ওয়াশিংটন সম্মেলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা কর
ওয়াশিংটন সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসে ওয়াশিংটন সম্মেলন একটি সফলতম সম্মেলন রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। এক অর্থে এই সম্মেলন প্যারিস শান্তি সম্মেলনকে পূর্ণতা দান করেছিল। সম্মেলন শেষ হলে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্ত থেকে একে স্বাগত জানানো হয়েছিল এর অভাবনীয় সাফল্যের জন্য, বিশেষ করে প্রাক যুদ্ধ পর্বে প্রশান্ত মহাসাগরে যে ভারসাম্য বিরাজ করত তা ফিরিয়ে আনার জন্য। জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষাকে অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূরপ্রাচ্য নীতি সাফল্যমণ্ডিত হয়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিভিন্ন শক্তিবর্গের মধ্যে নৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হ্রাস পায়।
ওয়াশিংটন সম্মেলনে স্বাক্ষরিত সন্ধির বলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ শক্তির মর্যাদা পায়। অন্যদিকে জাপান চীনকে শান্টুং ফিরিয়ে দেখার ফলে দূরপ্রাচ্যে বা পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিরতা ফিরে আসে। রিচার্ড স্টোরী বলেন যেন মনে হচ্ছিল ওয়াশিংটন সম্মেলন দূরপ্রাচ্যে সম্পূর্ণ এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল (It seemed to usher in an entirely new era in the Far East.)। ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্ক বলেছেন যে ওয়াশিংটন সম্মেলনে স্বাক্ষরিত সন্ধিগুলি দূরপ্রাচ্যে আন্তর্জাতিক স্থিরতা প্রদানের এবং রাষ্ট্র তথা ‘nation’ হিসেবে চীনের বিকাশের একটি সম্ভাব্য ভিত রচনা করেছিল । (“The treaties signed at the Washington Conference provided a possible basis for the international stablity in the Far East and for China’s development as a nation.”)।
রিচার্ড স্টোরীর মতে চীন ভার্সাই সন্ধিতে যে সন্তুষ্টি লাভে ব্যর্থ হয়েছিল তা ওয়াশিংটন সম্মেলনে পায় (At Washington China received the satisfaction she failed to obtain at Versailles)। জাপানী প্রতিনিধি শিদেহারা কিছুরো (Shidchara Kijuro) অতিশীঘ্র শান্টুং পরিত্যাগের কথা ঘোষণা করেন এবং চীন ও জাপানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার দ্বারা জাপান শান্টুং-এ কিছু অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়া ২১ দফা দাবির মাধ্যমে প্রাপ্ত বেশিরভাগ স্বার্থই পরিত্যাগ করে। এছাড়া নয় শক্তি চুক্তি দ্বারা চীনের জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা সুরক্ষিত হয়। স্বাক্ষরকারী সব দেশ চীনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।
বাণিজ্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে চীনের সর্বত্র সমান সুযোগ সুবিধা সকলের জন্য প্রশস্ত হয়। ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার এই সম্মেলনকে একটি সফল সম্মেলন রূপে চিহ্নিত করে প্রায় অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে এর ফলে প্রাক্ বিশ্বযুদ্ধ পর্বের রাজনৈতিক ভারসাম্য ফিরে এসেছিল। জাপানের নৌশক্তিকে খর্ব করা হয়েছিল। জাপান অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাপে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নৌ শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নেয় এবং চীনের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সম্মত হয়। অন্যদিকে নাথানিয়েল ফোর (Nathaniel Peffer) এই সম্মেলনকে একটি নীচ গ্রহসন, শূন্যগর্ভ দাবির সমারোহ এবং বিশ্বের আশা-আকাঙ্খার উপহান রূপে বর্ণনা করেছেন।
হার্টম্যান বলেন যে আমেরিকার তিন-চতুর্থাংশ যুদ্ধজাহাজ নিয়ে জাপানের পক্ষে পূর্বা প্রশান্ত মহাসাগরে আগ্রাসন চালানো সম্ভব ছিল না, অন্যদিকে সমগ্র মার্কিন নৌবহর নিয়েও জাপানী নৌ অঞ্চলে আক্রমণ চালানো সম্ভব ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে ওয়াশিংটন সম্মেলনে যে সাফল্য দেখা গিয়েছিল বাস্তবে তা কতটা কার্যকর হবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করেছিল জাপানের সদিচ্ছার উপর। ওয়াশিংটন সম্মেলনে জাপান কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। তাই জাপান অনিচ্ছায় সবকিছু মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। আন্তর্জাতিক দিক থেকে লক্ষণীয় যে এই সময় জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যিক নির্ভরতা বাড়ে।
১৯২০-র দশকে জাপানে মার্কিন রপ্তানি যেমন পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাপানের রপ্তানি তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের প্রধানতম পুঁজি বিনিয়োগকারী দেশ ও জাপানী পণ্যের ক্রেতা হওয়ার ফলে জাপানের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ দিক থেকে জাপানের জঙ্গীবাদকে অনেকাংশে কোণঠাসা করতে সক্ষম হয়েছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাটো (Kato) ও বিদেশমন্ত্রী শিদেহারা (Shidehara)। উদারপন্থী ও বাস্তববাদী এই রাজনীতিবিদরা গণতান্ত্রিক নীতিকে সমর্থন করার পাশাপাশি বুঝতে পেরেছিলেন যে এককভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইঙ্গ-মার্কিন সহযোগিতার বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।
ওয়াশিংটন সম্মেলনের একটি সুনির্দিষ্ট ফল হল ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত ইঙ্গ-জাপান মৈত্রীর চুক্তির অবসান, যা মার্কিন কূটনীতিবিদদের অন্যতম মাথাব্যাথা ছিল। গ্রেট ব্রিটেনও এই চুক্তি থেকে বেড়িয়ে এসে হাল্কা বোধ করছিল। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইঙ্গ-মার্কিন সহযোগিতা বৃদ্ধি পায় এবং পূর্ব এশিয়ায় জাপানী সম্প্রসারণ রোধে কোন বাধা রইল না।
ওয়াশিংটন সম্মেলনের প্রকৃত কৃতিত্ব বিচার করলে দেখা যাবে যে এই সম্মেলন অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছিল। জাপানের জিঙ্গোবাদীরা এই সম্মেলনের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেননি। তারা একে “Stabbing in the back of Japan” অ্যাখ্যা দিয়েছেন। জাপানী শাস্তিবাদীরা দেশে নিন্দিত হন। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা চীনের প্রতি এই আপোসমূলক নীতিকে … Weak kneed China policy” বা দুর্বল হাঁটুর চীনা নীতি আখ্যা দেন। চুক্তি স্বাক্ষরের দশ বছরের মধ্যেই জাপান ওয়াশিংটন সম্মেলনের নির্দেশ লঙ্ঘন করে দূরপ্রাচ্যে হিংসাশ্রয়ী আগ্রাসী নীতি অনুসরণ করে।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করলে সুদূরপ্রাচ্যে শক্তিসাম্য বিনষ্ট হয় এবং এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। এই সম্মেলনের সাফল্য জাপানের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিল, কারণ সম্মেলনের শর্তাবলীকে কার্যকর করার কোন ব্যবস্থা (অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা বলপ্রয়োগ ইত্যাদি) ছিল না। নৌ নিরস্ত্রীকরণ তথা জাপানের বেসামরিকীকরণের প্রয়াসও খুব একটা সফল হয়নি। শুধু বড় যুদ্ধজাহাজ (দশ হাজার টনের বেশি এবং ৩৫ হাজার টনের বেশি ওজন নয়) রাখার ক্ষেত্রে সীমারেখা টানা হলেও, ডুবোজাহাজ, হাল্কা দ্রুতগামী রণপোতের ক্ষেত্রে কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। এই সম্মেলনে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা ছাড়া প্রকৃত নিরস্ত্রীকরণ হয়নি, কারণ বাতিল করা জাহাজগুলি এমনিতেই সাত আট বছরের মধ্যে বাতিল ঘোষিত হত। সত্যি কথা বলতে কি ওয়াশিংটন সম্মেলন জাপান ও আমেরিকা এবং জাপান ও চীনের মধ্যে বিরোধ দূর করতে ব্যর্থ হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই জাপানের সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশগুলির নৌপ্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। চীনের বিষয়েও এই সম্মেলনের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি ছিল আংশিক ও অসম্পূর্ণ। চীনে বিদেশী শক্তিবর্গের অতিরাষ্ট্রিক অধিকার বিলোপ করা যায়নি।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে পিকিং-এ আহূত অতিরাষ্ট্রিকতা কমিশন (Extraterritoriality commission) এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। এই সম্মেলনের পরেও চীনের শুল্ক স্বাধীনতা (tariff autonomy)-র বিষয়টি ঝুলে থাকে। ১৯২৫-২৬-এর আগে শুল্ক সম্মেলন আহ্বান করা সম্ভব হয়নি। এই শুল্ক সম্মেলনেও বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিভিন্ন মতের জন্য এবং চীনে প্রকৃত কেন্দ্রীয় সরকারের অস্তিত্বের অভাবের জন্য কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯২৯ সালের মধ্যে চীন পুরো মাত্রায় শুল্ক স্বাধীনতা ফিরে পাবে— শুধু এই আশা ব্যক্ত হয়। চীনের আর্থিক পুনর্গঠনও খুব একটা সফল হয়নি।
মূল্যায়ন :
ওয়াশিংটন সম্মেলনের সামগ্রিক মূল্যায়ন করে তাই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে এই সম্মেলন আপাতদৃষ্টিতে যতটা সফল দেখা গিয়েছিল বাস্তবে তার চেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছিল। তবুও এই সম্মেলনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাবে না, কেননা এই সম্মেলন অন্তত এক দশক পূর্ব এশিয়াতে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দূর করে বিশ্বকে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করতে সময় দিয়েছিল।