগের জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। বেদি, ইমারতের কাঠামো, গ্রিড প্যাটার্নের রাস্তা তৈরি এবং বাড়ি নির্মাণের জন্য ব্লক বিন্যাসে, সুসংবদ্ধ পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থায়, দুর্গ ও প্রাচীর গঠনে—এর ছাপ স্পষ্ট। বানোয়ালী বা মহেঞ্জোদাড়োতে নগরের বাইরে পরিখা নির্মাণ রীতি পরবর্তীকালে ভারতের বহু নগরের ক্ষেত্রে অনুসৃত হয়। 

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *