অজন্তা গুহাচিত্র সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো
ভূমিকা :
শিল্প সৃষ্টির দিক থেকে ভারতের বৌদ্ধ বিহারগুলির মধ্যে অজন্তার স্থান অতি উচ্চে। কারণ অজন্তার গুহাগুলিতে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার একত্র সমাবেশ ঘটেছিল। অজন্তা গুহা অন্ধ্রপ্রদেশের অন্তর্গত জলগাঁও স্টেশন থেকে এর দূরত্ব ৩০ মাইল এবং ঔরঙ্গাবাদ শহর থেকে ৫৫ মাইল (বিশদের জন্য ‘গুহা-স্থাপত্য’, সপ্তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। ঐতিহাসিকদের মতে, খ্রিস্ট-পূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে অজন্তার গুহাগুলি খোদিত হয়েছিল এবং প্রথম থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এখানে চিত্রগুলি অঙ্কিত হয়। এই পর্বে কোনো রাজা হয়তো একটি গুহায় কিছু ছবি অঙ্কন করান এবং কিছু ভাস্কর্য নির্মাণ করান। কোনো কোনো গুহায় আবার প্রথমবার ছবি আঁকার চার-পাঁচশো বছর পরে কিছু ভাস্কর্য সৃষ্টি করা হয়।
অজন্তা সম্পর্কে দেশী-বিদেশী পন্ডিতরা বহু আলোচনা, গবেষণা ও বহু পুস্তক-পুস্তিকা ও অ্যালবাম প্রকাশ করে এটিকে জনসাধারণের মধ্যে সুপরিচিত করে তুলেছেন। এই গুহাগুলির পুনরাবিষ্কারের কাহিনীটিও বেশ চিত্তাকর্ষক। বহুদিন ধরে গভীর বন-জঙ্গলে ঢাকা পড়ায় স্থানীয় লোকেরাও এগুলি সম্পর্কে কিছুই জানত না। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের কয়েকজন সামরিকবিভাগের ইংরেজ কর্মচারি এখানে শিকার করতে এসে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন এবং রাত্রে এই গুহাগুলির একটিতে আশ্রয় নেন। পরদিন ভোরবেলা গুহাগুলি দেখে তাঁরা মুগ্ধ হন ও তাঁদের একজন উইলিয়াম এরিস্কিন এই ঘটনাটি মাদ্রাজ সরকারকে জানান। এইভাবে হঠাৎ অজন্তা গুহা আবিষ্কৃত হলে বিদগ্ধ মহলে আলোড়নের সৃষ্টি হয়।
বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ ড. ফার্গুসন ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে এখানে আসেন এবং ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ‘রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি-তে অজন্তা গুহা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এরপর রওয়ার্ড গিল নামে একজন ইংরেজ চিত্রকরকে অজন্তার ছবিগুলির অনুলিপি করার জন্য প্রেরণ করে। গিল দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অজত্তার সমস্ত ছবিগুলির অনুলিপি প্রস্তুত করে লন্ডনে নিয়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ছবিগুলির সব আগুন লেগে নষ্ট হয়ে যায়। এরপর মুম্বাই আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ গ্রিফিৎস্ তেলরঙে ছবিগুলির অনুলিপি করে দু’খন্ডে অজন্তার চিত্র পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন (১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ)। এরপর লেডি হেরিংহাম কয়েকজন বিখ্যাত ভারতীয় চিত্রশিল্পীকে (নন্দলাল বসু, অসিত হালদার, সমর গুপ্ত প্রমুখ) অজন্তার ছবি আঁকার জন্য প্রেরণ করেন। তাঁরা জলরঙে তাজস্তার ছবিগুলির সুন্দর অনুলিপি প্রস্তুত করেন (১৯০৮-১৯১০ খ্রিস্টাব্দ)।
• অজন্তা গুহাচিত্র
অজন্তার গুহাগুলি জনসাধারণের কাছে প্রচারিত হওয়ার পর এখানে লোকসমাগম আরম্ভ হয় এবং বন-জঙ্গল ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে থাকে। এইসময় চিত্রগুলি আলো, বাতাসের সংস্পর্শে এসে ক্রমে নষ্ট হতে শুরু করে। ছবিগুলি পাথরের দেওয়ালে জল রঙে আঁকা ছিল এবং চিত্রে ব্যবহৃত রঙের সাথে এমন মাল-মশলা মেশানো হয়েছিল যাতে দীর্ঘ সময়েও এগুলি ম্লান হয়ে যায়নি। অজন্তার ছবিগুলি আলো-বাতাসের সংস্পর্শে ক্ষয় পেতে থাকলে এগুলি সংরক্ষণের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পূর্বতন হায়দ্রাবাদের পুরাতত্ত্ববিভাগের পরিচালক গোলাম ইয়াজদানি দু’জন ইটালিয়ান শিল্পী এবং পুরাতন দেওয়ালচিত্র সংরক্ষণবিদ্যায় পারদর্শী অধ্যাপক চিচোনি ও ওরনিনিকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অজন্তা গুহার ছবিগুলিকে সংরক্ষণের ভার দেন। তাঁরা নানাভাবে এই চিত্রগুলিকে সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করেন।
১ নং গুহা :
অজন্তার এই গুহাটি বৈচিত্র্যপূর্ণ শিল্পনৈপুণ্যে পরিপূর্ণ। প্রবেশপথটি ছয়টি কারুকার্য খচিত স্তম্ভের উপর স্থাপিত একটি অলঙ্কৃত ঢাকা বারান্দা দ্বারা মূল কক্ষের সঙ্গে যুক্ত। কক্ষটি ৬৪ ইঞ্চি x ৬৪ ইঞ্চি সমচতুষ্কোণ। গুপ্ত রাজত্বের শেষদিকে অথবা চালুক্য রাজত্বের প্রথমভাগে এটি নির্মিত হয়েছে। এই গুহা শ্রমণদের ক্ষুদ্র কক্ষ দ্বারা বেষ্টিত এবং এর ভিতরের ভাগেও ক্ষুদ্র বুদ্ধমূর্তির কক্ষ আছে। কক্ষের ভিতরের ভাগে প্রতি পাশে ৪টি করে মোট ১৬টি মূল স্তম্ভ এবং চার কোণে চারটি—সর্বমোট ২০টি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। স্তম্ভগুলি একই ধরনের পরিকল্পনা ও ভাস্কর্যরীতিতে নির্মিত।
গুহাটির প্রথমে প্রবেশপথের বিপরীতদিকে মূল কক্ষের পিছনের গর্ভগৃহে বুদ্ধের বিশালাকৃতি মূর্তি রয়েছে। প্রবেশপথের চত্ত্বরের সামনে দুটি স্তম্ভ স্থাপিত আছে। চতুর-বেষ্টনীর প্রাচীরগুলি জাতক কাহিনী দ্বারা অলঙ্কৃত। গর্ভগৃহের অন্ধকার দূর করার জন্য স্থপতি এমনকি অন্তরালবর্তী জানালা নির্মাণ করেছেন, যার নিঃশব্দ পথে আলো বুদ্ধমূর্তিকে আলোকিত করে। প্রত্যেক চৈত্য গুহাতেই একই প্রকার আলো প্রবেশ-কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
প্রত্যেক গুহার একটি মাত্র প্রবেশপথ রয়েছে। এগুলি প্রবেশদ্বারের পাশে বিশালাকৃতি হস্তী, নাগরাজ, দ্বারপাল প্রভৃতি মূর্তি স্থাপিত আছে। ৯ নং গুহা অজন্তার এই গুহাটি সর্বপ্রাচীন। এর দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট ও প্রস্থ ২০ ফুট। গুহাস্থল আয়তাকার, মাঝে একসারি স্তম্ভ আছে। এর নির্মাণকাল খ্রিস্ট-পূর্ব প্রথম শতক বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। স্তম্ভগুলির মাথায় মুকুট বা নীচে পাদপীঠ নেই। গুহার ভিতরে একটি ডাঘোরা বা বুদ্ধস্তূপ এবং এর বিপরীতভাগে গুহায় প্রবেশপথে অশ্বক্ষুরাকৃতি একটি সুন্দর গবাক্ষ সন্নিবিষ্ট আছে। গুহার স্তম্ভ ও প্রাচীরগুলি চিত্রকর্মের জন্য সমতল রাখা হয়েছে এবং সেখানে চিত্রাঙ্কন করা হয়েছে। ১০ নং গুহা ৯ ও ১০ নং উভয় গুহাই হীনযান বৌদ্ধদের দ্বারা নির্মিত হলেও ১০ নং গুহার পরিকল্পনার রীতি স্বতন্ত্র। এটি খ্রিস্ট-পূর্ব দ্বিতীয় শতকে নির্মিত হয়েছে বলে, গুহার সামনে প্রস্তর ফলক পাঠে জানা যায়। ঐতিহাসিক বার্জেস এর নির্মাণকাল খ্রিস্ট-পূর্ব প্রথম শতক বলে চিহ্নিত করেছেন।
১৯ এবং ২৬ নং গুহা :
এই গুহাদুটি মহাযান বৌদ্ধদের দ্বারা নির্মিত। ১৯ নং গুহার প্রবেশপথের তোরণ মূল গুহাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে ক্রমে একটা গাড়ি-বারান্দার মত স্থান সৃষ্টি করেছে। স্তম্ভ, গুহাপ্রাচীর ও নানা স্থান চিত্র-ভাস্কর্যে সুসজ্জিত। কক্ষে ১৫টি স্তম্ভ আছে। এদের পাদপীঠ চারকোনা, পরের অংশ ‘অষ্টপল’ যুক্ত, এর পরের অংশ গোলাকার এবং সর্বশেষ অংশ ক্রুর প্যাঁচের মত আকৃতি নিয়ে মুকুটের নীচে শেষ হয়েছে। মুকুটে বুদ্ধমূর্তি উৎকীর্ণ করে তার উপর ব্রাকেট যুক্ত করে তাতে আবার মূর্তি খোদাই করা হয়েছে। গুহাগুলির স্তূপ (ডাঘোবা) পরিকল্পনায় বুদ্ধের বিবিধ ভঙ্গীর মূর্তি (মহাযানী প্রভাব) স্থাপন করা হয়েছে। এর মহাযান বৌদ্ধস্তূপের উপর ক্রমান্বয়ে তিনটি ছাতা রয়েছে।
২৬ নং গুহা ১৯ নং গুহার অনুরূপ হলেও নির্মাণকাল পরবর্তী এবং শিল্পনৈপুণ্য তুলানামূলক দুর্বল। গুহাটির শিল্পকর্ম অসমাপ্ত। ভাস্করগণ কেন কাজ অসমাপ্ত রাখেন তা জানা যায় না। ১৩নং গুহা এই গুহাটি স্থাপত্য ও শিল্পমান অনুযায়ী সাধারণ বিহার-গুহা। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, এটি বিহার-গুহাগুলির মধ্যে সর্বপ্রাচীন।
১১ নং গুহা :
এই গুহাটি একটি বিহার-গুহা। এর স্তম্ভগুলি পুরানো শিল্পীরীতিতে নির্মিত। সামনের বারান্দায় চারটি স্তম্ভ আছে। স্তম্ভের চারকোণা পাদপীঠ এবং ব্র্যাকেট-সংযুক্ত মুকুট রয়েছে। বারান্দার দুইদিকে একটি করে কপাট। গুহাকক্ষের সামনের ভাগ ৩৭ ফুট প্রশস্ত এবং পর্বতের অভ্যন্তরভাগ ২৮ ফুট গভীর। এখানে চারটি স্তম্ভ রয়েছে। এই স্তম্ভগুলিকে ফার্গুসন *অজন্তা প্রাথমিক রীতির স্তম্ভ’ বলেছে। এর সময়কাল খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের বলে মনে করা হয়। সম্ভবত আদিতে হীনযানী গুহা হলেও পরবর্তীকালে এতে বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করা হয়।
৭ নং গুহা :
এই বিহার-গুহার ৬৩ ফুট x ৩৩ ফুট প্রশস্ত বারান্দাই এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বারান্দার প্রান্তে কতগুলি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এই কক্ষগুলি পেরিয়ে তিনটি স্বতন্ত্র প্রকোেষ্ঠ পাওয়া যায়। এগুলির দৈর্ঘ্য ৮ ফুট। ৮ নং গুহা এই গুহাটি প্রাচীনতম বিহার-গুহা। এর প্রধান কক্ষটি ৩ ফুট প্রশস্ত। কক্ষের উভয় প্রান্তে দু’টি করে প্রকোষ্ঠ রয়েছে। গর্ভগৃহে মূর্তি নেই, শুধু বেদী রয়েছে। এটি সম্ভবত ৯ নং গুহার সমসাময়িক এবং নির্মাণকাল খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দ।
৬ নং গুহা :
এটি অজন্তার একমাত্র দ্বিতল গুহা। বিহাররূপে একে ব্যবহার করা হয়েছিল। বার্জেস বলেন ৪৫০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এটি নির্মিত হয়। ৪ নং গুহা এটি আকৃতি ও আয়তনে সর্ববৃহৎ গুহা। উর্ধ্বভাগ ২৮টি স্তম্ভের উপর বিন্যস্ত।
১৬ নং গুহা :
শিলালিপির ভিত্তিতে এর নির্মাণকাল বিন্ধ্যশক্তি নামক সাতবাহন শাসকের আমলে (৫০০ খ্রিস্টাব্দ) বলে চিহ্নিত করা হয়। এই গুহার শিল্পকার্য অত্যন্ত উন্নত। স্তম্ভগুলি অপরূপ কারুকার্যমন্ডিত। এর গর্ভগৃহে বুদ্ধের একটি বিশাল মূর্তি আছে।
১৭ নং গুহায় ভগবান বুদ্ধের সামনে আশীর্বাদ প্রার্থী মাতা ও পুত্রের চিত্রটিও অনবদ্য। বালকের মুখের সরলতা ও নির্ভীকতা এবং মায়ের মুখের আত্মনিবেদনের ভাবটি এতে বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। এই গুহারই গন্ধর্ব দম্পতির ছবিতে রঙ ও রেখার উৎকর্ষে তাদের আকাশবিহারের যে গতিবেগ প্রকাশ পেয়েছে তা সুষম ও ছন্দময়। রানীর প্রসাধনের চিত্রে আমরা সেযুগের নারীদের সৌন্দর্যচর্চার পরিচয় পায়। রানীর হাতে একটি গোল আয়না, একজন চামঢ়ধারিনী ও থালায় প্রসাধনের দ্রব্য নিয়ে দু’টি দাসী রাণীর পরিচর্যায় ব্যস্ত।
মূল্যায়ন :
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে অজন্তার চিত্রশিল্প অবনতির দিকে ধাবিত হয়। এইসময়ে ১ নং গুহার কিছু অংশ ও ২ নং গুহার চিত্রগুলি আঁকা হয়েছিল। এই ছবিগুলিতে মানুষের দেহের পরিমিতির অভাব চোখে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে মাথাগুলি বড়, পায়ের দিকটি সরু ও দুর্বল এবং কোথাও ছাঁদ-ছন্দহীন মেদবহুল মূর্তিও দেখা যায়। এইপর্বে রঙের বিভিন্নতা ও ঔজ্জ্বল্য অনেক হ্রাস পায় এবং সমস্ত মুখগুলি একই ধরনের হয়ে ওঠে—স্ত্রী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। এইকারণে ছবিগুলি হয়ে পড়ে বৈচিত্র্য ও প্রাণহীন।