গুপ্তদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল তা বিশ্লেষণ করো। গুপ্তদের আদি বাড়ি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত নোট লিখুন।
ভূমিকা :
বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরাংশের প্রায় সমগ্র ভারত যে গুপ্ত শাসকদের অধীনে এসেছিল। সেই গুপ্তদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল, এ প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। কয়েকটি পুরাণ, বিশেষত বায়ু ও বিষ্ণুপুরাণ, এই বিষয়টি আলোচনার জন্য মুখ্য উপাদান। এছাড়া, চীনা পর্যটক হুইলুন (আনুমানিক ৬৬৫-৭৫ খ্রিস্টাব্দ) ও ই-সিং (৬৭১-৯৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর বিবরণ এবং শিলালেখ ও মুদ্রা বিশেষ করে প্রারম্ভিক পর্বের গুপ্ত শাসকদের শিলালেখ ও মুদ্রার প্রাপ্তিস্থানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। বস্তুত, গুপ্তদের আদি বাসস্থানের বিষয়টি বেশ বিতর্কিত। এক শ্রেণীর ঐতিহাসিক পূর্বভারতে, বিশেষ করে বাংলার মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলা এবং বিহারের মগধকে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। এই শ্রেণীর পণ্ডিতরা হলেন যথাক্রমে জন অ্যালান, ডি. সি. গাঙ্গুলী, আর. সি. মজুমদার, সুধাকর চট্টোপাধ্যায়, এ. কে. মজুমদার প্রমুখ। অপর এক শ্রেণীর ঐতিহাসিক মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকা, বিশেষ করে এলাহাবাদ, সারনাথ তথা উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশকে বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছেন। এই শ্রেণীর পণ্ডিতরা হলেন, যথাক্রমে এস. আর. গয়াল, পি. এল. গুপ্ত প্রমুখ।
গুপ্তদের আদি বাসস্থান :
গুপ্তদের আদি বাসস্থান প্রসঙ্গে প্রথমেই বায়ুপুরাণে উদ্ধৃত বিবরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। বায়ুপুরাণের এক জায়গায় বলা হয়েছে—
‘অনু-গঙ্গা (গঙ্গম)-প্রয়াগঞ্চ সাকেতং মগধাং স্তথা এতান জনপদান সর্বান ভোকস্যন্তি গুপ্ত বংশজা’ এফ. ই. পার্জিটার উক্ত স্তোত্রটির অর্থ করেছেন নিম্নরূপ : ‘গুপ্তবংশে যে সমস্ত রাজা জন্মগ্রহণ করবেন তাঁরা গাঙ্গেয় অঞ্চল, প্রয়াগ, সাকেত ও মগধ ভোগ করবেন।’ বায়ুপুরাণে উদ্ধৃত এই স্তোত্রের সূত্র ধরে একদিকে যেমন মগধ বা পূর্বভারতে গুপ্তদের আদি বাসস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, অপরদিকে তেমনি প্রয়াগ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশকে গুপ্তদের আদি বাসভূমি হিসাবে গণ্য করার প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়। যাই হোক জন অ্যালান মগধকে গুপ্তদের আদি বাসস্থান হিসাবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী স্তরে অন্যান্য ঐতিহাসিকদের আলোচনা থেকে বোঝা সম্ভব হবে যে এই মতের পক্ষে যুক্তি খুব বেশি জোরালো নয়।
গুপ্তদের আদিবাসভূমি হিসাবে যাঁরা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তাঁদের হাতে অন্যতম প্রধান তথ্য হল চীনা পর্যটক ই-সিং এর বিবরণ, যা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ই-সিং যিনি ৬৭১-৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারত পরিভ্রমণ করেছিলেন তিনি প্রসঙ্গক্রমে এক জায়গায় লিখেছিলেন যে তাঁর পাঁচশো বছর আগে চি-লি-কি-টো নামে একজন রাজা চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং ঐ মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চব্বিশটি গ্রাম দান করেছিলেন। এই মন্দিরটি ‘চীনের মন্দির’ নামে পরিচিত ছিল। তিনি আরো বলেছেন যে ঐ মন্দিরটি অবস্থিত ছিল মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো নামে একটি জায়গায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ই-সিং-এর বিবরণের অনুবাদ এস. বিল ও ই চাবানেস ভিন্ন ভিন্ন ভাবে করেছেন। চাবানেসের অনুবাদ অনুযায়ী মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া পো-নো-র অবস্থান ছিল গঙ্গার তীর ধরে নালন্দার চল্লিশ যোজন বা ২৪০ মাইল পূর্বে।
ই-সিং তাঁর বিবরণে যে রাজা চি-লি-কি-টোর উল্লেখ করেছেন তাকে জন অ্যালান গুপ্ত বংশের প্রথম শাসক মহারাজ গুপ্তের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন। জে. এফ. ফ্রিট চি-লি-কি-টো (শ্রী গুপ্ত)-র সঙ্গে মহারাজ গুপ্তর শনাক্তকরণের বিরোধিতা করেছেন। যদিও তাঁর এই বিরোধিতার বিশেষ যৌক্তিকতা নেই। জন অ্যালান ই-সিং বর্ণিত চি-লি-কি-টোকে যে গুপ্ত বংশের প্রথম নৃপতি মহারাজ গুপ্তের সঙ্গে শনাক্ত করেছেন অন্য একটি দিক থেকে জে. এফ. ফ্লিট তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। ফ্লিটের বক্তব্য হল ই-সিং এর বর্ণনা অনুসারে ৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে পাঁচশো বছর আগে শ্রীগুপ্ত শাসন করেছিলেন বলে যদি ধরে নেওয়া হয় তাহলে তা দাঁড়ায় ১৭৫ খ্রিস্টাব্দে।
৩১১-২০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন আরোহণ ও গুপ্তাব্দের প্রবর্তন ধরে নিলে তার আগে যথাক্রমে ঘটোৎকচ গুপ্ত ও মহারাজ গুপ্তর সময়কাল যদি নির্দিষ্ট করা হয় তাহলে ঐ বংশের প্রথম নৃপতিকে কোনোক্রমেই খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের শেষ পাদের আগে স্থান দেওয়া যায় না। অর্থাৎ ই-সিং-এর বর্ণনার সঙ্গে মহারাজ গুপ্তর সময়কালের ব্যবধান একশো বছর বা তারো বেশি। ফ্লিটের এই আপত্তি আপাতদৃষ্টিতে যতটা সঙ্গত বলে মনে হয় বাস্তবে ততটা নয়। কেননা, বিদেশীয় পর্যটকদের বিবরণ ইতিহাস রচনার কাজে লাগাতে গেলে মনে রাখা দরকার যে বিদেশে এসে লোকমুখে তাঁরা যে তথ্য যোগাড় করেছিলেন তার মধ্যে সাল-তারিখের কিছুটা অসংগতি বা হেরফের থাকা মোটেই অবাস্তব নয়। সুতরাং, মহারাজ গুপ্ত ও ই-সিং-এর বর্ণিত চি-লি-কি-টো যে এক বা অভিন্ন সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।
এখন শ্রীগুপ্ত মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো-তে যে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন তার সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে পারলে গুপ্তদের আদি বাসস্থান সম্পর্কে বোধগম্য হওয়া অনেকটা সহজ হবে। এস্থলে উল্লেখ্য ই. চাবনেসের পাঠ অনুসারে চীনা মি-লি সি-কিয়া-পো-নো-র অর্থ হল মৃগ শিখাবন, কিন্তু অন্য একটি পাঠ অনুসারে চীনা কথাটি হল মি-লি-চিয়া-সি-ত-পো-নো, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় মৃগস্থাপন। ফুচে (Foucher) অবশ্য ই-সিং-এর ‘মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো’রই ভারতীয় অর্থ করেছেন মৃগস্থাপন। আগেই বলা হয়েছে যে ই-সিং-এর যে অনুবাদ ই. চাবানেস করেছেন সেই অনুযায়ী মৃগশিখাবন অবস্থিত ছিল গঙ্গার তীর ধরে ২৪০ মাইল পূর্বে। এ ব্যাপারে ডি. সি. গাঙ্গুলী ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কোয়ার্টারলি জার্নালের চতুর্দশ খণ্ডে লিখিত একটি প্রবন্ধে প্রথম দেখান যে ই-সিং-এর ঐ লিপিবদ্ধ বিবরণ অনুসারে মৃগশিখাবন অবস্থিত ছিল মুর্শিদাবাদে। এইভাবে মুর্শিদাবাদ অর্থাৎ বাংলাকে গুপ্তদের আদি বাসস্থান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন ডি. সি. গাঙ্গুলী।
চীনা বিবরণের পরিপ্রেক্ষিত বাদ দিয়ে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার গুপ্তদের আদি বাসস্থানের ব্যাপারে ডি. সি. গাঙ্গুলীর মতো প্রায় একই সিদ্ধান্তে এসেছেন। তাঁর বক্তব্যের পিছনে প্রধান তথ্য হল ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে কেম্ব্রিজে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির একটি চিত্র। তাঁর সম্পাদিত হিস্ট্রি অব বেঙ্গল-এর প্রথম খণ্ডে তিনি এই বিষয়টি বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তিনি ঐ পাণ্ডুলিপিতে ‘বরেন্দ্রীর মৃগস্থাপনস্তূপ’ লেখা একটি লেবেলের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
উল্লেখ্য, চীনা মি-লি-কিয়া সি-কিয়া-পো-নো শব্দটির মৃগস্থাপন অর্থের সঙ্গে বরেন্দ্রীর ঐ মৃগস্থাপন স্তূপটির সামঞ্জস্যের দিকে লক্ষ রেখে ড. আর. সি. মজুমদার সহ কিছু ঐতিহাসিক মৃগস্থাপনকে বরেন্দ্রীতে নির্দিষ্ট করতে চেয়েছেন। কিন্তু ডি. সি. গাঙ্গুলী যে মুর্শিদাবাদকে গুপ্তদের আদি বাসস্থানের মর্যাদা দিতে চেয়েছেন তা ড. মজুমদারের ঐ তত্ত্বের সঙ্গে ঠিক মেলে না। কেননা, মুর্শিদাবাদ বরেন্দ্রীতে নয়, তা রাঢ় অঞ্চলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রামচরিত-এর প্রণেতা সন্ধ্যাকর নন্দী বরেন্দ্রী বলতে গঙ্গা ও করতোয়া নদীর মধ্যবর্তী ভূ-ভাগকে বুঝিয়েছেন। এমনকি আজও বরেন্দ্রী বলতে বোঝায় মালদহ, দিনাজপুর, রাজশাহী, বোগরা ও রংপুর জেলার বিস্তৃত অঞ্চলকে। সুতরাং, মুর্শিদাবাদকে গুপ্তদের আদি বাসস্থান হিসাবে প্রতিপন্ন করার যে প্রয়াস ডি. সি. গাঙ্গুলী নিয়েছেন তা নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া যায় না।
সুধাকর চট্টোপাধ্যায় তাঁর আর্লি হিস্ট্রি অব নর্থ ইন্ডিয়া গ্রন্থে বায়ুপুরাণ, চীনা বিবরণ ও আর. সি. মজুমদার কর্তৃক উত্থাপিত ‘বরেন্দ্রীর মৃগস্থাপনস্তূপ’—এই বিষয়গুলির ওপর ভিত্তি করে একটু ভিন্ন সিদ্ধান্তে এসেছেন। বাংলাকে তিনি গুপ্তদের আদি বাসভূমি বলে চিহ্নিত করেছেন ঠিকই, কিন্তু ডি. সি. গাঙ্গুলী প্রদত্ত মুর্শিদাবাদের তত্ত্বকে বাতিল করে মালদহকে তিনি ঐ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। অবশ্য মগধকেও তিনি প্রারম্ভিক পর্বের গুপ্তদের শাসনাধীন এলাকার অন্তর্ভুক্ত বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর এই তত্ত্বের সমর্থনে প্রধান যুক্তি হল নালন্দার পূর্বদিকে সরাসরি ২৪০ মাইল গণনা করলে নিঃসন্দেহে মুর্শিদাবাদকে বোঝায়।
কিন্তু যদি ই-সিং-এর প্রদত্ত বিবরণের প্রেক্ষাপটে বিচার করা হয় তাহলে তা নিশ্চিতভাবে মালদহকে নির্দেশ করে। কেননা, বিবরণে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে চীনা পর্যটক প্রথমে নালন্দা থেকে গঙ্গায় গিয়েছিলেন এবং তারপর নদীর মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছিলেন। সুধাকর চট্টোপাধ্যায় তাই বলেছেন ৪০ যোজন বা ২৪০ মাইল গণনা করতে হবে নালন্দা থেকে গঙ্গা পর্যন্ত এবং তারপর গঙ্গার তীর ধরে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে হবে। এইভাবে হিসাব করলে মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো বা মৃগস্থাপন অবস্থিত ছিল মালদহয়। উল্লেখ্য তাঁর এই সিদ্ধান্ত বরেন্দ্রীয় মুগস্থাপন স্তূপের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা, আগের আলোচনা থেকে দেখা গেছে যে মালদহ বরেন্দ্রীর অংশ। এছাড়া পূর্বে উল্লেখিত বায়ুপুরাণে মগধ ও অনুগঙ্গম-এর উল্লেখের সূত্র ধরে তিনি মগধের অংশ বিশেষ ও মালদহকে গুপ্তদের আদি বাসস্থান হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন।
এ. কে. মজুমদারও মনে করেন যে ই-সিং এর বিবরণ অনুযায়ী আদি গুপ্ত শাসক শ্রীগুপ্তর শাসনাধীন এলাকা তথা গুপ্তদের আদি বাসস্থান ছিল বঙ্গের মধ্য বা উত্তরে অবস্থিত। মালদহ না মুর্শিদাবাদ ঠিক স্পষ্ট করে না বললেও তিনি জোরের সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন যে বাংলার অন্তত একটা অংশ শ্রীগুপ্তর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ. কে. মজুমদার আরো বলেছেন যে শ্রীগুপ্তর প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের শেষদিকের শাসকরাও এই বাংলাতে তাঁদের শাসন বজায় রেখেছিলেন। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে গুপ্তদের শক্তির কেন্দ্রস্থল ছিল মগধ।
যাঁরা গুপ্তদের আদি বাসস্থান হিসাবে সারনাথ, প্রয়াগ, তথা উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশকে চিহ্নিত করতে চান তাদের বক্তব্যও যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই এই শ্রেণীর পণ্ডিতর মগব ও বাংলায় গুপ্তদের আদি বাসস্থান তত্ত্বের বিরোধী। বি. পি. সিন্হা, পি. এল. গুপ্ত, প্রমুখ পণ্ডিতেরা সারনাথে গুপ্তদের আদি বাসস্থান নির্ণয় করতে গিয়ে এস. বীন ই-সিং-এর বিবরণের যে অনুবাদ করেছেন তার ওপর জোর দিয়েছেন। এই তত্ত্বে বিশ্বাসী পণ্ডিতর দেখিয়েছেন যে বীল তাঁর অনুবাদে এমন কোনো কথা বলেননি যা থেকে বোঝা সম্ভব, যে মৃগশিখাবন ছিল নালন্দা থেকে নিশ্চিতভাবে ৪০ যোজন পূর্বে অবস্থিত। চীনা বিবরণের সূত্র ধরে এঁদের দ্বিতীয় যুক্তি হল যে ই-সিং-এর বিবরণে বৌদ্ধদের পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান মৃগশিখাবনের উল্লেখ আছে। শুধু তাই নয়, বর্তমান সারনাথের অন্তর্ভুক্ত মৃগদাব বলে পরিচিত এলাকাটি গঙ্গা নদী থেকে খুব দূরবর্তী নয় এবং তা নালন্দার পশ্চিমে অবস্থিত। এই মৃগদাবকে এঁরা চীনা বিবরণের মৃগশিখাবন বলে শনাক্ত করেছেন। এইভাবে এঁরা দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন যে নালন্দার পূর্বদিকে অবস্থিত মৃগশিখাবন বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এমনকি বরেন্দ্রীর মৃগস্থাপন স্তূপের সঙ্গে এর শনাক্তকরণ ঠিক নয় বলে এঁরা মন্তব্য করেছেন।
এস. আর. গয়াল উত্তর-প্রদেশের পূর্বাংশকে গুপ্তদের আদি বাসস্থান হিসাবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে তাঁর হাতে প্রধান তথ্য হল পুরাণের সাক্ষ্য এবং মুদ্রা ও লেখমালার প্রপ্তিস্থান। উল্লেখ্য, বিষ্ণুপুরাণে এক জায়গায় উল্লেখিত একটি স্তোত্রের ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই অংশটি হল ‘অনুগঙ্গা প্রয়াগং মাগধা গুপ্তশ্ ভোকস্যস্তি’ আর. সি. মজুমদার ঐ উদ্ধৃতির অর্থ করেছেন এরকম— ‘গঙ্গার তীর ধরে প্রয়াগ পর্যন্ত অঞ্চল মগধের জনগণ ও গুপ্তশাসকগণ ভোগ করবে।’ ড. মজুমদারের এই অনুবাদের সূত্র ধরে এস. আর. গয়াল সিদ্ধান্তে এসেছেন যে মগধের পশ্চিম দিক থেকে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে প্রয়াগ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল প্রথমদিকের গুপ্ত শাসকগণ কর্তৃক শাসিত হয়েছিল।
পুরাণের ঐ সাক্ষ্য ছাড়াও এস. আর. গয়াল মুদ্রা ও লেখ-র প্রাপ্তিস্থানের ওপর ভিত্তি করে দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন যে গুপ্তদের আদি বাসস্থান ছিল উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি দেখিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে, বিশেষ করে লক্ষ্ণৌ, মথুরা, গাজিপুরেই প্রথম চন্দ্রগুপ্ত-কুমারদেবী ধরনের মুদ্রাগুলি পাওয়া গেছে। এছাড়া গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার চোদ্দোটি ভাণ্ডার পাওয়া গেছে উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশে। এই স্থানগুলি হল ভারসার (বারাণসী), তা (ফৈজাবাদ), কোটওয়া (গোরখপুর), এলাহাবাদ, বস্তি, কসরব, টেকরি-ডেব্রা (মীর্জাপুর), মদনকোলা (জৌনপুর), গোপালপুর, ঝুসি, রাপ্তি, দেবথ (বালিয়া) কুগুপ্তি।
বিহার ও বাংলায় যেগুলিকে এক শ্রেণীর পণ্ডিত গুপ্তদের আদি বাসভূমি বলে চিহ্নিত করেছেন সেগুলিতে পাওয়া গেছে মাত্র দুটি করে ভাণ্ডার। যদি লেখমালার প্রাপ্তিস্থানের দিক থেকে বিচার করা হয় তাহলেও দেখা যাবে যে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর গোড়া থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে শিলালেখ পাওয়া গেছে আটটি। অপরদিকে মগধে মাত্র দুটি ও বাংলায় পাঁচটি পাওয়া গেছে। ড. গয়াল এই অঞ্চলে প্রাপ্ত সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তির ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। কেননা, গুপ্তযুগের সমস্ত লেখগুলির মধ্যে এটিই হল সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর সূত্র ধরে তিনি আরো মনে করেন যে প্রারম্ভিক পর্বের গুপ্তশাসকদের শক্তির কেন্দ্রস্থল ছিল উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের এলাহাবাদ তথা প্রয়াগ অঞ্চল। এইভাবে তিনি দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন যে মগধ অথবা বাংলার তুলনায় পূর্ব উত্তরপ্রদেশে গুপ্তদের আদি বাসভূমির পিছনে যুক্তি বেশি জোরালো। রামশরণ শর্মাও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে আদি পর্বের গুপ্ত রাজাদের বেশিরভাগ মুদ্রা ও শিলালেখ প্রাপ্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এর ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে প্রয়াগ ছিল গুপ্তদের শক্তির উৎসস্থল।
সম্প্রতি ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সারনাথে প্রাপ্ত একটি মূর্তির পাদদেশে উৎকীর্ণ লেখর ভিত্তিতে সারনাথ তথা পূর্ব উত্তরপ্রদেশে গুপ্তদের আদি বাসভূমি নির্ণয়ে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। লেখটি তারিখবিহীন হলেও লিপি তত্ত্বের ভিত্তিতে একে গুপ্তযুগের বলেই মনে করা হয়ে থাকে। ঐ লেখটিতে ‘শ্রীগুপ্ত স্বামি’ (প্রভু)-র উল্লেখ আছে। ‘স্বামি’-এই অভিধাটি থেকে মনে হয় যে শ্রীগুপ্ত ছিলেন ক্ষুদ্র অঞ্চলের প্রধান। এই শ্রীগুপ্তর সঙ্গে গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা অভিন্ন ছিলেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা শক্ত। তবে যদি ঐ দু’জন একই ব্যক্তি হন তাহলে স্বীকার করতে হবে যে সারনাথ তথা তৎসংলগ্ন এলাকা হয়তো সাম্রাজ্যবাদী গুপ্তদের আদি বাসভূমি ছিল।
মূল্যায়ন :
গুপ্তদের আদি বাসভূমি সংক্রান্ত বিস্তৃত আলোচনা থেকে কোনো একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা শক্ত। বাংলা বা মগধে যে তাদের আদি বাসভূমি ছিল না তা যেমন জোর করে বলা যাবে না, তেমনি সারনাথ, প্রয়াগ তথা পূর্ব উত্তরপ্রদেশ তাদের আদিবাসভূমি ছিল, এমন কথাও নির্দ্বিধায় বলা কঠিন। তবে যে সমস্ত যুক্তিগুলি দুই পক্ষের ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন সেগুলির ভিত্তিতে শুধু একথা বলা যায় যে সারনাথ তথা পূর্ব উত্তরপ্রদেশ অর্থাৎ মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় তাঁদের আদি বাসভূমির তত্ত্বটি তুলনামূলকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য।