চিত্রকলার ইতিহাসে হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা,
ভারতীয় চিত্রকলার নবজাগরণের যুগের এক খ্যাতিমান শিল্পী ছিলেন হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার। আত্মস্থ এই শিল্পী শুধুমাত্র ভারতীয়তার পরিপূর্ণ সাধকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভেদাভেদহীন শাশ্বত শিল্পের প্রকৃত পুজারী।
১৮৯৪ সালে অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় হেমেন্দ্রনাথজন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহ শহরে সিটি স্কুলে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষালাভ করেন। একদিন ক্লাসে শিক্ষক মহাশয়ের ব্যঙ্গচিত্র আঁকার কারণে তাঁকে ভীষণভাবে প্রহার করা হয়। হেমেন্দ্রনাথ এরপর স্কুলের প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে তাঁর পরিবারের লোকজন বাধ্য হয়ে তাকে কলকাতার গভর্নমেন্ট সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দেন। এইসময় আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন পার্সিব্রাউন।
হেমেন্দ্রনাথ আর্ট স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতিতে অসন্তুষ্ট হয়ে আর্ট স্কুল ছেড়ে বেসরকারি ‘জুবলি আর্ট স্কুল’-এ ভর্তি হন। কিন্তু এখানেও তাঁর মন ভরেনি। স্কুল শিক্ষার বাইরে নিভৃতে তিনি ‘অ্যানাটমি’ চর্চায় মনোনিবেশ করেন। অর্থের প্রয়োজনে কিছু ফরমাইসি পোর্ট্রেট এঁকে কিছুটা খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন। বিদেশী শিল্প ও শিল্পীদের বইসহ গভীর চিত্রানুশীলনে আত্মনিবেশ করে এরপর তিনি শিল্পীজীবনের প্রকৃত ছন্দ আবিষ্কার করেন এবং একজন পরিপূর্ণ শিল্পী হয়ে ওঠেন।
১৯২০ সালে মুম্বাইয়ে এক চিত্র প্রদর্শনীতে তিনি প্রথম অংশগ্রহণ করেন এবং ‘স্মৃতি’ (Recollection) ছবির জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯২১ ও ১৯২২ সালে মুম্বাইসহ চেন্নাইয়েও তাঁর শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয় এবং তিনি পুরষ্কৃত হন। এই সময়কালে মুম্বাই, মাদ্রাজ, দিল্লী, কলকাতা, সিমলা সর্বত্র তাঁর ছবি ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। জামনগর, ময়ূরভঞ্জ, কাশ্মীর, পাতিয়ালা, জয়পুর, যোধপুর, বিকানির প্রভৃতি স্থানের মহারাজা তথা রাজন্যবর্গের শ্রদ্ধা ও পৃষ্ঠপোষকতা তিনি লাভ করতে শুরু করেন। তাঁদের অনুরোধে তিনি একাধিক ছবি এঁকে তাঁদের উপহার দেন এবং রাজকীয় বৈভব লাভ করেন।
রাজকীয় বৈভব হেমেন্দ্রনাথকে শিল্পী মানসিকতা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত করতে পারেনি। প্রাপ্ত অর্থ তিনি ব্যক্তিগতে প্রয়োজনে না লাগিয়ে শিল্পের উন্নয়নে ব্যয় করেন। পরিণত বয়সে হেমেন্দ্রনাথ কলকাতায় ইণ্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ্ আর্ট’ নামে একটি চিত্রচর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি যামিনী রায়, অতুল বসু প্রমুখের মত ব্যক্তিত্বকে যুক্ত করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ইডেন গার্ডেন্সে ‘অল ইণ্ডিয়া আর্ট একজিবিশন’-র জন্য হেমেন্দ্রনাথ তাঁরই আঁকা জলরঙের একাধিক ছবি তেলরঙে নতুন করে আঁকার জন্য দিবারাত্র পরিশ্রম করেন। চিত্রকর্মে এইরূপ পরিশ্রমের পরিণতিতে মাইকেল এঞ্জেলোর মত তাঁর শরীর সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে যায় এবং ১৯৪৮ সালে অকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হেমেন্দ্রনাথ পূর্ণভারতীয়তার পুজারী হলেও পাশ্চাত্য রীতিতে ছবি এঁকেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তেলরঙ, জলরঙ, প্যাস্টেল ও চারকোলের সাহায্যে তিনি ইউরোপীয় পদ্ধতিতেও একাধিক ছবি অঙ্কন করেন। নারীদেহ অঙ্কনে তাঁর প্রাজ্ঞতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি সিক্ত বসনাবৃতা নারীদেহ অঙ্কনে অসামান্য প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন। হেমেন্দ্রনাথের কাছে রূপাদর্শ ভাবাদর্শের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল।
তিনি ভারতীয় ঘরানার সংস্কারপন্থী ছিলেন বলেই অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলাল রীতির সাথে তাঁর মতভেদ ছিল। তাঁর চিত্রকর্মে কথা বললেও তাঁর জন্য কোনো প্রকার কোনো ভনিতা বা রাখঢাক তিনি করেননি। ক্যামেরার লেন্সকে হার মানিয়ে তিনি যেসব নারীমূর্তির ছবি আঁকেন তাতে রমণীয়তার সঙ্গে নমনীয়তা ও পেলবতা শিল্পরসিকদের আনন্দ প্রদান করে।
হেমেন্দ্রনাথের আঁকা চিত্রকর্মগুলির মধ্যে ‘নারী’, ‘সিক্তবসনা’, ‘পরিত্যক্তা’, ‘আলতা’, ‘তরঙ্গ’ ইত্যাদি বিখ্যাত। এছাড়াও গ্রামবাংলা নিয়ে তিনি একাধিক ছবি এঁকেছেন। এগুলির মধ্যে ‘কৃষক রমনী’, ‘ধানের ক্ষেত’, ‘বিরহি মঞ্চ’, ‘দুঃখী বালিকা’, ‘ফকির বাউল’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর লেখা শিল্পবিষয়ক একাধিক প্রবন্ধ তৎকালীন বাংলা ও ইংরেজি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।