চোল মন্দির স্থাপত্য বিষয়ে একটি রচনা লেখ। চোল মন্দির স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা করো
ভূমিকা :
দক্ষিণ ভারতে পল্লবদের মাধ্যমে স্থাপত্যশিল্পে দ্রাবিড় রীতির প্রচলন ঘটে। চোলদের অধীনে মন্দির স্থাপত্যের দ্রাবিড়শৈলী একটি পরিণত রূপ লাভ করে। পন্ডিতদের একাংশ মতপ্রকাশ করেছেন যে, চোল যুগে মন্দির স্থাপত্যের রূপটি ছিল বিশুদ্ধ হিন্দুশৈলী। চোল স্থাপত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর বিশালত্ব। চোলদের নগরগুলির পরিকল্পনাও ছিল বিশাল। নগরের কেন্দ্রে থাকত মন্দির, প্রধানত শিবমন্দির। এই প্রধান মন্দিরকে ঘিরে চোল নগরগুলি গড়ে উঠত। চোল আমলের মন্দির স্থাপত্যকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়—আদি পর্ব, মধ্যপর্ব, উত্তর পর্ব।
আদি পর্বের ঢোল মন্দির স্থাপত্য :
চোল যুগের আদি পর্বের মন্দিরগুলি ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার এবং এগুলির সঙ্গে পল্লব স্থাপত্যরীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। এইপর্বকে মূলত ‘চোল মন্দির শিল্পের প্রস্তুতি পর্ব’ বলে অভিহিত করা হয়। এই পর্বের মন্দিরগুলিতে পাথরের বহুল প্রয়োগে, উপপীঠের কারুকার্যে, অর্ধস্তম্ভের গঠনে ও উপস্থাপনায় পল্লবশৈলী প্রতিফলিত হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহ ও ক্রমহ্রাসমান তলে বিন্যস্ত বিমানের গঠন পরিণত পল্লবশৈলীর প্রকাশ বলেই পণ্ডিতদের মত। এই পর্বের চোল শিল্পীরা অবশ্য পল্লব যুগের অন্ধ অনুকরণ করেননি। প্রধানত বিমান ও গৌণ মন্দিরগুলির অবস্থানগত বৈচিত্র্যে এবং গর্ভগৃহ ও অর্ধমণ্ডপের অঙ্গসজ্জার পল্লব-উত্তর স্থাপত্যের জড়তা ও নির্জীবতাকে অতিক্রম করার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
আদি-চোল পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত মন্দিরগুলির মধ্যে বিজয়ালয়-চোলেশ্বর মন্দির, শ্রীনিবাসনাপ্লুরের কুরঙ্গনাথের মন্দির, বুদ্ধকোনমের নাগেশ্বর মন্দির, কানুরের বালসুব্রহ্মণ্য মন্দির, তিরকট্টলৈর মন্দির, ব্রহ্মপুরীশ্বর মন্দির প্রভৃতির উল্লেখ করা যায়।
বিজয়ালয় চোলেশ্বর মন্দির :
আদি-চোল পর্বে নির্মিত সর্বপ্রথম মন্দিরটি বিজয়ালয়-চোলেশ্বর মন্দির কুণ্ডুকোট্টই-র অদুরে মেলমলইয়ে অবস্থিত। মন্দিরটির বৃত্তাকার গর্ভগৃহ পল্লব আমলের দ্রাবিড়শৈলীর মন্দিরের সঙ্গে পার্থক্য তৈরি করে। গর্ভগৃহের ব্যস ২.৫৯ মিটার, দৈর্ঘ্য ২.৪৩ মিটার। গর্ভগৃহটি একটি বর্গাকার হল দ্বারা বেষ্টিত যার চারদিকে রয়েছে একটি সংকীর্ণ প্রদক্ষিণ পথ। মন্দিরটির বিমান ও মণ্ডপ একত্রিত হয়ে একটি আয়তক্ষেত্রের রূপ নেয়। দ্রাবিড়শৈলীর এই প্রধান দুটি অংশকে এত সুসংহতভাবে এই মন্দিরে সুসংহত করা হয়েছে, যা বিরল। তবে পল্লব আমলের মন্দিরগুলির মত এই মন্দিরেরও সমতল ছাদটিকে কতগুলি একশিল৷ স্তম্ভ (শীর্ষে স্তূপিকা সহ) ধরে রেখেছে।
মূল মন্দিরকে বেষ্টন করে সাত-সাতটি গৌণ মন্দির নির্মিত হয়েছিল। এই মন্দিরে পল্লব স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় সস্তম্ভ অর্ধ-মণ্ডপ, ক্রমহ্রাসমান তালে বিন্যস্তশীর্ষদেশ এবং শীর্ষস্থ স্তূপিকায়। আবার গর্ভগৃহের পরিকল্পনায়, গর্ভগৃহ ও অর্ধ-মণ্ডপের অঙ্গসজ্জায় এবং মূল মন্দির বা বিমান ও গৌণ মন্দিরগুলির অবস্থানগত বৈচিত্র্যে স্বকীয়তার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। শিল্পীরা এই মন্দিরের মধ্যে দ্রাবিড়শৈলীর পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
শ্রীনিবাসনায়ূরের কুরঙ্গনাথের মন্দির :
প্রথম পরান্তকের রাজত্বকালে নির্মিত এই মন্দিরটি মাঝারি আকৃতির একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। মন্দিরের বর্গক্ষেত্রাকার গর্ভগৃহের প্রতিটি পার্শ্ব ৭.৬২ মিটার দীর্ঘ, গর্ভগৃহের সামনের দিকে ৭.৬২ X ৬.০৯ মিটারের একটি অর্ধ-মণ্ডপ, গর্ভগৃহের উপরে মন্দিরের শীর্ষদেশ ভূমি থেকে ১৫.২৪ মিটার উঁচু। সমগ্র মন্দিরটি একটি মৃত্তিকা গহ্বরের উপর দণ্ডায়মান, যার ভিত্তিস্তর এলাকাটি বক্র হয়ে ক্রমশ উল্টানো পদ্মের আকার নেই। পদ্মাকার এই ভিত্তি থেকে দ্বিতল বিমান ক্রমশ উঁচু হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। মন্দিরটির শীর্ষে অবস্থিত একটি সম্প্রসারিত বর্গাকার ভূপিকা মণ্ডপের বাইরের দেওয়ালগুলির নির্মাণে সরলতা লক্ষ্যণীয় অথচ গর্ভগৃহের ভিতরের ভাস্কর্য নিদর্শন রয়েছে। এর পার্শ্বদেশে অবস্থিত আংশিক প্রলম্বিত চতুষ্কোণ স্তম্ভ। পল্লব শিল্পের অনুকরণে মন্দিরটি নির্মিত হলেও গর্ভগৃহ ও অর্ধ-মণ্ডপের বর্হিঙ্গের অলঙ্করণ এবং স্তম্ভের পরিকল্পনায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এই মন্দিরের সামান্য অলঙ্করণের মধ্যে পরবর্তী চোল রাজাদের অতি অলঙ্কৃত মন্দির স্থাপত্যের পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যায়।
অন্যান্য মন্দির :
কুম্বকোনমের নাগেশ্বর মন্দিরের বিভিন্ন অংশের বিন্যাসের ক্ষেত্রে কুরঙ্গনাথ মন্দিরের অনুরূপ স্থাপত্যশিল্পের সরলীকরণ লক্ষ্য করা যায়। এখানেও বেশ কিছু ভাস্কর্য নিদর্শন সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই মন্দির দু’টি ছাড়াও ব্রহ্মপুরীশ্বর মন্দির স্থাপত্যের অলঙ্করণ বা সৌন্দর্য বেশ যুক্তিবাদী। কুরঙ্গনাথ মন্দিরের উপরের তলার কাঠামোয় ইঁটের ব্যবহার ভবিষ্যতের দ্রাবিড় মন্দির স্থাপত্যের মহান পর্যায়ের আগমনবার্তা বহন করে।
মধ্যপর্বের চোল মন্দির স্থাপত্য:
৯৮৫-১০৭০ খ্রিস্টাব্দ সময়কাল চোল স্থাপত্যের স্বর্ণময় অধ্যায়। এইপর্বে নির্মিত সুবিশাল, সুউচ্চ ও সুদৃশ্য মন্দিরগুলির চোল সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির স্বাক্ষর বহন করে। এইপর্বে চোল স্থাপত্যশিল্পের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। চোল রাজাদের সমৃদ্ধির সূচক হিসেবে মন্দিরগুলির বিরাট আয়তন, বিশাল আকৃতি ও গোপুরম আমাদের বিস্মিত করে। এইপর্বের দু’টি শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি চোলরাজ রাজরাজ কর্তৃক নির্মিত তাঞ্জোরের রাজ-রাজেশ্বর (বৃহদীশ্বর) মন্দির এবং চোল রাজ রাজেন্দ্র চোল নির্মিত গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরমের মন্দির। দুটি মন্দিরের ‘গোপুরম’ বা সিংহদরজাগুলি আকাশছোঁয়া এবং সমগ্র গঠনে অলঙ্কারবহুল ভাস্কর্য লক্ষ্য করা যায়।
তাঞ্জোরের রাজ-রাজেশ্বর (বৃহদীশ্বর) মন্দির :
১০০৩-১০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত রাজ-রাজেশ্বর মন্দিরটি ৫০০X২৫০ ফুট প্রাচীরের ভিতর একটি প্রাঙ্গনে অবস্থিত। বৃহদীশ্বর মন্দিরের মূল আকর্ষণ তার সুউচ্চ বিমান (১৪ তলা, ২০০ ফুট উঁচু)। মন্দিরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সঙ্গতি এবং ছন্দ রেখেই বিমানটি নির্মিত হয়েছিল। এর শিখরের অনুপাতটিও বড় সুন্দর। সবচেয়ে উপরে রয়েছে একটি বিশাল আকৃতির পাথরের তৈরি বৃহৎ ‘স্তূপশীর্ষের অলঙ্করণ’।
মূল গর্ভগৃহের সামনে একটি ‘মহামণ্ডপ’ ও মন্দিরের সামনের প্রাঙ্গনে একটি খোলা মণ্ডপের উঁচু বেদীর উপরে বসা প্রকাণ্ড শিববাহন ষাঁড়ের মূর্তি, মন্দিরের ভিতরের দেবতার দিকে চেয়ে আছে। একখানি ৪৫ ফুট উঁচু আস্ত পাথর কেটে এই মুর্তিটি তৈরি। মন্দিরের বাইরের দিকে দেওয়ালে লাগানো স্তম্ভ আর কার্ণিশের মধ্যে বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত শিবলীলার কাহিনীর নিপুণ ভাস্কর্য খোদিত আছে। মন্দিরটির বিমানের কারুকার্য বর্ণনা করতে গিয়ে পার্সি ব্রাউন বলেছেন— ‘the finest single creation of the Dravidian craftsmen’। বৃহদীশ্বর মন্দির নির্মিত হওয়ার প্রায় ১০০ বছর পরে এই মন্দির প্রাঙ্গণেই ‘সুব্রহ্মণ্যম’ বা কার্তিকের মন্দিরটি নির্মিত হয়। এই মন্দিরের পরিকল্পনা ও গঠনকৌশল অনিন্দ্য। মন্দিরটি বেশি বড় না হলেও এতে চোল স্থাপত্য ও ভাস্কর্য চরম সার্থকতা লাভ করেছে।
গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরমের মন্দির :
গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরমের মন্দিরটি ১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্র চোল কর্তৃক নির্মিত হয় ৷ গঙ্গাইকোণ্ড চোলপুরমের মন্দিরটি ৩৪০X১০০ ফুট প্রাচীরের ভিতরে এক প্রাঙ্গণে স্থাপিত। এই মন্দিরটি ১০০ ফুট চতুষ্কোণ আকৃতিবিশিষ্ট। এর মণ্ডপটির আয়তন ১৭৫×৯৫ ফুট। এই মন্দিরের বিমানটিও অত্যন্ত উঁচু এবং মণ্ডপের সঙ্গে একটি অলিন্দ দ্বারা যুক্ত। মণ্ডপটির সমতল ছাদ ১৫০টি অলঙ্কৃত স্তম্ভের উপর ধরা আছে। মন্দিরে শিবের পৌরাণিক উপাখ্যানগুলির ভাস্কর্যরূপ অতি সুন্দর, প্রাণময় ও সুষম অনুপাতযুক্ত। এই মণ্ডপের মধ্যেই পরবর্তীকালের হাজার থামের দ্রাবিড় মণ্ডপের সূচনা করা যায়। এই মন্দিরের বিমানটি ১৬০ ফুট উঁচু।
মহাকাব্য ও গীতিকবিতার মধ্যে যে পার্থক্য রাজ-রাজেশ্বর মন্দিরের বিমান ও গঙ্গাইকোণ্ড ঢোলপুরম মন্দিরের বিমানের মধ্যে সেইরূপ পার্থক্য বিরাজমান। রাজ-রাজেশ্বর মন্দিরের বিশালতা মহাকাব্যের মত। রাজেন্দ্রের মন্দিরের বিমানের বক্র, কমনীয় ও তরঙ্গায়িত রেখাগুলির মধ্যে আবার যেন ফুটে ওঠে গীতিকবিতার ছন্দ। প্রথমটি শক্তি, পরেরটি সৌন্দর্যের প্রতীক। তবে অলঙ্করণের বাহুল্যের দিক থেকে রাজোন্দ্রের মন্দির অনেক এগিয়ে থাকে। চোল মন্দির দুটির বিশালায়তনের সঙ্গে সূক্ষ্ম অলঙ্করণের যে মিলন ঘটানো হয়েছে তা থেকে অনুমিত হয় চোল শিল্পীরা মন্দির গঠনের পরিকল্পনা করতেন দৈত্যদের মত আর তার নির্মাণকাজ শেষ করতেন সূক্ষ্ম মণিকারের নিপুণতায়।
উত্তর পর্বের চোল মন্দির স্থাপত্য বা চোল-পাণ্ড্য স্তর
চোল স্থাপত্যশিল্পের শেষ পর্যায়টিকে (১০৭০-১২৫০ খ্রিস্টাব্দ) চোল পাণ্ড্য স্তর বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এইসময় চোলদের উপর পাণ্ড্যদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্বে বহু মন্দির নির্মিত হয়। এগুলির মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য মন্দির হল দারাসুরমের ঐরাবতেশ্বর (দ্বিতীয় রাজরাজের আমলে নির্মিত) মন্দির এবং ত্রিভুবনমের ত্রিভুবনেশ্বর মন্দির (তৃতীয় কুলোত্তুঙ্গের আমলে নির্মিত)।
ঐরাবতেশ্বর মন্দিরের গঠনগত সাদৃশ্য পূর্ববর্তী পর্যায়ের বৃহদীশ্বর মন্দিরগুলির মতই, কিন্তু অলঙ্করণের বাহুল্য মন্দিরটিকে স্বাতন্ত্র্য প্রদান করে। দুটি মন্দিরেই মূল মন্দিরের চেয়ে গোপুরমের উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল।
মূল্যায়ন:
চোল মন্দির স্থাপত্যের শেষ পর্বে গোপুরমের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, আয়তন বাড়ে ও অলঙ্করণ আরও কারুকার্যময় হয়ে ওঠে। উত্তর-চোলপর্বে গোপুরমের এই অলঙ্করণ-বাহুল্য মূল মন্দিরের আকর্ষণ বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন করে না। কিন্তু চোলোত্তর পর্বে গোপুরম বিশালত্বে ও জাঁকজমকে মূল বিমানকেও অতিক্রম করে যায়। বিজয়নগরের মন্দির স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যে এর চরম পরিণতি লক্ষ্য করা যায়।
Good job